একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি হলো এর প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার ও নিরাপত্তা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষা ও তাদের অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের একটি প্রধান দায়িত্ব। বাংলাদেশের সংবিধান স্পষ্টভাবে এই অধিকারগুলো রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু যখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তখন শুধুমাত্র মৌখিক সমর্থন বা আশ্বাস যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন বাস্তব পদক্ষেপ, আইনের সঠিক প্রয়োগ, এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠার।
সম্প্রতি রাজধানীতে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে ইসলামী আলোচক শায়খ আহমাদুল্লাহ এবং অন্যান্য ধর্মীয় নেতারা সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় ঐক্যবদ্ধ থাকার বার্তা দিয়েছেন। একই বৈঠকে বৌদ্ধ, হিন্দু এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরাও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও বিচার নিশ্চিত করার কথা তুলে ধরেছেন। এ ধরনের উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও প্রশ্ন থেকে যায়, এসব বৈঠক ও বার্তা বাস্তবে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে।
সংবিধানের ভাষা ও বাস্তব চিত্র
বাংলাদেশের সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে সমান অধিকার দিয়েছে। সংবিধানের ২৮ ও ৪১ নম্বর অনুচ্ছেদে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্বাধীনতা, সংস্কৃতি চর্চার অধিকার, এবং বৈষম্যহীন পরিবেশে বসবাসের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। তবে বাস্তবে সংখ্যালঘুদের অধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার ঘটনা প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে। মন্দির ভাঙচুর, জমি দখল, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, কিংবা নিপীড়নের ঘটনা প্রমাণ করে যে, কেবল সংবিধানই নয়, এর কার্যকর প্রয়োগেও ঘাটতি রয়েছে।
মৌখিক আশ্বাস নয়, প্রয়োজন বাস্তব পদক্ষেপ
ধর্মীয় নেতারা বারবার সংখ্যালঘুদের রক্ষার বার্তা দিলেও বাস্তবতা হলো, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়ার মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বা নেতৃত্বে এটি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এমনকি যখন কেউ এই বিষয়ে জনসম্মুখে বার্তা দেন, তখন এটি স্পষ্ট হতে হবে যে, এটি কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের দয়া নয়, বরং রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সংখ্যালঘুরা নাগরিক হিসেবে তাদের প্রাপ্য অধিকারই দাবি করছে।
রাষ্ট্রের করণীয়
রাষ্ট্রকে অবশ্যই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য একটি নিরাপদ এবং মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে:
- বিচারের সুনিশ্চিতকরণ: সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধগুলোর দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা।
- আইনের কঠোর প্রয়োগ: ধর্মীয় উসকানি, জমি দখল, বা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মতো ঘটনাগুলোতে শাস্তি কার্যকর করা।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি এবং শিক্ষার মাধ্যমে সহনশীলতা বৃদ্ধি।
- সমান সুযোগ নিশ্চিত করা: শিক্ষা, চাকরি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও সংখ্যালঘুদের জন্য সমান সুযোগ রাখা।
শেষ কথা
আহমাদুল্লাহ বা অন্যান্য ধর্মীয় নেতাদের বার্তা ভালো উদ্দেশ্য বহন করলেও এটি একটি সাময়িক আশ্বাস মাত্র। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় স্তরে শক্ত পদক্ষেপ। আমাদের মনে রাখতে হবে, সংখ্যালঘুরা সমাজের কোনো আলাদা অংশ নয়; তারা এই দেশেরই নাগরিক। তাদের সুরক্ষা দেওয়া কোনো অনুগ্রহ নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব।
আসুন, আমরা এমন একটি সমাজ গড়ে তুলি যেখানে সংখ্যালঘুরা নিজের পরিচয়ে গর্বিত এবং নিরাপদে বসবাস করতে পারে। সংখ্যালঘুরা মন্দিরের ঘণ্টা নয়, যে কেউ এসে বাজিয়ে যাবে। তারা দেশের সমান অধিকারপ্রাপ্ত নাগরিক, যাদের সুরক্ষা রাষ্ট্রীয় কাঠামোরই অংশ।
প্রকাশক ও সম্পাদক, ধম্মইনফো-ডট-কম