কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী দক্ষিণ হ্নীলা বড় বৌদ্ধ বিহার, যা প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো, দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে দখলের শিকার। গত ১৪ বছর দখলদারের থাবায় বিহারটি এখন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বিহারটির অধিকাংশ জায়গার পাশাপাশি নানা স্থাপনা বেদখল হওয়ায় আচার-অনুষ্ঠানসহ এখন কোনো কার্যক্রম নেই।একসময় বিহারটিতে পুরোনো সভ্যতার নিদর্শন ও ১৯টি বুদ্ধমূর্তি থাকলেও এখন ক্ষত চিহ্নেরও দেখা মেলে না। তবে বিহারটিতে বর্তমানে একটি ছোট্ট টিনঘরে ২টি বুদ্ধমূর্তির অংশবিশেষ এখনও রয়েছে। যা প্রমাণ করে একসময় এখানে সুপরিসর জায়গাজুড়ে একটি বৌদ্ধবিহারের অস্তিত্ব ছিল। দলিল-দস্তাবেজসহ সংশ্লিষ্ট তথ্য মতে, বিহারের ১৩ একর জায়গার মধ্যে বর্তমানে ২টি মূর্তি ঘিরে মাত্র দুই একর জায়গা অবশিষ্ট রয়েছে। দখল হয়েছে অপর ১১ একর জায়গা। বিহারের কাজে একসময় ব্যবহৃত পুকুরটিও এখন অন্যের দখলে। যেখানে চলছে মাছ চাষও।
বিহারের প্রতি অবৈধ দখলদারিত্ব ও প্রভাবশালী মহলের আধিপত্য নিয়ে সম্প্রতি নাগরিক সমাজ ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের মাঝে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
বৌদ্ধবিহার রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ও আদিবাসী ফোরাম কক্সবাজার জেলা কমিটির সহসভাপতি ক্যা জ অং গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, গত ১৪ বছর ধরে সরকারের একাধিক তদন্ত কমিটি জমির ধরন ও পরিমাণ চিহ্নিত, সীমানা নির্ধারণ, সুনির্দিষ্ট দখলদারদের তালিকা করে তাদের উচ্ছেদ করার সুপারিশ করে। তদন্তের আলোকে উচ্ছেদ করে বিহারের ভূমি পরিচালনা কমিটির কাছে হস্তান্তরে জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা থাকলেও সংশ্লিষ্টদের পদক্ষেপ ছিল না। ফলে এখন প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে পুরো জায়গা।
ক্যা জ অং আরও বলেন, ‘বর্তমানে বিহারের আশপাশে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন যেতেও ভয় পায়। সর্বশেষ উচ্ছেদ মামলার আদেশে জায়গাটি উদ্ধারে ৩ মার্চ জেলা প্রশাসনকে লিখিত জানানো হয়। কিন্তু উদ্যোগ এখনও নেওয়া হয়নি।’
প্রতিনিধি দলের পরিদর্শন
গত বৃহস্পতিবার বিহারটি পরিদর্শন করেন ঢাকার একটি নাগরিক প্রতিনিধি দল। দলে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা। তাদের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
পরিদর্শনের সময় বিহারের ভেতরে দীর্ঘদিন পর প্রার্থনার সুযোগ পান বৌদ্ধ ভিক্ষু মাও টিংসহ অন্যান্য ভক্তরা। নাগরিক প্রতিনিধি দল এই দখলের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
অতীতের প্রভাবশালী দখলদারিত্বের অভিযোগ
২০০১ সালে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ও কক্সবাজার-৪ আসনের এমপি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে বিহারের পুরোহিতের মধ্যে একটি জমি ব্যবহারের চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, তিনি বিহারের জমিতে গাছ রোপণ করবেন এবং এর থেকে অর্জিত লাভ সমানভাবে ভাগাভাগি করা হবে। তবে বিহার কর্তৃপক্ষের দাবি, এই চুক্তি বিহারের জন্য ক্ষতিকর ছিল এবং এটি দখলের একটি কৌশলমাত্র।
২০০৯ সালে মোহাম্মদ আলীর মৃত্যুর পর তার ছেলেরা বিহারটির জমি অবৈধভাবে দখলে নিয়ে সেখানে আম গাছ রোপণ করেন। দখলদারদের প্রভাব এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, বিহার কর্তৃপক্ষ আদালতে রায় পাওয়ার পরও জমি পুনরুদ্ধার করতে পারেনি।
এই বিহার নিয়ে অতীতে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট বিহারটিতে মুখোশধারী কিছু ব্যক্তি হানা দেন। তারা বিহারের পুরোহিতকে ( অধ্যক্ষ ভান্তে) হুমকি দিলে তিনি পালিয়ে যান। ওই দিন বিহারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু মালামাল লুট হয়।
