রংপুর, বাংলাদেশ: বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের উদ্যোগে রংপুরের মাহিগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ মাঠে বিভাগীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংখ্যালঘু সুরক্ষার দাবিতে আয়োজিত এই সমাবেশে বিভিন্ন জেলা থেকে লক্ষাধিক সনাতন ধর্মাবলম্বী উপস্থিত হন। তবে সমাবেশে অংশগ্রহণের পথে বাধা, হামলা ও প্রশাসনিক জটিলতার অভিযোগ করেছে সনাতনীরা, যা স্থানীয় এবং জাতীয়ভাবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা শংকা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করেছে।
সুত্র মতে, সনাতন জাগরণ মঞ্চ দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় কর্মসূচি গ্রহণ করে আসছে। এবার তাদের আট দফা দাবির পক্ষে এই বিভাগীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, হিন্দু ফাউন্ডেশন গঠন, এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য ছুটিসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবি এই সমাবেশের মূল বিষয়বস্তু ছিল।
সমাবেশে বাধা ও হামলার অভিযোগ
সমাবেশে অংশ নিতে কুড়িগ্রামের কাউনিয়া উপজেলা থেকে রংপুরগামী একটি বাসে হামলা চালানো হয়। এতে প্রায় ২০ জন আহত হন বলে জানা যায়। হামলাকারীরা বাসে পাথর নিক্ষেপ করে এবং যাত্রীদের মারধর করে। আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর ছিল।
একজন অংশগ্রহণকারী বলেন, “বাসটি যখন রংপুরের দিকে যাচ্ছিল, তখন স্থানীয় একটি দল হঠাৎ করেই বাসের সামনে এসে আমাদের নামিয়ে দেয়। আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, কেন সমাবেশে যাচ্ছি। এরপর হামলা শুরু হয়।”
বাসের যাত্রীদের বাধা দেওয়ার পাশাপাশি কিছু এলাকায় পুলিশও তাদের থামিয়ে দেয় বলে অভিযোগ করা হয়। বিশেষ করে ত্রিমোহনী বাজারে বিক্ষুব্ধ অংশগ্রহণকারীরা সড়ক অবরোধ করতে বাধ্য হন। একাধিক বাস আটকে দেওয়ার কারণে সমাবেশে অনেকেই উপস্থিত হতে পারেননি।
কুড়িগ্রাম জেলার সনাতন জাগরণ মঞ্চের প্রধান সমন্বয়ক রাজিব সরকার অপু বলেন, “কিছু কুচক্রী মহল আমাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা চাই প্রশাসন এসব হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক। আমাদের অধিকার নিয়ে কথা বলার স্বাধীনতা রয়েছে।”
প্রশাসনিক জটিলতা ও মাঠ পরিবর্তন
সমাবেশের জন্য প্রথমে রংপুর জেলা স্কুল মাঠের অনুমতি নেওয়া হলেও শেষ মুহূর্তে তা মাহিগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ মাঠে স্থানান্তর করা হয়। আয়োজকদের দাবি, প্রশাসনের চাপেই স্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য করা হয়।
এছাড়াও, সমাবেশ আয়োজনের জন্য ২৭ দফা শর্ত জারি করা হয়। এসব শর্তের মধ্যে ছিল নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সমাবেশ শেষ করা, উচ্চস্বরে শব্দ ব্যবহার না করা, এবং পুলিশের অনুমতি ছাড়া মিছিল না করা।
রংপুর জেলা প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন দাবি করেছে, সমাবেশের নিরাপত্তার জন্যই এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
সমাবেশ থেকে দাবি ও বক্তব্য
সমাবেশে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী আট দফা দাবি উপস্থাপন করেন। এসব দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:
- সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন: দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ সুরক্ষা আইন চালু করা।
- ট্রাইব্যুনাল গঠন: সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচারের জন্য দ্রুত কার্যকরী ট্রাইব্যুনাল স্থাপন।
- সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গঠন।
- দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার: দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষা ও সংরক্ষণে কার্যকর আইন প্রণয়ন।
- ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছুটি: দুর্গাপূজায় ৫ দিনের সরকারি ছুটি ও অন্যান্য উৎসবে ছুটির বিধান।
- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপাসনালয়ের ব্যবস্থা: সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য পূজার আয়োজনের সুযোগ।
- হিন্দু ফাউন্ডেশন গঠন: হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে হিন্দু ফাউন্ডেশনে রূপান্তর।
- সংস্কৃত ও পালি শিক্ষাবোর্ড আধুনিকীকরণ।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস বলেন, “আমাদের আট দফা দাবি দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত হচ্ছে। এখনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এ দেশের জন্মে আমাদের ভূমিকা রয়েছে। আমাদের এ দেশ থেকে উৎখাত করার চেষ্টা করলে তার ফলাফল ভয়াবহ হবে।”
সমাবেশে নিয়ে প্রতিক্রিয়া
সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে হতাশা এবং ক্ষোভ দেখা যায়। একজন প্রবীণ সনাতন ধর্মাবলম্বী বলেন, “আমরা আমাদের অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্যই এখানে এসেছি। কিন্তু পথে বাধা পেয়ে মনে হলো, আমাদের কথা বলার অধিকারই নেই।”
অন্যদিকে, স্থানীয় এক মুসলিম বাসিন্দা বলেন, “ধর্ম যার যার, দেশ সবার। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। এমন হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “প্রশাসনের উচিত সংখ্যালঘুদের দাবিকে গুরুত্ব দেওয়া। তারা এই দেশে বসবাসের পূর্ণ অধিকার রাখে।”
অন্যদিকে, সমাবেশে হামলার নিন্দা জানিয়ে একজন নেটিজেন বলেন, “এ ধরনের ঘটনা প্রমাণ করে, আমাদের সমাজে এখনো সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ রয়ে গেছে। এটি আমাদের জাতীয় অগ্রগতির পথে বড় বাধা।”
সমাবেশ থেকে ভবিষ্যত পরিকল্পনা ঘোষণা
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস সমাবেশে জানান, রংপুরে এই সমাবেশের পর বরিশাল, সিলেট এবং চট্টগ্রাম বিভাগেও সমাবেশ আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক নই। যে দল আমাদের অধিকার নিশ্চিত করবে, আমরা তাদেরকেই ভোট দেব।”
রংপুরে সনাতনী জাগরণ মঞ্চের বিভাগীয় সমাবেশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছে। তবে হামলা ও বাধার অভিযোগ এই শান্তিপূর্ণ প্রচেষ্টাকে কলঙ্কিত করেছে। সংখ্যালঘু সুরক্ষা এবং তাদের দাবিগুলোর প্রতি প্রশাসনের ইতিবাচক মনোযোগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি। এ ধরনের উদ্যোগ দেশের সকল ধর্মের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে সহায়ক হতে পারে।