সংঘনায়ক সৌগতসূর্য অগ্রসার মহাস্থবির ৫মে ১৮৬০ সালে চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানাধীন পূর্বগুজরা বৃহত্তর হোয়ারাপাড়ার ভগীরত নগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।পিতা জিতুরাম বড়ুয়া ও মাতা লেদনীবালা বড়ুয়া। তাঁরা পাঁচ ভাই, এক বোন। বোনের নাম সত্যনী আর ভাইদের নাম যথাক্রমে, শ্রীধন, কর্মধন, দুর্যোধন, রূপধনও কমলধন। মাননীয় মহাস্থবির ভাইদের মধ্যে তৃতীয় এবং গৃহী নাম দুর্যোধন। মাননীয় মহাস্থবিরের বংশ তালিকা থেকে জানা যায়, তিনি থানেশ্বর বা সালেশ্বর বংশের বিংশতিতম প্রতিনিধি, অর্থাৎ সুদূর অতীত হতে যে বংশ বৌদ্ধধর্ম সমাজ ও শাসনের উন্নয়ন কল্পে বংশের প্রতি পুরুষ হতে অন্ত একজন যোগ্য ব্যক্তিত্বকে দান করে আসছে।
মহাত্মা সংঘনায়ক সৌগতসূর্য অগ্রসার মহাস্থবির মহোদয় শৈশব থেকেই ধীর, গম্ভীর,অধ্যাবসায়ী, অধ্যয়নপ্রিয় ও প্রত্যুৎপন্নমতি ছিলেন। একই বংশের উনবিংশতিতম প্রতিনিধি মাননীয় মহাস্থবির মহোদয়ের পিতৃব্য সংঘনায়ক ত্রিরতন (তিতন) মহাস্থবির ভ্রাতুষ্পত্রের মধ্যে এসব গুণপন্ ও প্রতিভার স্ফূরণ দেখে অতিশয় মুগ্ধ হন।অতঃপর পনের বছর বয়সে (১৮৭৫ খ্রিঃ) শ্রামণ্যধর্মে ও ২৩ বছর বয়সে ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে নিজের উপাধ্যায়ত্বে ভিক্ষুব্রতে দীক্ষা দান করেন।
শ্রামণ্য জীবনের শুরু থেকেই মাননীয় মহাস্থবির বাংলা, পালি, সংস্কৃত, বর্মী ও হানইক ভাষা চর্চা শুরু করেন এবং পরবর্তী সময়ে এ সব ভাষা ও সাহিত্যে তিনি বিশেষ পারদর্শী হন।মাননীয় মহাস্থবির মাহিত্যসেবা ও বঙ্গভাষা সমৃদ্ধির মানসে প্রথম অবদান রাখেন ১২৫৫ মগাব্দে “বুদ্ধভজনা” নামক গ্রন্থটি প্রণয়ন করে। অতঃপর১২৫৬ মগাব্দে বঙ্গানুবাদসহ গাথা সংগ্রহ সংকলন ১২৬০, বঙ্গাব্দে বাংলা প্রতিশব্দসহ পালি শব্দ সংগ্রহ, ১২৭৮ মগাব্দে বঙ্গাক্ষরে অনুবাদসহ ধম্মপদ অট্টকথা প্রণয়ন করেন। এসব ছাড়াও তিনি অনেক প্রবন্ধ ও ছোট ছোট অনুবাদকার্য সম্পাদন করেন।(১) মূলত মহাস্থবির মহোদয়ের এসব লেখায় সৃজনীশক্তি ও মৌলিক চিন্তাধারার প্রকাশ পেয়েছে। কাহিনী বিন্যাসে, ভাবের ব্যঞ্জনায়, সহজ সরলভাবে বক্তব্য উপস্থাপন সর্বোপরি প্রাঞ্জল রচনাশৈলী তাঁকে অতমরত্ব করেছে।
পালি ভাষা ও সাহিত্যের যথাযথ মূল্যায়নে ও ধর্মীয় শিক্ষার সম্প্রচারার্থে ১২৪৭ মগাব্দে বঙ্গীয় সংস্কৃত পরিষদের অনুমোদনসহ পাহাড়তলী গ্রামে প্রথম পালি টেোল সংস্থাপনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৩১ সালে সারনাথ মূলগন্ধকুঠি বিহারের দ্বারোৎঘাটন উপলক্ষে ব্রহ্মদেশ, শ্রীলংকা, তিব্বত, নেপাল, সিকিম, চীন প্রভৃতি বৌদ্ধদেশ হতে আগত বৌদ্ধগণের পক্ষে জ্ঞানী ও বয়োবৃদ্ধ হিসাবে মাননীয় মহাস্থবির তদানীন্তন সরকারের প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর বিভাগের পরিচালক হতে বুদ্ধ পূতাস্থি গ্রহণ করে(২) বাঙালি বৌদ্ধদের ললাটে গৌরবটিকা পরিয়ে দেন। তাঁর এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৩৮ সালে স্বগ্রামে অগ্রসার জয়ন্তী ও আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।এ বৌদ্ধ সম্মেলন সর্ম্পকে বলা যায়, বহু বর্ষ পর সুপ্তোত্থিত বাঙালি বৌদ্ধগণ সমবেত হয়ে তাঁদের নতুন চেতনাকে প্রকাশ করেছে, তাঁদের এ সব নবজাগরণ অভিনন্দযোগ্য।(৩)
মহাত্মা অগ্রসার মহাস্থবির সুদীর্ঘ ৮৫ বৎসর জীবিত থেকে সমাজ, শাসন তথা দেশের সার্বিক উন্নয়নে প্রবল জোয়ারবান এন দিয়ে ১৯৪৫ সালে ৮ অক্টোবর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
- তথ্যসূত্রঃ ১। অগ্রসার জয়ন্তী কার্যবিবরণী, সম্পাদনায়ঃ শ্রী উমেশ চন্দ্র মুৎসুদ্দি ১৯৩৮, পৃ: ৩।
- ২। The Mahabodhi, Journal of the Mahabodhi Society of India, Calcutta, Nov. Dec. 1931.
- ৩। “বড়ুয়া জাতি” প্রাগুক্ত, পৃ: ২৫।
নিভৃতচারী সদ্ধর্মানুরী বৌদ্ধ ভিক্ষু ব্যক্তিত্ব।