একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে এসে বিশ্ব এক গভীর অস্থিরতার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। ইউক্রেন, গাজা, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা—যুদ্ধ ও সংঘাতের মানচিত্র প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অবিশ্বাস, ঘৃণার ভাষা ও মেরুকরণ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেক বিশ্লেষক প্রকাশ্যেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কার কথা বলছেন। এই উত্তাল বাস্তবতার মধ্যেই ঠিক তখনই আমেরিকার তপ্ত হাইওয়ে আর ব্যস্ত শহরগুলোর বুক চিরে এক নীরব অথচ শক্তিশালী বিপ্লব বয়ে যাচ্ছে। আমেরিকার রাজপথে শুরু হয়েছে এক নীরব অথচ গভীর মানবিক আবেদন—যার কোনো গগণ বিদারী স্লোগান নেই, কোনো অস্ত্র নেই, নেই রাজনৈতিক দাবিদাওয়া। আছে শুধু পা ফেলেই আবেদন জানানোর এক শক্তিশালী ভাষা “Walk for Peace”। ।
টেক্সাসের ফোর্ট ওয়ার্থ থেকে শুরু হওয়া ২,৩০০ মাইল দীর্ঘ এই পদযাত্রার নেতৃত্বে রয়েছেন ভেনারেবল সুথাম নাতিউই (Venerable Sutham Nateetong) এবং তাঁর সঙ্গী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। তাঁদের সঙ্গে রয়েছে এক নীরব সঙ্গী—একটি কুকুর, যার নাম অলকা। এই পদযাত্রা আজ আর কেবল একটি ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক কর্মসূচি নয়; এটি হয়ে উঠেছে বিভক্ত পৃথিবীতে শান্তি, করুণা ও সহমর্মিতার এক জীবন্ত আহ্বান।

২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে যাত্রা শুরুর সময় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন—এই দীর্ঘ হাঁটার বাস্তবিক অর্থ কী? হাজার হাজার মাইল হেঁটে কি যুদ্ধ থামানো যায়? ভিক্ষুদের উত্তর ছিল স্পষ্ট—তাঁরা বাইরের যুদ্ধ থামাতে নয়, সবার আগে মানুষের ভেতরের যুদ্ধ থামাতে চান।
বৌদ্ধ দর্শনের ‘মৈত্রী’ (Loving-kindness) ও ‘করুণা’ (Compassion)-এর চর্চাকে তাঁরা নিয়ে এসেছেন আধুনিক জীবনের রাজপথে। তাঁদের মতে, আজকের মানুষ সবচেয়ে বেশি ভুগছে বিচ্ছিন্নতায়—মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ছিন্ন হচ্ছে, সহনশীলতা হারিয়ে যাচ্ছে। এই পদযাত্রার মাধ্যমে তাঁরা মানুষের সাথে মানুষের সংযোগ পুনর্গঠনের চেষ্টা করছেন।
এই পদযাত্রায় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা চেষ্টা করছেন- রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিভক্ত মার্কিন সমাজে ঐক্যের বোধ জাগানো, ঘৃণা ও সহিংসতার বিপরীতে শান্তির বিকল্প ভাষা তুলে ধরা, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মাইন্ডফুলনেস ও সচেতনতার গুরুত্ব বোঝানো
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের নজরে “Walk for Peace”
যাত্রা শুরুর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এটি আমেরিকার মূলধারার সংবাদমাধ্যমের নজরে আসে। বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেল এবং অনলাইন নিউজ পোর্টাল এই পদযাত্রাকে তুলে ধরছে “Grassroots Peace Movement” ও “Silent Resistance Against Hate” হিসেবে।
ইউরোপ ও এশিয়ার সংবাদমাধ্যমেও বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। অনেক বিশ্লেষক লিখছেন—রাষ্ট্রীয় কূটনীতি যখন ব্যর্থ, তখন ধর্মীয় ও মানবিক উদ্যোগই হয়ে উঠছে শান্তির শেষ আশ্রয়। বিশেষ করে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর গণমাধ্যমে এই পদযাত্রাকে আধুনিক বিশ্বে বৌদ্ধ দর্শনের বাস্তব প্রয়োগ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল শান্তির পদচারণা
মূলধারার সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এই পদযাত্রা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এক্স (সাবেক টুইটার) ও ইউটিউবে #WalkForPeace, #MonksForPeace, #2300MilesForHumanity—এই হ্যাশট্যাগগুলো লক্ষাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষের মোবাইলে ধারণ করা ভিডিও ও ছবি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে পড়ছে। অনেক তরুণ লিখছেন—এই যাত্রা তাদের রাজনীতির বাইরে মানবিকভাবে ভাবতে শেখাচ্ছে। জনপ্রিয় ব্লগ ও পডকাস্টগুলোতে ভিক্ষুদের দর্শন ও অভিজ্ঞতা আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে।
রাজপথে সাধারণ মানুষের অভূতপূর্ব সাড়া
এই পদযাত্রার সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। লুইজিয়ানা থেকে টেনেসি—যে শহর দিয়েই ভিক্ষুরা যাচ্ছেন, সেখানেই তৈরি হচ্ছে আবেগঘন দৃশ্য। শিশু, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ, বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন।
অনেকে ফুল দিচ্ছেন, কেউ পানি ও খাবার এগিয়ে দিচ্ছেন। কোথাও কোথাও স্থানীয় বাসিন্দারা কয়েক মাইল ভিক্ষুদের সঙ্গে হাঁটছেন শুধু সংহতি প্রকাশের জন্য। এই দৃশ্যগুলো আমেরিকার রাজপথে এক বিরল মানবিক মুহূর্ত তৈরি করছে।

