বৌদ্ধদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ধর্মীয় তিথি হল প্রবারণা পূর্ণিমা। আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে প্রবারণা পালিত হয়, যা মূলত গৌতম বুদ্ধের নীতি নৈতিকতা ও চিত্তের চেতনা উন্নয়নের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এই দিনে ভিক্ষুরা নিজেদের অপরাধ বা ভুলের জন্য একে অপরের কাছে ক্ষমা চাযন এবং নতুন করে নিজেদের নতুনভাবে শুদ্ধ করার অঙ্গীকার করেন। এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে ভিক্ষুরা নিজেদের সঠিক পথ ও আদর্শ অনুসরণের প্রতিশ্রুতি করে।
ফানুস উড়ানোর প্রথাটি প্রবারণা পূর্ণিমার সাথে যুক্ত হয়েছে একটি ধর্মীয় আচার হিসেবে। এটি মূলত সিদ্ধার্থ গৌতমের জীবন পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা থেকে উদ্ভূত। আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে, সিদ্ধার্থ যখন গৃহ ত্যাগ করেন, তখন তিনি অনোমা নদীর তীরে উপস্থিত হন এবং চিন্তা করেন যে, প্রব্যজিত জীবনে চুলের কোনো প্রয়োজন নেই। এর পর তিনি একটি খুরধার তলোয়ার দিয়ে তাঁর চুল কেটে ফেলেন। এই ঘটনার সময় তিনি বলেন, “আমার কর্তিত চুল আমি আকাশে নিক্ষেপ করে দিলাম; আমি যদি এই জন্মে বুদ্ধ হতে পারি, তাহলে আমার চুল আকাশে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকুক, মাটিতে পতিত না হোক।”
এই চুল যখন আকাশে নিক্ষিপ্ত হয়, তখন দেবরাজ ইন্দ্র আনন্দিত হয়ে একটি স্বর্ণের ঝুড়িতে তা তাবতিংস স্বর্গে নিয়ে যান এবং সেখানে একটি জাদী নির্মাণ করেন, যার নাম “চুলামনি চৈত্য “। এই চুলামনি চৈত্য পূজা করার উদ্দেশ্যে বৌদ্ধরা প্রবারণা পূর্ণিমার সন্ধ্যায় ফানুস উড়িয়ে পূজা করে থাকে। তবে ফানুস উড়ানোর এই প্রথাটি বর্তমানে শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় আচার হিসেবে রয়ে যায়নি; বরং এটি একটি এখন উৎসবে পরিণত হয়েছে।
এই পরিবর্তনের ফলে কিছু নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে, যা ধর্মীয় আচারগুলোর ধমীয় চেতনা ও নৈতিক দিককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। গভীরভাবে চিন্তা করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ধর্মীয় আচার বা বিশ্বাসকে একটি আনন্দমুখর উৎসবে পরিণত করার ফলে এর মূল তাৎপর্য হারিয়ে যাচ্ছে। নিচে এর কিছু খারাপ দিক বিশ্লেষণ করা হলো:
১. ধর্মীয় চেতনার ক্ষতি
বৌদ্ধ দর্শনে চিত্ত, চেতনা এবং কর্মের গুরুত্ব অপরিসীম। চিত্ত হলো মনের অবস্থা, যা প্রতিটি কাজের মূলে থাকে। চেতনা হচ্ছে সেই জাগ্রত বোধ বা সংবেদনশীলতা, যা আমাদের কাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। কর্ম হলো সেই সুনির্দিষ্ট কাজ বা আচরণ, যা আমাদের চেতনার প্রতিফলন হিসেবে ঘটে।
বৌদ্ধ ধর্মীয় আচারগুলো মূলত কুশল চেতনা বা শুদ্ধ চেতনাকে উদ্দীপিত করার উদ্দেশ্যে। এই চেতনার মাধ্যমে চিত্তের উন্নতি ঘটে এবং কুশল কর্মের দ্বারা পাপ থেকে বিরত থাকার প্রয়াস থাকে। প্রবারণা পূর্ণিমার ফানুস উড়ানোর মূল লক্ষ্য হলো চুলামনি চৈত্য পূজার মাধ্যমে এই কুশল চেতনার উদ্রেক করা, যাতে চিত্তের পরিশুদ্ধি হয়। কিন্তু যখন এই আচার কেবল বিনোদনে পরিণত হয়, তখন মানুষ কর্মের প্রকৃত অর্থ থেকে বিচ্যুত হয়।
