বর্তমান যুগে আমাদের বৌদ্ধসমাজকে যথাযথ সুরক্ষা করতে চাইলে ভিক্ষুদের উচ্চশিক্ষা দরকার। দেশে-বিদেশে নানা ধর্মীয় কনফারেন্স অংশ গ্রহন দরকার। বাংলা-ইংরেজী-পালি-হিন্দী মতোই এমন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষার দক্ষতা দরকার। ধর্মীয় বিষয়ে গভীর ও তাত্ত্বিক দক্ষতা দরকার। মিশনারীদের মত নানান বিষয়ে যোগ্যতা দরকার। প্রায় সকল প্রধান প্রধান ধর্মীয় দর্শন নিয়ে অধ্যায়ন দরকার।
এমনকী যারা অরণ্যবাসী ধ্যান-সাধনায় আগ্রহী তাদেরকেও অরন্যবাসে যাওয়া পূর্বে গভীর অধ্যায় দরকার।
বর্তমান যুগে মুখরোচক জাতক-গল্প কাহিনী কিংবা মুখস্ত সূত্র আবৃত্তির চেয়েও যুগপোযুগী সময়ের সাথে সামণ্জস্য রেখে সমাজ-দর্শন নিয়ে গভীর আলোচনা/দেশনা প্রয়োজন। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের জন্যে আধুনিক যুগপযোগী মোটিভেটিব আলোচনা প্রয়োজন।
বুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ভারতে বৌদ্ধধর্মের নানা উত্থান-পতনের মধ্যেও বৌদ্ধধর্মকে এতোদূর এগিয়ে নিয়ে এসছেন একমাত্র ভিক্ষুরাই। সিংহল ইতিহাসের “সংঘশক্তি” গ্রন্থে তা পরিস্কার আলোচনা করা হয়েছে।
যদি ভিক্ষুরাই যথাযথ ত্রিপিটকাদির সুনিপুণ অধ্যায়/চর্চা না করতো তাহলেই বৌদ্ধধর্ম এতোদিন বিলুপ্ত হয়ে যেত।
আপনার যদি একটু খেয়াল করেন তাহলে বুঝতে পারবেন-
বুদ্ধের সমকালীন ভারত বর্ষে আরো অনেক প্রসিদ্ধ ধর্মগুরু আর্বিভাব এবং তাদের স্বীয় স্বীয় মতবাদের চর্চা হয়েছিল।
তৎমধ্যে মহাবীরেরে জৈন দর্শন, অজিত কেশকম্বলীর চার্বাক দর্শন, প্রকুধ কাত্যায়নের শ্বাশতবাদ দর্শন, পূর্ণ/পূরণ কশ্যপের অক্রিয়াবাদী দর্শন, সঞ্জয় বেলট্ঠিপুত্তের অনেকান্তবাদী বা অজ্ঞানবাদী দর্শন অন্যতম।
কিন্তু তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় উগ্রব্রাহ্মণদের নানা প্রতিকুলতায় অন্যান্য দর্শনগুলো বেশিদূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি, শুধুমাত্র উপযুক্ত নেতৃত্বের ব্যর্থতায়।
বুদ্ধের সমকালীন প্রায় রাজা/শাসকেরা ঐ সময়কার সকল দর্শনকে সমর্থন করতেন। যেমনটা জৈন ধর্মের গ্রন্থগুলোতে দৃষ্ট হয়- রাজ প্রসেনজিৎ নিয়মিত মহাবীরের নিকটে যেতেন এবং উনার দর্শনের খুব অনুরক্ত ছিলেন। এমনকি রাজা প্রসেনজিতের অনেক সেনা মহাবীরের কাছে দীক্ষা নিয়ে জৈন সন্ন্যাসী হয়েছিলেন।
আমরা যেমনটা বৌদ্ধসাহিত্যে রাজা প্রসেনজিতের বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা/গারোবতা প্রদর্শনের আলোচনা দেখি , তেমনটা জৈন সাহিত্যগুলোতেও রাজা প্রসেজিতের যথেষ্ট প্রসংশা করা হয়েছে। যদিওবা পরবর্তীতে বুদ্ধের কাছে তিনি দীক্ষা নিয়ে বৌদ্ধধর্মে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছিলেন।
এমনও দৃষ্ট হয়- মহাবীর এবং বুদ্ধ একই গ্রামেই পাশাপাশি অবস্থান করেছিলেন। যদিওবা কোথাও একে অপরকে সাক্ষাতের বিষয়ে তেমনটা উল্লেখ নেই।
যেমনটা চার্বাক সহ অন্যান্য দার্শনিকের সাথে বুদ্ধের অনেক আলোচনা ও সাক্ষাতের প্রসঙ্গ দৃষ্ট হয়।
বুদ্ধ পরবর্তী সম্রাট অশোকের মৌর্য যুগ, এরপর গুপ্তযুগ, গৌড়যুগ, পালযুগ, সেনযুগ। এভাবে ভারতে বৌদ্ধ সভ্যতার নানা উত্থান-পতনে মধ্যে দিয়ে আজ বৌদ্ধদের বর্তমান রূপ।
যেভাবে গৌড়যুগে ব্রাহ্মণ শাসক শশাঙ্ক গণহারে বৌদ্ধ নিধন করে ছিল, ঠিক অনুরূপভাবে ব্রাহ্মণরাজা মিহিরকুল গণহারে জৈনদের নিধন করেছিল।
