বিশ্ব ইতিহাসে এমন অনেক মহান ব্যক্তি আছেন, যারা নিরলস পরিশ্রম এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে মানবতার কল্যাণে নিজেদের নিবেদন করেছেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার, চর্চা এবং শিক্ষা প্রসারে শ্রীলংকার জন্মজাত হেনেপলা গুনারত্ন মহাথের ঠিক তেমনই এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তার জীবন কাহিনী একদিকে যেমন প্রেরণার উৎস, অন্যদিকে তেমনি তার কর্মজীবন আমাদের মনুষ্যত্ববোধ এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ দেখায়।
শৈশব ও সন্ন্যাসজীবনের শুরু
১৯২৭ সালের ৭ ডিসেম্বর শ্রীলংকার হেনেপলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হেনেপলা গুনারত্ন। শিশুকাল থেকেই তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হন। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন এবং ধর্মীয় শিক্ষা অর্জনে মনোনিবেশ করেন। এরপর ২০ বছর বয়সে তিনি ভিক্ষু হিসেবে দীক্ষা নেন এবং শীল, সমাধি, ও প্রজ্ঞার চর্চা শুরু করেন।
বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে প্রথম পদক্ষেপ
গুনারত্ন মহাথের প্রথমে ভারত ও মালয়েশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি দশ বছর ধরে এই দেশগুলিতে ধর্মপ্রচার করেন, যেখানে তিনি বুদ্ধের অহিংসার বাণী, সমতা, এবং করুণার বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। এরপর, ১৯৬৮ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগমন করেন। আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসি বৌদ্ধ বিহারের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শিক্ষা ও জ্ঞান সাধনা
ওয়াশিংটন ডিসি বৌদ্ধ বিহারে অবস্থানকালে গুনারত্ন মহাথের আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়ন করেন। তিনি গভীর পাণ্ডিত্যের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের দর্শন এবং চর্চার মূলতত্ত্ব অর্জন করেন। এ সময় তিনি আমেরিকান সমাজের সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক চাহিদা অনুধাবন করেন এবং ধ্যান চর্চার মাধ্যমে তাদের মানসিক প্রশান্তি ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন।
ভাবনা সোসাইটি: ধ্যানচর্চার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা
১৯৮৫ সালে, তিনি পশ্চিম ভার্জিনিয়ার গভীর মহাঅরণ্যে ৪৮ একর জমির ওপর একটি মেডিটেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজ ভাবনা সোসাইটি নামে পরিচিত। এই সোসাইটি মানবকল্যাণে নিবেদিত একটি প্রতিষ্ঠান। এখানে ধ্যান, শীল, সমাধি এবং প্রজ্ঞার অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষকে অহংকার, হিংসা, এবং ক্রোধের মতো মানসিক অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করা হয়।
গুনারত্ন মহাথের প্রতিদিন ধ্যানচর্চার মাধ্যমে তার অনুসারীদের শিখিয়ে থাকেন কীভাবে একাগ্রচিত্তে ধ্যানের মাধ্যমে নিজেকে উন্নত করা যায়। তার মতে, মনকে শুদ্ধ করার মাধ্যমে মানুষ তার অভ্যন্তরীণ অহংকার, হিংসা এবং কাম প্রবৃত্তি থেকে মুক্তি পায় এবং এক মহত্তর জীবনের সন্ধান পায়।
প্রকাশিত গ্রন্থ
গুনারত্ন মহাথেরের আধ্যাত্মিক শিক্ষা শুধু আমেরিকাতেই সীমাবদ্ধ নয়; তার লেখা বই এবং প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত। তার রচিত গ্রন্থগুলো বৌদ্ধ দর্শনের সহজ এবং প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা প্রদান করে।
তাঁর কিছু বিখ্যাত বই হলো:
- “Bhavana Vandana: Devotions for Meditation”: প্রতিদিনের বন্দনা এবং ধ্যানের জন্য পালি ও ইংরেজিতে প্রার্থনার বই।
- “Mindfulness in Plain English”: ধ্যানের একটি সহজবোধ্য নির্দেশিকা।
- “Eight Mindful Steps to Happiness”: বুদ্ধের শিক্ষার ব্যবহারিক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা।
- “The Jhanas in Theravada Buddhist Meditation”: গভীর ধ্যান অবস্থার সরল ব্যাখ্যা।
- “The Path of Serenity and Insight”: গভীর ধ্যানের বিস্তৃত আলোচনা।
- “Beyond Mindfulness in Plain English”: আধুনিক জীবনে ধ্যানের প্রাসঙ্গিকতা।
- “Journey to Mindfulness: The Autobiography of Bhante Gunaratana”: ভান্তে গুনারত্ন মহাথেরের আত্মজীবনী।
সমাজকল্যাণে অবদান
গুনারত্ন মহাথের কেবল আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক নন, বরং একজন মানবহিতৈষী। তিনি ২০০৫ সালে শ্রীলংকায় নিজের নামে একটি বৃত্তি ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন, যা দরিদ্র শিশুদের শিক্ষা লাভে সহায়তা করে। তার এই উদ্যোগ দেখায়, মানবকল্যাণের প্রতি তার অঙ্গীকার কেবল আধ্যাত্মিক স্তরে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামাজিক ক্ষেত্রেও গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
১৯৯৬ সালে, তিনি উত্তর আমেরিকার প্রধান সংঘনায়ক (Nayaka) উপাধিতে ভূষিত হন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ সন্ন্যাসী আসনে সমাসীন হন। ২০০৩ সালে প্রকাশিত তার আত্মজীবনী, “Journey to Mindfulness”, বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে।
হেনেপলা গুনারত্ন মহাথেরের জীবন একটি দৃষ্টান্ত, যা প্রমাণ করে যে বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষাগুলো আজকের পৃথিবীতে কতটা প্রাসঙ্গিক এবং কার্যকর। তার প্রতিষ্ঠিত ভাবনা সোসাইটি এবং তার লেখাগুলো মানবতার জন্য এক অমূল্য সম্পদ। শ্রীলংকার এক ছোট গ্রাম থেকে শুরু করে আমেরিকার মহাঅরণ্যে একটি আধ্যাত্মিক কেন্দ্র গড়ে তোলা পর্যন্ত তার যাত্রা এক অনুপ্রেরণার গল্প।
তিনি তার কর্ম ও শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের শিখিয়েছেন, কীভাবে শীল, সমাধি এবং প্রজ্ঞার চর্চা করে আমরা আমাদের জীবনকে আরও পরিপূর্ণ, শান্তিপূর্ণ এবং সার্থক করে তুলতে পারি। তার জীবন এবং অবদান যুগ যুগ ধরে মানবতার কল্যাণে আলো জ্বালাবে।
- তথ্য সহায়তায়: ভিক্ষু গুনারত্ন মহাথের,প্রতিষ্ঠাতা:ভাবনা সোসাইটি, (মেডিটেশন সেন্টার ) ভার্জিনিয়া,আমেরিকা।
বাপ্পা বড়ুয়া জয় একজন সমাজ ও সদ্ধর্মে নিবেদিত আমেরিকা প্রবাসী তরুণ সমাজকর্মী। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় জন্মগ্রহণ করা জয়, প্রবাসে থেকেও তার নিজ সমাজের উন্নয়ন ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে ধম্মইনফোর সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন।
Keep it up your good work for community.