বাংলাদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর চলমান সহিংসতা এবং বৈষম্যমূলক আচরণ একটি গভীর মানবাধিকার সংকটের ইঙ্গিত। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, মাত্র সাড়ে চার মাসে ১৭৪টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় ২৩ জন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু হত্যার শিকার হয়েছেন। নারীদের উপর নির্যাতন, উপাসনালয়ে হামলা, বাড়িঘর দখল, ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গ্রেপ্তার, রাষ্ট্রীয় চাকরিতে বৈষম্য—এই সবই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ এক ভয়াবহ অস্তিত্ব সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এই বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫ এক সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
সংখ্যালঘুদের উপর দমন-পীড়ন ও সহিংসতা
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২১ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ৬৪টি উপাসনালয়ে হামলা, ৩৮টি বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যা স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারের উপর সরাসরি আঘাত।
এই সহিংসতা নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি একটি সুপরিকল্পিত নীতির অংশ, যেখানে সংখ্যালঘুদের সম্পদ, ধর্মীয় অধিকার ও মানবিক মর্যাদা হরণ করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী এবং প্রশাসনের ভূমিকা এক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ।
রাষ্ট্রীয় বৈষম্য ও নিপীড়ন
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের তথ্য অনুযায়ী,সংখ্যালঘু নিপীড়নের আরেকটি ভয়াবহ রূপ দেখা যায় সরকারি চাকরিতে সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণে। তথ্য বলছে, ৪০তম ক্যাডেট সাব-ইন্সপেক্টর পদ থেকে চাকরিচ্যুতদের মধ্যে ১০৩ জন সংখ্যালঘু। ৪৩তম বিসিএসে ২২৭ জনকে বাদ দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৮২ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। এমনকি ৫৫ জন নারী কর্মকর্তার মধ্যে ১৬ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য, যারা চাকরিচ্যুত হয়েছেন।
এটি কি নিছক কাকতালীয় ঘটনা, নাকি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংখ্যালঘুদের ধীরে ধীরে প্রশাসনিক কাঠামো থেকে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া? এই বৈষম্যমূলক আচরণ সংবিধানের মূল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
ঐক্য পরিষদ দাবি করেছে, চলমান সহিংসতা এবং বৈষম্য কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং এটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সংখ্যালঘু নিঃস্বকরণের ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের অংশ। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, গ্রেপ্তার, চাকরিচ্যুতি, বাড়িঘর দখল—সব মিলিয়ে এটি একটি সুপরিকল্পিত কৌশল, যাতে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে ক্রমাগত দুর্বল করে ফেলা যায়।
ঐক্য পরিষদের মতে, সরকার বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নীতি বাদ দেওয়ার পরিকল্পনাও এই বৈষম্যকে আরও গভীর সংকটে ঠেলে দিচ্ছে।
কী করণীয়?
বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর এই ভয়াবহ পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে হলে রাষ্ট্রকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে:
- সহিংসতা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ: সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধীদের শাস্তি না দিলে এ ধরনের অপরাধ আরও বাড়বে।
- রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করা: নিয়োগ ও চাকরিচ্যুতির ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ করতে হবে।
- উপাসনালয় ও সম্পত্তির সুরক্ষা: সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
- আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা: সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করতে সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষা প্রদান করা জরুরি। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা: রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে সংখ্যালঘুদের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
বাংলাদেশ একটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত দেশ, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শই ছিল মূল ভিত্তি। অথচ আজ সেই আদর্শ বিপন্ন। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, রাষ্ট্রীয় বৈষম্য এবং রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য এক ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি করেছে।
যদি এই নির্যাতন ও বৈষম্য বন্ধ করা না হয়, তবে এটি কেবল সংখ্যালঘুদের জন্য নয়, বরং গোটা জাতির জন্য একটি অশুভ সংকেত। তাই এখনই সময় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা এবং একটি সহনশীল ও সাম্যের সমাজ গঠনের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার। রাষ্ট্র যদি সংখ্যালঘুদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়, তবে এর পরিণতি ভয়াবহ হবে, যা দেশকে আরও গভীর সামাজিক সংকটে ফেলে দেবে।
![dhammabiriya ধম্মবিরীয়](https://dhammainfo.com/wp-content/uploads/2024/04/aaja.jpg)
প্রকাশক ও সম্পাদক, ধম্মইনফো-ডট-কম