অনন্য প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব অনাগারিক ধর্মপাল। যাঁদের ত্যাগ, মেধা, ধী-শক্তি ও প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে ভারতে তথাগতের সদ্ধর্ম পুনর্জাগরণ আরম্ভ হয়েছিল তাঁদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম সারির একজন। এই মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্ব বিগত ১৭ সেপ্টেম্বর ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে শ্রীলঙ্কার মাতারায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ডন কারোলিস হেওয়াবিতরণ ও মাতার নাম মল্লিকা ধর্মগুণবর্ধন হেওয়াবিতরণ। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয়েছিল ডন ডেভিড হেওয়াবিতরণ।
বৌদ্ধবিদ্যা ও সংস্কৃতির প্রতি অনাগারিক ধর্মপালের আগ্রহী হয়ে উঠার প্রেরণায় ছিলেন প্রাথমিকভাবে তাঁর মা মল্লিকা ধর্মগুণবর্ধন হেওয়াবিতরণ এবং পরবর্তীতে হিক্কিদুয়ে সিরি সুমঙ্গল নায়ক থের এবং মিগেট্টুওয়াট্টে সিরি গুণানন্দ থের। ১৮৮০ সালে ষোল বছর বয়সের সময় পাশ্চাত্যের কর্ণেল হেনরি স্টিল অলকট (১৮৩২-১৯০৭) এবং হেলেনা ব্লাবাটস্কির (১৮৩১-১৮৯১) সংস্পর্শে এসে তিনি থিওসফি বা ধর্মতত্ত্ব নিয়ে আগ্রহী হয়ে পড়েন। বৌদ্ধ ভিক্ষুর সংস্পর্শে এসে অলকট এবং ব্লাবাটস্কি দুজনেই বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। ধর্মপাল অলকটের অনুবাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং তৎ সঙ্গে ব্লাবাটস্কির সাথে তাঁর বন্ধুত্ব তৈরী হয়। অলকটের সহায়তায় তদানীন্তন কালেই তিনশত বৌদ্ধ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতিমধ্যে তিনি সরকারী চাকরিও লাভ করেন। ১৮৮৬ সালের দিকে কর্ণেল হেনরি স্টিল অলকট এবং সি.ডব্লু লিডবিটার শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ শিক্ষার জন্য ফান্ড সংগ্রহ করতে আগমন করেন এবং ধর্মপাল সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে কর্ণেল অলকট বৌদ্ধবিদ্যা বিষয়ক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত হয়ে পড়েন। এই সকল কাজ করতে গিয়ে তিনি নিজের মাতৃভাষা সিংহলি; এবং ইংরেজী ও পালি ভাষায় বিশেষ বুৎপত্তি লাভে সচেষ্ট হয়ে সফলকাম হন। বৌদ্ধ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ফাণ্ড গঠন করতে গিয়ে তিনি শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করেছিলেন; স্বাদেশিকতা ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী হয়ে তিনি তাঁর বিদেশী প্রভাবিত নাম ‘ডন ডেভিড হেওয়াবিতরণ’ পরিবর্তন করে ‘ধর্মপাল’ রাখেন; যেটির অর্থ, ধর্মের রক্ষক। এই পর্যায়ে তিনি জনগণকেও স্বাদেশিকতা ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী করতে উদ্যোগ নেন, যেটি ছিল সেসময়কালে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধেও কথা বলার মতোন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি তদানীন্তন শ্রীলঙ্কার জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের সুনজরেও পড়েন।
মাত্র কুড়ি বছর বয়সে তিনি সরাসবি-সন্দরেস (Saraasabi-Sandaresa) নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। শ্রীলঙ্কার ইংরেজী ভাষাভাষীরা যাতে বৌদ্ধ ধর্ম ও স্বাদেশিকতা সম্পর্কে জানতে পারে সেই লক্ষ্যে তিনি ১৮৮৮ সালে ‘দ্য বুদ্ধিস্ট’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করা শুরু করেন।