চিত্তের শুদ্ধির পরিবর্তে বিনোদনের দিকে মনোযোগ দেওয়া হলে, চেতনার পরিশুদ্ধি আর হয় না, ফলে কর্মের গুণগত মানও হ্রাস পায়। ফলত, আচারগুলোর আসল উদ্দেশ্য—চিত্তের উন্নয়ন, পাপ থেকে বিরত থাকা, এবং ধর্মীয় শৃঙ্খলার মাধ্যমে কুশল কর্ম করার প্রয়াস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বৌদ্ধ চেতনা ও কর্মের এই ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি, কারণ এর মাধ্যমে ধর্মের প্রকৃত চেতনার উন্নতি সম্ভব।
২. বাণিজ্যিকীকরণ
ফানুস উড়ানোর আচারটি যখন উৎসবের রূপ নেয়, তখন এর বাণিজ্যিকীকরণের প্রবণতা দ্রুত বাড়তে থাকে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, ফানুসের পরিবর্তে চায়না লন্ঠন বিক্রি বেড়ে চলেছে, যা ধর্মীয় আচারটির মূল উদ্দেশ্যকে বিকৃত করছে। এর ফলে ছোট আকারের অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনাও ঘটছে, যা প্রবারণা পূর্ণিমায় বৌদ্ধদের ফানুস উড়ানোর প্রথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার কারণে নানা রঙ, আকার, ও আকৃতির ফানুসগুলো যাচ্ছেতাইভাবে তৈরি হচ্ছে। এই বৈচিত্র্য মূল ধর্মীয় চেতনার পরিবর্তে বাহ্যিক চমক প্রদর্শন ও ভোগের দিকেই মানুষকে আকৃষ্ট করছে। এতে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আসল উদ্দেশ্য থেকে মানুষ সরে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতার কারণে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ফানুস তৈরি হচ্ছে, যাচ্ছেতাই ভাবে বানানো হচ্ছে নানান সাইজের নানান রংঙ্গের, নানান আকৃতির, নানান নামের ফানুস। এর ফলে ধর্মীয় আচারগুলোর ধর্মীয় চেতনা হ্রাস পাচ্ছে এবং এটি সমাজের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠছে। এই প্রবণতা ধর্মীয় আচারগুলোর ধর্মীয় চেতনা ধ্বংস করছে এবং সাধারণ মানুষ ধর্মীয় আচারগুলোর প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছে, যার ফলে আচারগুলো আর কুশল চেতনা ও সঠিক কর্মের পথে পরিচালিত হচ্ছে না।
৩. অতিরিক্ত খরচ ও সামাজিক চাপ
বৌদ্ধদের অনুষ্ঠানগুলো সাধারণত মানসিক শান্তি ও সমাজের মধ্যে ঐক্যের সেতুবন্ধন তৈরি করে, কিন্তু যখন এগুলো উৎসবের চেহারা নেয়, তখন অতিরিক্ত খরচের চাপ সৃষ্টি হয় সমাজে। বৌদ্ধ শিক্ষায় চিত্তের শুদ্ধি, সংযম, এবং কুশল কর্মের ওপর জোর দেওয়া হয়। তবে উৎসবের বাণিজ্যিকীকরণের ফলে পরিবারগুলোকে নানা ধরনের সামাজিক চাপের মুখোমুখি হতে হয়।
অনেক সময় দেখা যায়, পরিবারগুলো সামাজিক মান রাখতে গিয়ে উৎসবের জন্য ব্যয়বহুল ফানুস, সাজসজ্জা, ও অন্যান্য সামগ্রী কিনতে বাধ্য হচ্ছে। এই অতিরিক্ত খরচ তাদের আর্থিক অবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং চিত্তের শান্তি বিঘ্নিত করছে। বৌদ্ধ চেতনায় সংযম, বিনয়, ও মিতব্যয়িতার গুরুত্ব থাকলেও, এই সামাজিক চাপ মানুষকে ভোগের দিকে ঠেলে দেয়।