তবে বৌদ্ধভিক্ষু ও বৌদ্ধ নিধনে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হত্যা লিলা চালিয়েছিল – পুষ্যমিত্র। “অশোকাবদান” গ্রন্থে উল্লেখ আছে- ইতিহাসের বুকে অমর হওয়ার উদ্দেশ্যে এক মন্ত্রীর পরামর্শে পুষ্যমিত্র, বৌদ্ধ ধর্ম ধ্বংস করতে উদ্যত হন। প্রথমেই তিনি কুক্কুতারাম বৌদ্ধবিহার ধ্বংস করে ভিক্ষুদের হত্যা করেন। এরপর তিনি সকল নগরীতে একটি শিলালিপি স্থাপন করে ঘোষণা করেন যে, তার নিকট একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর কর্তিত মস্তক নিয়ে এলে পুরস্কার স্বরূপ একশত মুদ্রা প্রদান করা হবে।পুষ্যমিত্র কাশ্মীর সীমান্তে প্রায় পাঁচশত বৌদ্ধবিহার ধ্বংস করেন ও অগণিত বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যা করেন।
ঠিক অনুরূপ ভাবে শৈবশাসক শংকরাচার্য চার্বাক দার্শনিক ও চার্বাক অনুসারীদের গণ হারে হত্যা করেছিল। এবং সমগ্র চার্বাক দর্শনের গ্রন্থগুলি বিনষ্ট করে দিয়েছিল। সেই জন্যে পুরো ভারত জুড়ে আজ অবদি চার্বাকদের মুল কোনো গ্রন্থ উদ্ধার কিংবা পাওয়া যাইনি।
শংকরাচার্য শুধু চার্বাক অনুসারীদের নয় তিনি বৌদ্ধভিক্ষু ও সাধারন বৌদ্ধদের নির্মম হত্যা সহ পুরাতন বৌদ্ধ বিহারগুলো ধ্বংসের পাশাপাশি বৌদ্ধ বিহারগুলোকে হিন্দুধর্মের দেব-দেবীর মন্দিরে রূপান্তরিত করেন।
যাইহোক! উক্ত আলোচনার মুল বিষয় হলো ভারতের বুকে বৌদ্ধদের এতো হত্যা/নিধন সত্ত্বেও বৌদ্ধধর্ম এখনও সগৌরবে ভারত সহ সমগ্র বিশ্বে জনপ্রিয়তার একমাত্র চালিকাশক্তি শাস্ত্রাজ্ঞ-জ্ঞানী – গুণী বৌদ্ধভিক্ষুরা।
তারা যদি শীল-বিনয় ও ধ্যান- সাধনার পাশাপাশি বৌদ্ধ সাহিত্যচর্চা না করতেন তাহলে কখনও তা পুণরায় উত্থান কিংবা প্রচার-প্রসার সম্ভব হতো না। চার্বাক কিংবা জৈন দর্শনের মতোই বিলুপ্ত হয়ে যেতো।
বর্তমানে আমাদের ভিক্ষুদেরকেও দর্শন সাহত্যি সকল শাস্ত্রে জ্ঞানার্জন আবশ্যক। একাডেমিক উচ্চ শিক্ষাও খুবই প্রয়োজন। যদি সম্প্রতির আমাদের প্রত্যক্ষ একটি ঘটনার আলোচনা করি তাহলে তা আরো পরিস্কার হবে।
বর্তমানে শ্রদ্ধেয় ড.জিনবোধি ভান্তে গুটিকয়েক পদ-পদবী লোভী প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নানা প্রতিকুলতার মাঝেও এতোটুকু টিকে থেকে জাতি/সমাজ কিংবা সাংঘিক অধিকার রক্ষায় মুল শক্তি হচ্ছে উচ্চশিক্ষা সহ বৌদ্ধিক জ্ঞান দর্শন। যদি ঐস্থানে অন্যকোনো সাধারন ভিক্ষু হতো এতোদিন বিলীন হয়ে যেতো।
যদিও অতীতে অনেক জ্ঞানী গুণী শিক্ষিত পণ্ডিত ভিক্ষুরাও তাদের নানা ষড়যন্ত্রের কবলে ঐস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তথাপি সংঘের একতা এবং একাডেমিক উচ্চ শিক্ষা, বিবিধ বিষয়ে দার্শনিক যোগ্যতা বর্তমান যুগে ভিক্ষুদের জন্যে অন্যতম চালিকা শক্তি।
অন্যথা দুঃশীল ক্ষমতাধারী পদ-পদবী লোভী দায়কাদের ভূত্যতুল্য অবহেলিত হয়ে থাকতে হবে।
নেপোলিয়ন যেমনটা বলেছিলেন – “আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।”
বর্তমান যুগে আমাদের ভিক্ষুদের ক্ষেত্রেও এমনটা প্রযোজ্য- একজন শিক্ষিত, শাস্ত্রজ্ঞ, শীলবান, বিনয়ী ভিক্ষু/সংঘ দাও, জাতি/সমাজ -ধর্ম এমনিতে সুরক্ষিত হবে।”
অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী চট্টগ্রাম মিরসরাই জন্মজাত সন্তান সুজয় বড়ুয়া। সমসাময়িক ও বৌদ্ধ বিষয়ে তার নিয়মিত লেখা পাঠক মহলে ব্যাপক সমাদৃত।