বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছে। ভূমি দখল, নির্যাতন এবং ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক সময়ে ইসকন ট্রাস্টের সেক্রেটারি চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ একটি ৮ দফা দাবি পেশ করেছেন। তিনি সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষায় সুস্পষ্ট ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন, যা দেশজুড়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তাঁর এই ৮ দফা দাবি এবং এর পক্ষে জনমতের প্রতিক্রিয়া সংখ্যালঘুদের অধিকার আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মামলা করা হয়েছে।
গত বুধবার রাতে (৩০ অক্টোবর) চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. ফিরোজ খান ইসকনের চিন্ময় কৃষ্ণসহ ১৯ জন ও অজ্ঞাত আরও ১৫-২০ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় ইসকনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও পুন্ডরীক ধাম মন্দিরের অধ্যক্ষ চন্দন কুমার ধর প্রকাশ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীসহ চট্টগ্রামের হিন্দু জাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক অজয় দত্ত, নগরীর প্রবর্তক ইসকন মন্দিরের অধ্যক্ষ লীলা রাজ দাশ ব্রহ্মচারীসহ আরও বেশ কয়েকজনের সনাতন ধর্মাবলম্বী নেতাদের নাম রয়েছে। ইতিমধ্যে এই মামলায় পুলিশ দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
মামলা বিষয়ে চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের বক্তব্য:
ইসকন প্রবর্তক ধাম অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে এক ভিডিও বার্তায় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা প্রসঙ্গে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস প্রভুর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তিনি মামলাটি সনাতনীদের আট দফা দাবি আদায়ের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা হিসেবে আখ্যা দেন।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস বলেন, ‘৫ আগস্টের পর সনাতনীদের ওপর চালানো হামলা-নির্যাতনের প্রতিবাদে আমাদের আন্দোলন। এই আন্দোলন বর্তমান সরকার কিংবা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়।’
চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের ৮ দফা দাবি:
চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের দাবি অনুসারে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা এবং সমানাধিকার নিশ্চিত করতে নিম্নলিখিত ৮টি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে:
সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন: সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং অধিকার রক্ষায় আলাদা একটি সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে, যা তাদের উপর আক্রমণ ও নির্যাতনের শাস্তি কঠোর করবে।
সংখ্যালঘুদের জন্য একটি নির্দিষ্ট কমিশন প্রতিষ্ঠা: সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় একটি স্বাধীন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হবে, যা সংখ্যালঘুদের অভিযোগ তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারবে।
ভূমি দখল রোধে কঠোর পদক্ষেপ: সংখ্যালঘুদের ভূমি দখল রোধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং যারা বেআইনিভাবে ভূমি দখল করেছেন তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
সংখ্যালঘুদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা এবং পুনর্বাসন: সংখ্যালঘুদের আর্থিক উন্নয়ন এবং পুনর্বাসনের জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ করতে হবে, যা তাদের স্বাবলম্বী হতে সহায়ক হবে।
ধর্মীয় উৎসব ও প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষা: সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় উৎসব এবং প্রতিষ্ঠানগুলোতে হামলার ঘটনা বন্ধে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য নির্দিষ্ট পুলিশ ইউনিট: সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ বন্ধে বিশেষ পুলিশ ইউনিট প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যারা দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারবে।
শিক্ষা ও চাকরিতে সংখ্যালঘুদের কোটার ব্যবস্থা: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি চাকরিতে সংখ্যালঘুদের জন্য কোটার ব্যবস্থা করে তাদের সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে।
সংখ্যালঘুদের অধিকারের জন্য সাংবিধানিক সুরক্ষা: সংবিধানে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় আরও শক্তিশালী ধারা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যা বৈষম্যের শিকার ব্যক্তিদের জন্য ন্যায়বিচারের পথ সুগম করবে।
সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া:
চিন্ময় দাশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হওয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা তাদের হতাশা, ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে সামাজিক মাধ্যম ফেইসবুকে। অনেকে সরাসরি তাকে সমর্থন করে বলেছেন, এ মামলা না শুধুই ভিত্তিহীন, বরং এটা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা।
ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া:
বিভিন্ন ফেসবুক ব্যবহারকারী তাদের মতামত প্রকাশ করে বলেছেন যে, চিন্ময় দাশ যদি গ্রেপ্তার হন, তবে তার ফলাফল ভালো হবে না। অনেকে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাকে হিন্দুদের নিপীড়ন করার একটি পরিকল্পনা বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন, Oshik Kumar Arya মন্তব্য করেন, “চিন্ময় প্রভুকে গ্রেফতার করা হলে এর ফলাফল একদমই ভালো হবে না।” একই সঙ্গে অনেকে তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, পুরো সনাতনী সমাজ তার পাশে আছে।