ফলস্বরূপ, ধর্মীয় আচারগুলোর আসল উদ্দেশ্য—চিত্তের পরিশুদ্ধি ও পাপ থেকে বিরত থাকা—ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষ কুশল কর্মের বদলে বাহ্যিক প্রতিযোগিতা ও সামাজিক চাহিদার দিকেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।
৪. বৈষম্য ও সংঘাতের সৃষ্টি
ফানুস উড়ানোর মতো ধর্মীয় আচারগুলো যখন উৎসবের রূপ নেয়, তখন তা অনেক সময় সংঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বৌদ্ধ দর্শনে সহমর্মিতা, অহিংসা, ও সম্প্রীতির ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু যখন ধর্মীয় আচারকে উৎসবমুখী করে তুলতে গিয়ে গান, ডিজে, উদ্দোম নাচ চলে তখন সেখানে ভিন্ন সম্প্রদায়ের কুপ্রবৃত্তির লোকেরও প্রবেশ ঘটে। এতে অনেক সময় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয়।
বৌদ্ধ চেতনায় ধর্মীয় আচারগুলোর প্রকৃত উদ্দেশ্য—চিত্তের শুদ্ধি ও কুশল কর্মের অনুশীলন।
৫. প্রদর্শন ও বাহ্যিকতার প্রাধান্য
ফানুস উড়ানো বর্তমানে একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে, যার কারণে ধর্মীয় চেতনার মূল উদ্দেশ্য মানুষ ভুলে যাচ্ছে, কিন্তু এখন মানুষ ফানুসের সৌন্দর্য ও বাহ্যিক প্রদর্শনেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। প্রতিযোগিতার কারণে কে কত বড়, সুন্দর, এবং অভিনব ফানুস উড়াতে পারে, সেটিই প্রধান হয়ে উঠেছে।
এই বাহ্যিক প্রদর্শনের কারণে ধর্মীয় চেতনার তাৎপর্য হারিয়ে যাচ্ছে, যা চিত্তের শান্তি ও শুদ্ধি আনতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে আচারগুলোর প্রকৃত উদ্দেশ্য—কুশল কর্ম ও চেতনার বিকাশ—ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
৬. আচার ও ধর্মীয় অনুভূতির অপব্যবহার
ধর্মীয় আচার ও উৎসবগুলো বর্তমানে রাজনৈতিক বা সামাজিক উদ্দেশ্যে অপব্যবহৃত হচ্ছে। অতিথির নামে রাজনৈকিত ব্যক্তির উপস্থিতি ও নানাবিধ প্রদর্শন প্রাধান্য পাচ্ছে, যা ধর্মীয় আচারগুলোর মূল উদ্দেশ্যকে ক্ষুণ্ণ করছে এবং সমাজের ধর্মীয় অনুভূতির ক্ষতি করে মানুষকে ধর্মীয় আচারগুলো সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচ্যুত করছে।
অতএব, প্রবারণা পূর্ণিমার ফানুস উড়ানোর আচারটির সাথে ধর্মীয় আচারগুলোর মধ্যে যে সম্পর্ক বিদ্যমান, তা কেবল একটি উৎসবেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি একটি সামাজিক প্রথায় পরিণত হচ্ছে, যা ধর্মীয় আচারগুলোর ধর্মীয় চেতনা ও মূল উদ্দেশ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফলে আমাদের উচিত ধর্মীয় আচারগুলোর মধ্যে ধর্মীয় চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং আমাদের চিত্তের পরিশুদ্ধি ও কুশল কর্মের দিকে মনোযোগ দেওয়া। ধর্মীয় আচারগুলোর মূল উদ্দেশ্য উপলব্ধি করা এবং সেগুলোকে সামাজিক উৎসবের রূপে পালনের পরিবর্তে চিত্তের উন্নতি ও ধর্মীয় চেতনার দিকে ধাবিত করা প্রয়োজন।
প্রকাশক ও সম্পাদক, ধম্মইনফো-ডট-কম
খুব ভালো লেখা। আপনার বিশ্লেষন খুবিই যুক্তিযুক্ত। বন্দনা।