বাংলাদেশের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি নিয়ে সম্প্রতি হাইকোর্টে এক রুলের শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এর এক বিতর্কিত বক্তব্যে বাংলাদেশের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি ও ইতিহাসকে কেন্দ্র প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তিনি সংবিধানের অষ্টম অনুচ্ছেদের ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে সেখানে “সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস” প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব রেখেছেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের বিতর্কীত বক্তব্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, রাজনৈতিক মহল এবং সুশীল সমাজ বাংলাদেশের ভবিষ্যত ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য
সম্প্রতি হাইকোর্টে এক রুলের শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে সংবিধানে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ বহাল থাকা উচিত, যা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।” তিনি দাবি করেন, এটি দেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া
এই বক্তব্যকে ঘিরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এক বিবৃতিতে জানায়, “এটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের ওপর আঘাত এবং সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা।”
সংখ্যালঘু নেতারা বলছেন, সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাদ দিলে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, বৈষম্য ও দমনপীড়ন আরও বাড়বে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অভিমত, ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে সংবিধানের পরিবর্তন হবে আত্মঘাতী।
সুশীল সমাজ ও মানবাধিকার কর্মীদের উদ্বেগ
মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে বলেছে, “সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি বাংলাদেশের বহুত্ববাদী ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করে। এই নীতি থেকে সরে আসা মানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার খর্ব করা।” সুশীল সমাজের একজন বিশিষ্ট সদস্য বলেন, “ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাদ দেওয়ার অর্থ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বিচ্যুতি।”
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদসহ ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এর মতে, রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মৌলনীতি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দেওয়ার বিষয়টি গণতন্ত্র, পরমতসহিষ্ণুতা, সংখ্যালঘুর অধিকার, আইনের শাসনে নাগরিকের সমতা, ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহির ব্যবস্থা, মুক্তিযুদ্ধ ও বৈষম্যবিরোধী চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী মনে করে, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের পরিপন্থি হিসেবে সংবিধানে পরিবর্তন এবং পরবর্তী সময়ে সংবিধানের ২ক অনুচ্ছেদে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ সংযোজন করার মধ্য দিয়ে নাগরিকদের মাঝে বৈষম্য সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে। সংখ্যালঘু ঐক্যমোর্চার সংগঠনসমূহ তিন যুগ ধরে রাষ্ট্রধর্ম বাতিল এবং অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছে। সংখ্যালঘু ঐক্যমোর্চা মনে করে, অ্যাটর্নি জেনারেলের শুনানিতে প্রদত্ত বক্তব্য একদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের মূলচেতনা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থি; অন্যদিকে জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চেতনার সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্ধ, অ্যাটর্নি জেনারেলকে সংশ্লিষ্ট শুনানিতে তার প্রদত্ত বক্তব্য প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছে—যেন অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন ও মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সাংবিধানিক সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়।
অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই প্রস্তাবের বাস্তবায়ন দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও প্রগতিশীল অংশের মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এটি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।