সেই বছরই, অর্থাৎ, ১৮৮৮ সালেই ধর্মপাল অলকট সাহেবের সাথে জাপান যাত্রা করেন, যাতে বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন প্রচলিত শাখার সাথে মেলবন্ধন রচিত হয়। ১৮৯১ সালে তিনি ব্লাবাটস্কির সাথে ভারতে গমন করেন। বিশ্ব বৌদ্ধদের প্রধান তীর্থভূমি বুদ্ধগয়ার মহাবোধি মন্দিরের শোচনীয় পরিস্থিতি দেখে তিনি স্বদেশে ফিরে ১৮৯১ সালেই কলম্বোতে ‘মহাবোধি সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন ও ১৮৯২ সালে তা তদানীন্তন ভারতের রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তর করেন, যেটি বর্তমানে কলকাতার বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটে কলেজ স্ট্রীটের বিপরীতে অবস্থিত। এবং ১৮৯২ সালের মে মাস হতে ‘দ্য মহাবোধি’ নামক মাসিক ইংরেজী পত্রিকা সম্পাদনা করেন যেটি বিশ্বব্যাপী বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
১৮ সেপ্টেম্বর ১৮৯৩ সালে ২৯ বছর বয়সে আমেরিকার শিকাগোতে বিশ্বধর্ম পার্লামেন্ট দক্ষিণীয় বা থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে “দ্য ওয়াল্ড ডেবট্ টু বুদ্ধ, অর্থাৎ বুদ্ধের প্রতি বিশ্বের ঋণ” শীর্ষক বক্তৃতা প্রদান করেন। তাঁর দুর্দান্ত অথচ বুদ্ধিদীপ্ত বক্তৃতায় পাশ্চাত্যে সাড়া পড়ে যায়। তিনি আমেরিকায়ও তখন মহাবোধি সোসাইটির একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেন।
১৮৯৬ সালে তিনি তাঁর এক অনুরাগী ধনাঢ্য মেরী ই ফোস্টারের পৃষ্ঠপোষকতায় আবার আমেরিকা গমন করেন এবং বুদ্ধ পূর্ণিমা উদ্যাপন করেন সেখানে। ১৯০৬ সালে ফোস্টারের সহায়তায় ‘সিংহলা বৌদ্ধায়া’ নামে আরেকটি পত্রিকা প্রকাশ করেন যেটিতে বৌদ্ধ ধর্ম ও সিংহলী স্বাদেশিকতার প্রাসঙ্গিকতা ও শ্রীলঙ্কায় ব্রিটিশ নীতির সমালোচনা করেন। ইতোমধ্যে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন এবং লন্ডন, দিল্লী, নিউইয়র্ক প্রভৃতি শহরে মহাবোধি সোসাইটির শাখা প্রতিষ্ঠা করেন।
তাঁর বিখ্যাত লেখাগুলো হল- ১. ‘দ্য কনস্ট্রাক্টিভ অপটিমিজম অব বুদ্ধিজম’ বা বৌদ্ধ ধর্মের গঠনমূলক প্রত্যাশা (১৯১৫); ২. ‘মেসেজ অব দ্য বুদ্ধ’ বা বুদ্ধের বার্তা (১৯২৫) এবং ৩. ‘ইবোলুশন ফ্রম দ্য স্ট্যান্ডপয়েন্ট অব বুদ্ধিজম’ বা বৌদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গীতে বিবর্তন (১৯২৬)। ১৯৩১ সালে বুদ্ধের প্রথম উপদেশ প্রদানের স্থান সারনাথে নির্মাণ করান বৌদ্ধ বিহার, যেটি এখন ‘মূল গন্ধকুটি বিহার’ হিসেবে পরিচিত। ১৯৩১ সালের ১৩ জানুয়ারী তিনি ‘দেবমিত্র ধর্মপাল’ নাম নিয়ে তিনি ভিক্ষুধর্মে দীক্ষিত হন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য বাণীগুলোর অন্যতম হলো:
১. উদ্যম ছাড়া প্রগতিশীল উন্নতি সম্ভব নয়। বুদ্ধ তাঁর ধর্মের ভিত্তি করেছিলেন বীর্যবান উদ্যম ও সজাগ কার্যক্রমের দ্বারা।
২. আক্রোশ বা দ্বেষ মানুষকে দানবে রূপান্তরিত করে; ভয় হলো অবিদ্যা/অজ্ঞতা, এবং অবিদ্যা বা অজ্ঞতাই হলো সর্ববিধ শারিরীক ও মানসিক দুঃখের কারণ।
৩. রাজকীয় পরিবারে জন্মগ্রহণে বুদ্ধের মহিমা নির্ভর করে না; বুদ্ধের মহিমা হলো তাঁর অতুলনীয় প্রজ্ঞা যদ্বারা তিনি আত্মজয় করেছেন; এবং তাঁর অপরিসীম প্রেম।
৪. এখানে কিছুই স্থায়ী নয়, সকলই পরিবর্তনশীল। প্রতিটি মিনিটের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রাংশ হতে সর্বোচ্চ স্বর্গ সকল কিছুই রূপান্তর হয়ে চলেছে। ক্ষণিকের তরে সবকিছুই উদয় হচ্ছে, স্থিত হচ্ছে, আবার বিলয় হচ্ছে জল বুদ্বুদের মতো।
৫. আমরা স্বার্থপর, এবং আমাদের বিলাসময় জীবন আমাদের পার্শ্ববর্তী জনগণের প্রতি আমাদের কর্তব্য পরায়ণতা ভুলিয়ে দেয়ার কারণ।
মহাপ্রাণ: বিরল প্রতিভাবান, ভারত ও পাশ্চাত্যে বৌদ্ধ ধর্ম জাগরণের পথিকৃৎ মনীষা বিগত ২৯ এপ্রিল ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতস্থ সারনাথের মূল গন্ধকুটি বিহারে দেহত্যাগ করেন।
নিপুন বড়ুয়া চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী থানার অন্তর্গত বঙ্গীয় বৌদ্ধদের খ্যতিসম্পন্ন ও সুপরিচিত শীলকূপ গ্রামের জন্মজাত সন্তান। নিপুন বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে PhD Degree অর্জনের জন্য গবেষণায় নিয়োজিত আছেন। অদ্যাবধি তাঁর বহু প্রবন্ধ ও গ্রন্থ পাঠক মহলে ব্যাপক নন্দিত হয়েছে।