শহর প্রশাসন ও মেয়রদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি
ব্যক্তিগত পর্যায়ের ভালোবাসার পাশাপাশি বিভিন্ন শহরের পৌর কর্তৃপক্ষ ও মেয়ররা এই পদযাত্রাকে আনুষ্ঠানিক সম্মান জানাচ্ছেন। সিটি হলগুলোতে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে, পুলিশ বিভাগ ভিক্ষুদের নিরাপত্তা ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা করছে।
মেয়ররা তাঁদের বক্তব্যে বলছেন—এই নীরব পদযাত্রা বর্তমান উত্তাল রাজনৈতিক পরিবেশে সমাজের জন্য এক ধরনের “হিলিং প্রসেস” হিসেবে কাজ করছে। কিছু শহরে প্রতীকীভাবে দিনটিকে ‘শান্তি দিবস’ হিসেবেও পালন করা হয়েছে।

অলকা: শান্তির যাত্রার নীরব নায়ক
এই যাত্রায় ভিক্ষুদের পাশাপাশি যাকে ঘিরে মানুষের আবেগ —সে হলো অলকা। শান্ত স্বভাবের এই কুকুরটি ধীরে ধীরে “Walk for Peace”-এর এক অবিচ্ছেদ্য প্রতীকে পরিণত হয়েছে। শিশুদের কাছে সে আনন্দের উৎস, আর প্রাপ্তবয়স্কদের কাছে এক আশ্চর্য মানসিক প্রশান্তির প্রতীক।
অনেকেই প্রথমে অলকার দিকে এগিয়ে আসেন। তাকে আদর করেন, ছবি তোলেন, তার গল্প জানতে চান। অলকা যেন এই যাত্রার হৃদস্পন্দন।

