চট্টগ্রাম নগরীর হাজারী গলিতে ইসকন নিয়ে বিতর্কিত একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় অন্তত ৮২ জনকে আটক করেছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি)। ঘটনার পর থেকে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর যৌথ বাহিনী ঘটনাস্থলে টহল দিচ্ছে। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সব ধরনের পদক্ষেপের কথা বলা হলেও সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা ও নিপীড়নের অভিযোগ স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।
ঘটনার পটভূমি
স্থানীয়রা বলছেন, হাজারী গলির মিয়া শপিং সেন্টারে প্রায় দেড়শর মতো হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ জুয়েলারি ব্যবসা করে। সেখানেই জুয়েলারি বাক্স, মালা, মালায় ব্যবহৃত স্টোন এবং রূপার ব্যবসা করে এক মুসলিম ব্যবসায়ী।
তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের ইসকনকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ উল্লেখ করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেয়ার পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ওই এলাকার হিন্দুদের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা তৈরি হয়।
পোস্টটি প্রকাশের পরপরই ওই এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। হাজারী গলিতে প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের জুয়েলারি ব্যবসায়ী রয়েছেন এবং তাঁরা ওই পোস্টটিকে সরাসরি তাদের ধর্ম ও সংগঠনের প্রতি আক্রমণ হিসেবে দেখেন। উত্তেজনার এক পর্যায়ে এলাকার বেশ কিছু লোকজন ওই ব্যবসায়ীকে ঘিরে ফেলে এবং তার দোকানের সামনে অবস্থান নেয় ।বিক্ষুব্ধ লোকজন দোকানের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। স্থানীয়রা বিক্ষোভকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলে পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে খবর দেয়া হয়।
যৌথ বাহিনীর অভিযান ও সংঘর্ষ
ঘটনার বিবরণে জানা গেছে, পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর ফেসবুক পোস্টের জবাবদিহিতা চেয়ে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করতে চেষ্টা করে। তবে এক পর্যায়ে জনতার মধ্যে বিক্ষোভ বাড়তে থাকে এবং যৌথ বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য লাঠিচার্জ শুরু করে। এসময় উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে এবং জুয়েলারি দোকানে ব্যবহৃত এসিড এবং অন্যান্য জিনিস যৌথ বাহিনীর উপর নিক্ষেপ করা হয়।
যৌথ বাহিনীর বিবৃতি
এক সংবাদ সম্মেলনে যৌথ বাহিনীর মুখপাত্র লে. কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ বলেন, “অভিযানের সময় কিছু বিক্ষোভকারী যৌথ বাহিনীর উপর এসিড নিক্ষেপ করেছে এবং ইট পাটকেল ছুঁড়েছে, যাতে আমাদের বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছেন। এই ঘটনাটি অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং আমরা ঘটনার সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করার কাজ করছি।”
ইসকন ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
ইসকন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এটি একটি অরাজনৈতিক সংগঠন এবং এটি বিশ্বজুড়ে বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার ও প্রসার করে। আমাদের দেশে ইসকন সবসময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে কাজ করেছে, কিন্তু ইদানীং আমাদের বিরুদ্ধে কিছু ভিত্তিহীন এবং বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চলছে।” তিনি আরও বলেন যে এই ধরনের প্রচারণা শুধু ইসকনকে নয়, বাংলাদেশের সামগ্রিক ভাবমূর্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম জুয়েলারি এসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক কাজল বণিক বলেন, “যদি আমাদের ধর্মীয় সংগঠনকে আক্রমণ করা হয়, তবে আমাদের ক্ষোভ হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওই রাতের অভিযানে নির্বিচারে মানুষজনকে মেরে ফেলা হয়েছে এবং দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।”
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উদ্বেগ ও প্রতিকার দাবি
এই ঘটনার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং নির্যাতনের সুষ্ঠু তদন্তের দাবি তোলা হয়েছে। সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র কাঞ্চন আচার্য বলেন, “এটি একটি পরিকল্পিত প্রচারণা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণের প্রতিফলন। সরকারের উচিত এই ঘটনাগুলির সঠিক তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা।”
সম্প্রতি ইসকনের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ ও জনমত
গত মাসে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশাল এক সমাবেশে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইনের দাবি তোলা হয়। এই সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা সংখ্যালঘুদের উপর হামলা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলেন। উল্লেখ্য, সমাবেশের পর ইসকনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পক্ষ থেকে অভিযোগ আসতে থাকে। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ইসকনকে “সাম্প্রদায়িক ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর সংগঠন” বলে উল্লেখ করেন, যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্ব
এই ঘটনায় জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসন ও সরকারকে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যৌথ বাহিনীকে মাঠে নামানো হলেও, হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এবং নিরাপত্তা বৃদ্ধির দাবি তীব্রতর হয়েছে।
বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্নগুলির সমাধান প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। ইসকনসহ বাংলাদেশের অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সাংস্কৃতিক অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। সমাজের প্রত্যেকটি স্তরে সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার মাধ্যমে দেশটির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনঃস্থাপন করা দরকার।
এ ঘটনাগুলি প্রমাণ করে যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা কমানোর জন্য ইউনূস প্রশাসনের আরও কার্যকর এবং নিরপেক্ষ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, যাতে দেশে ধর্মীয় সহাবস্থানের পরিবেশ টিকে থাকে।