বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি বোর্ড নতুনভাবে গঠন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে চেয়ারম্যান এবং সচিবকে সদস্য করে ১০ সদস্য বিশিষ্ট নতুন বোর্ড গঠনের প্রজ্ঞাপন সোমবার (১৮ নভেম্বর) প্রকাশিত হয়েছে। এই নতুন বোর্ড ১৬ নভেম্বর ২০২৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবে। তবে, সদ্য সাবেক ট্রাস্টি বোর্ডের ব্যাপক স্বেচ্ছাচারিতা, দুনীতির অভিযোগ নতুন বোর্ডের প্রতি সাধারণ বৌদ্ধদের স্বাভাবিক প্রত্যাশা ব্যাপক বেড়েছে।
ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের পটভূমি
বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা । সরকার ১৯৮৩ সালে মহামান্য রাষ্ট্রপতির ৬৯ নং অধ্যাদেশ বলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে এ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন। বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, ২০১৮-এর ৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী সোমবার (১৮ নভেম্বর) নতুন ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনা, বৌদ্ধ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উন্নয়ন, এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের তহবিল ব্যবস্থাপনার জন্য বোর্ড নতুনভাবে কার্যক্রম শুরু করবে।
পূর্বের বোর্ডে নানা অসঙ্গতি এবং দুর্নীতির অভিযোগ উঠে আসায় এই পরিবর্তনটি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নতুন বোর্ডের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন ঢাকা মোহাম্মদপুরের ভবেশ চাকমা।
নতুন বোর্ডের গঠন
নতুন বোর্ডে অভিজ্ঞ ও যোগ্য ব্যক্তিদের স্থান দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। বোর্ডের সদস্যরা হলেন:
- ড. সুকোমল বড়ুয়া – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
- মেজর (অব.) ডা. অজয় প্রকাশ চাকমা
- মং হলা চিং – চট্টগ্রামের প্রখ্যাত সামাজিক সংগঠক
- অধ্যাপিকা ববি বড়ুয়া – চট্টগ্রাম নন্দনকান, শিক্ষাবিদ
- রাজীব কান্তি বড়ুয়া – মিরপুর, ঢাকার উদ্যোক্তা
- সুশীল চন্দ্র বড়ুয়া – উত্তরা, ঢাকার সাংস্কৃতিক কর্মী
- রুবেল বড়ুয়া – চট্টগ্রামের চন্দনাইশ এলাকার প্রতিনিধি
এই বোর্ডের প্রত্যেক সদস্য বৌদ্ধ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশ্বাস পুনঃস্থাপন এবং তহবিল ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবেন এমনতা আশা করছেন দেশের সাধারণ বৌদ্ধরা।
পুরনো বোর্ডের ভাইস-চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ
পূর্বের ট্রাস্টি বোর্ডের ভাইস-চেয়ারম্যান সুপ্ত ভূষণ বড়ুয়ার বিরুদ্ধে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও সাধারণ বৌদ্ধদের পক্ষ থেকে ব্যাপক অভিযোগ ছিল বিগত বছর গুলোতে। সুপ্ত ভূষণ বড়ুয়ার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তহবিল আত্মসাৎ এবং সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ট্রাস্টের তহবিল থেকে বড় অংকের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন এবং উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার না করে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, তার নেতৃত্বাধীন বোর্ডে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়ন ছিল অস্বচ্ছ। ট্রাস্টের অর্থ ও বিহার ভিত্তিক অনুদান ব্যবস্থাপনায় নিয়ম না মানার অভিযোগ ছিল ব্যাপক। যদিও অভিযোগগুলো কোনো নিরপেক্ষ প্রতিবেদন এখনো প্রকাশিত হয়নি।
এদিকে পুরনো বোর্ডের কোষাধ্যক্ষ ববিতা বড়ুয়া চেক প্রত্যাখানের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এখন করাগারে আছেন।
আদালত সূত্র জানায়, জেলার লোহাগাড়া উপজেলার রুপম বড়ুয়া নামে এক ব্যক্তি ২০১৯ সালে ছয় লাখ টাকার চেক প্রত্যাখ্যানের অভিযোগে ববিতা বড়ুয়ার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। গত জানুয়ারি মাসে আদালত এই মামলায় তাঁকে নয় মাসের কারাদণ্ড এবং ছয় লাখ টাকা জরিমানা করেন। এ ছাড়া আরও দুটি চেক প্রত্যাখ্যানের মামলায় সাজা হয়েছে ববিতা বড়ুয়ার বিরুদ্ধে।
দুর্নীতির অভিযোগের প্রতিক্রিয়া
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠন এবং সাধারণ মানুষ পুরনো বোর্ডের এই দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা দ্রুত একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করে অভিযোগগুলোর সুষ্ঠু সমাধান দাবি করেছেন।
একজন বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এই দুর্নীতির অভিযোগ আমাদের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করেছে। নতুন বোর্ডকে অবশ্যই স্বচ্ছতার প্রতীক হতে হবে।”
নতুন বোর্ডের চ্যালেঞ্জ
নতুন বোর্ডের দায়িত্ব কেবল ট্রাস্টের কার্যক্রম পরিচালনাতেই সীমাবদ্ধ নয়। পুরনো বোর্ডের কার্যক্রমের ঘাটতি মেটানো এবং তহবিল ব্যবস্থাপনায় আস্থা ফিরিয়ে আনা তাদের বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাস্টি বোর্ডের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে সেগুলো হলো:
- তহবিল ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা
- পুরনো অভিযোগগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করা
- বৌদ্ধ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ফিরিয়ে আনা
- ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রত্যাশা
নতুন বোর্ডের প্রতি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রত্যাশা অনেক। তাঁরা চান, নতুন বোর্ড পুরনো দুর্নীতির অভিযোগ থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি সুষ্ঠু এবং সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে।
চট্টগ্রামের এক প্রবীণ বৌদ্ধ নেতা বলেন, “আমরা চাই ট্রাস্টি বোর্ড তাদের দায়িত্ব স্বচ্ছতার সাথে পালন করুক। যেসব অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, তার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়।”
বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের নতুন ট্রাস্টি বোর্ড গঠন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। যদিও পুরনো অভিযোগগুলো এখনও একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে, নতুন বোর্ডের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার মাধ্যমে আস্থা অর্জনের সুযোগ রয়েছে। যদি তারা তাদের কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারে, তবে এই ট্রাস্টি বোর্ড বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হবে।