আজ যে অলকাকে শান্তির প্রতীক হিসেবে দেখা যাচ্ছে, তার পেছনে রয়েছে এক করুণ ইতিহাস। অলকার জন্ম ভারতের রাস্তায়—একটি আশ্রয়হীন পথকুকুর হিসেবে। জীবনের শুরু থেকেই তাকে অনাহার, অবহেলা ও নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
ভিক্ষুদের ভাষ্য অনুযায়ী, অলকাকে যখন প্রথম দেখা যায়, তখন তার শরীরে ছিল ক্ষত, চোখে ছিল ভয়। মানুষের প্রতি তার কোনো বিশ্বাস ছিল না। ঠিক তখনই ভিক্ষুরা তাকে আশ্রয় দেন—কোনো উদ্দেশ্য নয়, কেবল করুণার হাত বাড়িয়ে।
নিয়মিত খাবার, যত্ন আর ভালোবাসায় অলকার শরীরের ক্ষত যেমন সেরে ওঠে, তেমনি সেরে ওঠে তার ভেতরের ভয়। সে হয়ে ওঠে সহযাত্রী—কোনো শিকল ছাড়াই, কোনো বাধ্যবাধকতা ছাড়াই।
এই দীর্ঘ যাত্রায় অলকার সুস্থতা নিয়ে স্থানীয় মানুষের দায়িত্ববোধ চোখে পড়ার মতো। বিভিন্ন শহরে পশুপ্রেমীরা স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসে তার খাবার, বিশ্রাম ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। কোথাও বিনা খরচে ভেটেরিনারি ক্লিনিকে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে।
এই সেবা অলকাকে ঘিরে মানুষের করুণা ও সহমর্মিতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
ফেসবুকে “Aloka the Peace Dog”
অলকার জনপ্রিয়তা সোশ্যাল মিডিয়াতেও বিস্তৃত। তাকে কেন্দ্র করে তৈরি ফেসবুক পেইজ “Aloka the Peace Dog” অল্প সময়েই বিপুল অনুসারী পেয়েছে। এখানে নিয়মিত অলকার ছবি, ভিডিও ও পথচলার গল্প প্রকাশ করা হচ্ছে।
অনেক অনুসারী লিখছেন—অলকা তাদের মানসিকভাবে শক্তি জোগাচ্ছে। কেউ কেউ তাকে “Peace Ambassador on Four Legs” বলেও আখ্যা দিচ্ছেন।

ফেব্রুয়ারি ২০২৬: ওয়াশিংটন ডি.সি.-তে সমাপ্তি
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটন ডি.সি.-তে এই ঐতিহাসিক যাত্রার সমাপ্তি হওয়ার কথা রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক উত্তাপে গরম রাজধানীতে এই নীরব উপস্থিতি নীতিনির্ধারকদের মনেও মানবিকতার প্রশ্ন তুলবে।
“Walk for Peace” আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শান্তি কোনো আদেশ নয়, এটি এক সাধনা। টেক্সাস থেকে ওয়াশিংটন পর্যন্ত গেরুয়া বসনের এই দীর্ঘ ছায়া আজ শুধু আমেরিকার নয়—সমগ্র বিশ্বের জন্য এক মানবিক আহ্বান।
আর অলকা—ভারতের রাস্তায় জন্ম নেওয়া সেই অবহেলিত পথকুকুর—প্রমাণ করে দিয়েছে, ভালোবাসা ও করুণা পেলে যে কোনো প্রাণীই শান্তির দূত হয়ে উঠতে পারে।
ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এ ওয়াশিংটন ডি.সি.-তে এই মহতী যাত্রার সমাপ্তি ঘটার কথা । রাজধানী শহরটি যখন রাজনৈতিক উত্তাপে গরম থাকে, তখন এই ভিক্ষুদের আগমন সেখানে একটি ভিন্ন বার্তা দেবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। হোয়াইট হাউসের সামনে বা ক্যাপিটল হিলের আশেপাশে তাঁদের উপস্থিতি আমেরিকান নীতিনির্ধারকদের মনেও মানবিকতার আবেদন তৈরি করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

“Walk for Peace” আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, শান্তি ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার মতো কিছু নয়; এটি আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়ের ভেতর থেকে জাগ্রত করতে হয়। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা যখন টেক্সাস থেকে ওয়াশিংটন পর্যন্ত মাইলের পর মাইল হাঁটছেন, তাঁরা আসলে প্রতিটি মানুষের মনের বদ্ধ দুয়ারে কড়া নাড়ছেন। আমেরিকার রাজপথে আজ যে গেরুয়া বসনের ছায়া পড়ছে, তা যেন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য এক পরম শান্তির ছায়া হয়ে দাঁড়ায়।
অশান্ত বিশ্বে শান্তির এই মশাল নিয়ে ভিক্ষুদের এই পদযাত্রা ইতিহাসের পাতায় এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এটি কেবল বৌদ্ধধর্মের জয় নয়, এটি মানবতার জয়।

প্রকাশক ও সম্পাদক, ধম্মইনফো-ডট-কম
