বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারার অভিযোগ এনে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছন। তবে তার এই পদত্যাগ শুধুমাত্র প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতার কারণে নয়; এটি আদিবাসীদের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোর একটি দৃঢ় বার্তা বহন করে।
সৈয়দ জামিল আহমেদের বক্তব্য: ন্যায়বিচারের আহ্বান
পদত্যাগের পর মি. আহমেদ বলেন, “আমাকে যে বলতে বাধা দিয়েছিল যে- আমরা আদিবাসী কথাটা বলতে পারবো না। আমি আজকে বলছি, আদিবাসীদের বিরুদ্ধে… আদিবাসীদের দাবি পূর্ণ হোক, তাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন বন্ধ হোক, তাদের অধিকার অর্জিত হোক। আমি একইসাথে চাই বৈষম্যহীন বাংলাদেশ কায়েম হোক।”
এই বক্তব্য শুধু একটি ব্যক্তিগত প্রতিবাদ নয়, বরং এটি দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতি চলমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি সোচ্চার কণ্ঠস্বর। আদিবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অবহেলা দীর্ঘদিনের বাস্তবতা, এবং এটি শুধুমাত্র নীতিগত নয়, সাংস্কৃতিকভাবেও এক গভীর সমস্যা।
আদিবাসীদের অধিকার ও রাষ্ট্রীয় বাধা
বাংলাদেশের সংবিধানে ‘আদিবাসী’ শব্দটির ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বেশ কয়েকবার রাষ্ট্রীয়ভাবে আদিবাসীদের ‘উপজাতি’ বা ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে উল্লেখ করার চেষ্টা করা হয়েছে, যা তাদের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করার একটি পন্থা বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।
সৈয়দ জামিল আহমেদ তার বক্তব্যের মাধ্যমে এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছেন। আদিবাসীদের স্বীকৃতি এবং তাদের প্রতি চলমান বৈষম্যের অবসান চেয়ে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা স্বাধীন মতপ্রকাশের একটি বড় দৃষ্টান্ত।
অতি সম্প্রতি, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ঢাকার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সামনে ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’র শান্তিপূর্ণ মিছিলে হামলার ঘটনা ঘটে। এই হামলা স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারকে লঙ্ঘন করে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মুক্ত চিন্তার সংকট
শিল্পকলা একাডেমির মতো একটি প্রতিষ্ঠান, যা দেশের সাংস্কৃতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সেখানে একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বকে তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থেকে বিরত রাখা কেবল একজন ব্যক্তির সমস্যা নয়—এটি পুরো সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সংকটের প্রতিফলন। রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে শিল্প ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে স্বাধীন চিন্তার উপর যে অপ্রকাশিত নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান, তা দেশীয় সৃজনশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাশা
সৈয়দ জামিল আহমেদ তার বক্তব্যে শুধুমাত্র আদিবাসীদের অধিকারের পক্ষে কথা বলেননি, বরং একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠনের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেছেন। এই বক্তব্য একটি বহুমাত্রিক সামাজিক সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করে, যেখানে নির্দিষ্ট কিছু জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামোর মাধ্যমে পেছনে ফেলে রাখা হয়।
একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও সমতা ভিত্তিক সমাজের জন্য এই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং সমাধান করা অপরিহার্য। রাষ্ট্রের উচিত আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া, তাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং জমির অধিকার রক্ষা করা। পাশাপাশি, প্রশাসনিক কাঠামোর এমন সংস্কার প্রয়োজন, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে।
সৈয়দ জামিল আহমেদের পদত্যাগ নিছক কোনো ব্যক্তিগত পদক্ষেপ নয়, বরং এটি আদিবাসী স্বীকৃতি ও অধিকারের লড়াইয়ের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। তার এই অবস্থান সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে একটি সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নেবে। এখন সময় এসেছে রাষ্ট্র, সমাজ ও সংস্কৃতি অঙ্গনের সকল স্তর থেকে এই লড়াইয়ে সংহতি প্রকাশ করার এবং সত্যিকারের বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠনের জন্য উদ্যোগ নেওয়ার।

প্রকাশক ও সম্পাদক, ধম্মইনফো-ডট-কম