Rishu Dev Nath লেখেন, “চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীর একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জন্য একটি নিরাপদ আবাসন তৈরি করা যেখানে হিন্দু-বৌদ্ধ-আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় তাদের ধর্মীয় জীবন নির্বিঘ্নে পালন করতে পারে।” এছাড়া, Dolon Sushil Raj বলেছেন, “প্রভু আপনার সাথে বাংলাদেশের সব সনাতনী আছে, আপনাকে গ্রেপ্তার করতে হলে কারাগার বড় করতে হবে।”
চিন্ময়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সনাতনী সম্প্রদায়ের অঙ্গীকার
অনেক ব্যবহারকারী তাদের পোস্টে চিন্ময় প্রভুর পক্ষের অবস্থান ব্যক্ত করে বলেছেন, চিন্ময় প্রভু গ্রেপ্তার হলে সারা দেশের হিন্দুরা ঘরে বসে থাকবে না। Shawon Das Bappu এবং Sudipto Sarker তাদের পোস্টে দ্রুত এ মামলা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন। Shuvananda Puri মন্তব্য করেন, “চিন্ময় প্রভুর বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা প্রত্যাহার না হলে এবং তাকে গ্রেপ্তারের ষড়যন্ত্র করা হলে সারা দেশের ৩ কোটি হিন্দু ঘরে বসে থাকবে না।”
Chandra Roy লেখেন, “ভয় নাই প্রভু, গোটা দেশ ও হিন্দু সমাজ আপনার সাথে।” অনেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের কণ্ঠরোধের এই প্রচেষ্টাকে একটি বড় বিপদ বলে আখ্যা দিয়েছেন। Satyajit Chowdhury বলেন, “চিন্ময় প্রভু জীবন উৎসর্গ করেছেন। যদি আমরা ওনাকে হারাই, তবে এটা সনাতনী সম্প্রদায়ের জন্য বিরাট ক্ষতি।”
মামলার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ:
বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ও হাটহাজারী পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী, প্রবর্তক ইসকন শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের অধ্যক্ষ লীলারাজ গৌর দাস ব্রহ্মচারীসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়েরের প্রতিবাদে সারাদেশে জেলা ও বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ সমাবেশের অংশ হিসেবে চট্টগ্রামে সমাবেশ করেছে সনাতনীরা।
শুক্রবার (১ নভেম্বর) বিকালে নগরীর চেরাগী মোড়ে এই বিক্ষোভ সমাবেশে হাজার হাজার সনাতনী নরনারী অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস ব্রহ্মচারীর সমাবেশে বলেন, আমরা প্রশাসনকে সময় দিয়েছি ৪ নভেম্বর পর্যন্ত। এরমধ্যে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীসহ অন্যদের নামে দায়েরকৃত মামলা মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে সারাদেশের সনাতনীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। সারাদেশে সনাতনীরা মাঠে নেমেছে। যদি অবিলম্বে মামলা প্রত্যাহার না হয় তবে বিশ্বব্যাপি এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে। আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বিশ্বাসী।
শুক্রবার (১ নভেম্বর) বিকালে সমাবেশ হয়েছে বান্দরবান সদরের ট্রাফিকমোড় এলাকা। সমাবেশে বক্তব্যে বক্তারা মামলাটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভিত্তিহীন দাবি করে এই হয়রানিমূলক মামলাটি অবিলম্বে প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। তারা বলেন, চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারী একজন সমাজসেবক ও সনাতনী আন্দোলনের অগ্রসৈনিক, যার কাজের মাধ্যমে বহু মানুষ উপকৃত হয়েছেন। এ ধরনের মিথ্যা অভিযোগ শুধুমাত্র তাকে সামাজিকভাবে হেয় করার ষড়যন্ত্র, যা তার জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করার কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
চিন্ময় ব্রহ্মচারীর বিরুদ্ধে মামলার বাদীকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার:
সংগঠনকে না জানিয়ে সনাতন ধর্মবিশ্বাসী সংগঠন আন্তর্জাতিক শ্রীকৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) সংগঠক চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী এবং চট্টগ্রামের হিন্দু জাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক অজয় দত্তসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করায় বিএনপি নেতা ফিরোজ খানকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
শুক্রবার (১ নভেম্বর) সকালে এক চিঠির মাধ্যমে তাকে বহিষ্কার করেন চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার সভাপতি মোহাম্মদ আজম ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. গিয়াস উদ্দিন ভুঁইয়া।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, দলের নীতি ও আদর্শের পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
স্বপ্ন এবং দায়িত্ববোধ থেকে ধম্মইনফো-ডট-কম এর সূচনা। ২০১১ সালে বাংলায় প্রথম অনলাইন বৌদ্ধ সংবাদ পোর্টাল হিসেবে ধম্মইনফো যাত্রা শুরু করে, যা বৌদ্ধধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং নীতিমালা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রচারে পাঠকের ব্যাপক গ্রহণ যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। ২০১২ সালে রামুতে মৌলবাদী হামলার পর এটি একটি শক্তিশালী সংবাদ মাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তর বাংলা ভাষী বৌদ্ধদের কাছে পরিচিতি লাভ করে। যদিও নিরাপত্তাজনিত কারণে ২০১৮ সালে সাইটটি প্রকাশনা বন্ধ করা হয়, ২০২৪ সালে ধম্মবিরীয় ভিক্ষুর নেতৃত্বে এটি আবার চালু হলে ধম্মইনফো বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার, বাংলাদেশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে সংবাদ, ঐতিহাসিক নিদর্শন, মণিষীদের জীবনী প্রকাশ, এবং ধর্মীয় উন্নয়নে কাজ করছে