প্রতিবেদনটি সূত্রে বলা যায়, মূলত ওই দিন থেকেই বিহারটি দখল বা নিশ্চিহ্ন হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুরোহিত পালিয়ে যাওয়ার পর প্রাণের ভয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কেউ বিহারে আসেননি। ওই দিন বিহারের মালামাল লুট হওয়ার পাশাপাশি বিহারের বড় বড় কিছু গাছও দখলদারের লোকজন কেটে নিয়ে যায়। এর মধ্যে বিহারের সঙ্গে উধাও হয়ে গেছে বিহারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা বৌদ্ধ পল্লীটিও। বদলে গেছে গ্রামের নাম।
২০১২ সালে স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে বিহারের জমি দখল নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বিহারের পুরোহিত এবং স্থানীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায় অভিযোগ করেন যে, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। ২০১৭ সালে দক্ষিণ হ্নীলা বড় বৌদ্ধ বিহার এবং আশেপাশের গ্রামগুলো সাম্প্রদায়িক হামলা ও ভয় প্রদর্শনের শিকার হয়। স্থানীয় বৌদ্ধরা অভিযোগ করেন, তাদের ভূমি ও সম্পত্তি রক্ষায় প্রশাসন কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি। সেই সময়ও বিহারের জমি নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ২০২১ সালে নাগরিক উদ্যোগের পক্ষ থেকে একটি জাতীয় পর্যায়ের প্রতিনিধি দল বিহারের পরিস্থিতি নিয়ে তদন্ত চালায়। প্রতিনিধি দল সেই সময়, সরকারের কাছে দাবি করেছিল, আদালতের রায় দ্রুত কার্যকর করে বিহারটির ঐতিহ্য রক্ষা করার জন্য। কিন্তু ক্ষমতাশীল আওয়ামী লীগ সরকারের লোক হওয়ার কারণে আদালতের রায়ও কার্যকর হয়নি।
বর্তমান পরিস্থিতি ও সুপারিশ
সম্প্রতি বিহারটি পরিদর্শন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসাসহ অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তি।
তারা জানিয়েছেন, বিহারের জমি দখলের ঘটনাটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয়, হতাশা এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। আদালতের রায় থাকা সত্ত্বেও প্রভাবশালী মহল দখলদারিত্ব অব্যাহত রাখায় স্থানীয় বৌদ্ধরা তাদের ঐতিহ্য এবং অধিকার নিয়ে শঙ্কিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দীপায়ান খীসার নেতৃত্বে ১০ সদস্য পরিদর্শনকালে বিহারটির জায়গা দ্রুত উদ্ধার করে বিহার পুনর্নিমাণের দাবি জানান।
ঐতিহ্য রক্ষার আহ্বান
দক্ষিণ হ্নীলা বড় বৌদ্ধ বিহার শুধু একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, এটি স্থানীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ২০০ বছরের অধিক পুরনো ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতীক। নাগরিক সমাজ, স্থানীয় প্রশাসন, এবং সরকারের সমন্বয়ে বিহারটির অবৈধ দখলদারিত্ব অবিলম্বে শেষ করতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। দখলদারদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা না নিলে এটি স্থানীয় আদিবাসী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে আরও হতাশা এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করবে।
তারা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন, আদালতের রায় দ্রুত কার্যকর করে বিহারটি অবৈধ দখলমুক্ত করা হোক এবং বিহারের ঐতিহ্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হোক।
স্বপ্ন এবং দায়িত্ববোধ থেকে ধম্মইনফো-ডট-কম এর সূচনা। ২০১১ সালে বাংলায় প্রথম অনলাইন বৌদ্ধ সংবাদ পোর্টাল হিসেবে ধম্মইনফো যাত্রা শুরু করে, যা বৌদ্ধধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং নীতিমালা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রচারে পাঠকের ব্যাপক গ্রহণ যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। ২০১২ সালে রামুতে মৌলবাদী হামলার পর এটি একটি শক্তিশালী সংবাদ মাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তর বাংলা ভাষী বৌদ্ধদের কাছে পরিচিতি লাভ করে। যদিও নিরাপত্তাজনিত কারণে ২০১৮ সালে সাইটটি প্রকাশনা বন্ধ করা হয়, ২০২৪ সালে ধম্মবিরীয় ভিক্ষুর নেতৃত্বে এটি আবার চালু হলে ধম্মইনফো বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার, বাংলাদেশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে সংবাদ, ঐতিহাসিক নিদর্শন, মণিষীদের জীবনী প্রকাশ, এবং ধর্মীয় উন্নয়নে কাজ করছে