ইউরোপে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন এবং এশিয়ায় অজন্তা গুহা। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের উৎপত্তি যেমন রহস্যময় তেমনি রহস্যময় অজন্তা গুহার উৎপত্তি। ভারতের মহারাষ্ট্রে অবস্থিত অজন্তার গুহাসমূহ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে স্পষ্টতই বিভেদ আছে। একদল দাবি করেন, ১০০ অব্দ থেকে ১০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অজন্তার চারটি গুহা নির্মাণ করা হয়। কিন্তু অপর একদলের দাবি যে এটা ৪৬০-৪৮০ খ্রিস্টাব্দ সময়কালীন ভারতের ভক্তক রাজবংশের সম্রাট হরিসেনা ২৩টি গুহা নির্মাণ করেন। তবে উপরোক্ত দুই পক্ষের দাবির পেছনে নিরেট কোনো প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি বিধায় অজন্তা এখনও রহস্যের চাদরে মোড়া।
১৮১৯ সালে ভারতের মহারাষ্ট্র থেকে ৪৫০ কিলোমিটার পূর্বে আবিস্কৃত হয় অজন্তা গুহা। প্রায় এক হাজার বছর ওই গুহাগুলো লোকচক্ষুর অন্তরালে বিভিন্ন পশু-পাখির বাসা হিসেবে ছিল। তবে স্থানীয়দের দাবি, স্থানীয় ভিল জনগোষ্ঠীর মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই ওই গুহাগুলোতে বিচরণ করতেন। অবশ্য স্থানীয়দের এই দাবির পেছনে অনেক প্রমাণাদিও পাওয়া যায়। ভিল জনগোষ্ঠী যে আর্টে অভ্যস্ত ঠিক সেই একই আর্ট বা চিত্রকলার নিদর্শন অজন্তার বিভিন্ন গুহায় পাওয়া যায়। যা আজও ভারতের চিত্রকলার ইতিহাসে অনন্য স্থান দখল করে আছে। জন স্মিথ নামের এক বাঘ শিকারী অনেকটা দুর্ঘটনাবশতই এই গুহা আবিষ্কার করেছিলেন বলে জানা যায়। স্মিথ যখন বাঘ খুঁজতে খুঁজতে গুহায় প্রবেশ করেন তখনই তিনি আবিষ্কার করেন বিশাল কিছু বুদ্ধ মুর্তি। যা এর আগে গোটা ভারতবর্ষের কোথাও দেখা যায়নি।
স্মিথ অবশ্য তার নিজের নামটি বিশেষ কায়দায় খোদাই করে বোধিস্বত্ব মূর্তির গায়ে লিখে গিয়েছিলেন। তার গুহা আবিষ্কারের পরেও কিন্তু অজন্তা সম্পর্কে অতটা জানাজানি হয়নি। কিন্তু ১৮৪৪ সালে মেজর রবার্ট গিল র্যয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির হয়ে অজন্তার সবগুলো গুহা আবিষ্কার করেন এবং অজন্তার গুহার শরীরে চিত্রিত চিত্রকলাকে কাগজে কলমে চিত্রিত করেন। গিল সেসময় অনেক প্রাচুর্যের ভেতর দিয়ে কাজ করলেও গুহার ভেতরের ভাস্কর্যগুলোর রহস্য ভেদ করতে পারেননি।
গুহার ভেতরে বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে। আর এই মন্দিরগুলোতে প্রবেশের রয়েছে দুই থেকে তিনটি প্রবেশদ্বার। এরমধ্যে একটি ছিল মূল প্রবেশদ্বার এবং অন্যান্যগুলো পার্শ্বদ্বার। প্রথম গুহায় রয়েছে বৌদ্ধ জাতক কাহিনীর বিভিন্ন ঘটনার ভাস্কর্য। পাশাপাশি গুহার দেয়ালে গৌতম বুদ্ধের একটি বিশাল মূর্তি রয়েছে। ধর্মচক্রপ্রবর্তন মুদ্রায় এই বুদ্ধ মূর্তিটি শিল্প নৈপূণ্যে অনবদ্য। গুহার অন্যান্য দেয়ালে রয়েছে জাতক কাহিনীর বিবরণ। ৯, ১০, ১২ নম্বর গুহার ভেতরে আছে বোধিস্বত্বের বিভিন্ন রূপের ভাস্কর্য ও দেয়ালচিত্র। গুহাগুলোর মেঝে ছাড়া দেয়ালের ও ছাদের প্রতিটি অংশে রয়েছে কারুকার্য, মূর্তি, ফ্রেসকো ও ম্যুরাল। দ্বিতীয় গুহার প্রবেশদ্বার অন্য গুহাগুলোর চেয়ে বেশি কারুকার্যময়। ধারণা করা হয়, এই গুহার ভেতরের মন্দিরেই মূল বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। হলগুলোর চারদিকে রয়েছে বড় চারটি স্তম্ভ। ছাদ যেন ধসে না পড়ে সে জন্য রয়েছে পাথরের খিলান। চতুর্থ গুহাটি বেশ বড় এবং এতে বোধিস্বত্ব অবলোকিতেশ্বরের বিভিন্ন মূর্তি রয়েছে। অজন্তায় গুহাচিত্রের জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে তা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের গুহাচিত্রের পদ্ধতির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। ভারতের প্রাচীনতম মন্দিরচিত্রেরও অন্যতম হলো অজন্তার মন্দির চিত্র। পাহাড় কেটে কীভাবে এই মন্দিরগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল তা আজও স্থাপত্যজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক বড় বিস্ময়।
নিভৃতচারী সদ্ধর্মানুরী বৌদ্ধ ভিক্ষু ব্যক্তিত্ব।