বৌদ্ধধর্মে বা বুদ্ধের শিক্ষায় ‘আত্মা’ নেই। বুদ্ধের শিক্ষা আত্মাহীন, ‘সব্বে ধম্ম অনত্তা’তি’। জগতের সকল ধর্মই (ধম্ম) হলো আত্মাহীন। সুতরাং, আত্মা যেখানে নেই সেখানে ‘আত্ম’ বা ‘আমি’র কোনও অস্তিত্ব নেই। আত্ম বা আত্মার পুনর্জন্ম অন্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোতে আছে, তবে, বৌদ্ধ ধর্মে বা বুদ্ধের শিক্ষায় নেই।
‘সব্বে ধম্ম অনাত্ত’- বলতে সনাতন (হিন্দু), বৌদ্ধ, ইসলাম, ঈসায়ী, শিখ, জৈন এই অর্থে নয়। এখানে ধর্ম অর্থে Things, thought, experience, phenomena, mind and matters, perception and consciousness etc. এসকলকে এবং আরো বিভিন্ন অর্থে বুদ্ধ ‘ধম্ম’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। বুদ্ধদেশিত ‘ধম্ম’ শব্দটির বঙ্গানুবাদ ‘ধর্ম’ করতে গিয়েই গণ্ডগোল হওয়ার কারণে অনেকে উপরোক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর সাথে বুদ্ধ ব্যাখ্যাত ‘ধম্ম’ শব্দটিকে গুলিয়ে ফেলেন।
সকল ধম্ম (ধর্ম)র সব কিছুই কার্যকারণ হতে উৎপন্ন। কোনও কিছুই স্বতন্ত্র নয়, আপেক্ষিক। সেই অর্থে সব্বে ধম্ম অনাত্ত’তি ।
আত্মহীন, অনাত্মবাদী বৌদ্ধ ধর্মের ‘পুনর্জন্ম’ কিন্তু অন্যান্য ধর্মে যেই পুনর্জন্ম আছে, সেটা এক্কেবারেই নয়। এটা হলো ‘পুনর্ভব’। ‘ভব’ অর্থ ‘হওয়া’। পুনর্ভব মানে পুনর্বার হওয়া।
মৃত্যুর সময় যে চিত্ত প্রবাহ থাকে সেটাকে ‘চ্যুতিচিত্ত’ বলে। মরণকালীন চ্যুতিচিত্ত নিরুদ্ধ হয়ে গেলেই মৃত্যু ঘটে। তখন দেহে চিত্তজাত ও আহারজাত রূপ বা আকারও নিরুদ্ধ হয়। কেবল ঋতুজরূপ বা উত্তাপ মৃতদেহ ধুলিসাৎ না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান করে। আয়ু, জীবনীশক্তি এবং বিজ্ঞানের তিরোধানে মৃত্যু হয়। তবে, তাতে জীবের চিরধ্বংস হয় না। যে কর্মশক্তি এতোদিন জীবন পরিচালনা করছিল তা অবশিষ্ট থাকে। সেই কর্মশক্তি দেহ ধ্বংস হয়ে গেলেও বিনষ্ট হয় না।
বৈদ্যুতিক বাতি ধ্বংস হয়ে গেলে বিদ্যুৎপ্রবাহ ধ্বংস হয় না, প্রবহমান থাকে; অন্য একটি বৈদ্যুতিক বাতি সেথায় সংযোজিত করলে আবার আলো উৎপন্ন হয়; তদ্রূপই দেহ বিনষ্ট হয়ে গেলেও কর্মশক্তি রয়ে যায়, নির্বাণ লাভ না করা অবধি বা ক্লেশ ধ্বংস অথবা লোভ-দ্বেষ-মোহ-তৃষ্ণা ধ্বংস না করা অবধি। ক্লেশ বা আসক্তি সমুদয়ের চিরতরে নিরোধ হয়ে অরহত্ত্ব ফল অধিগত হলে আর পুনর্ভব বা পুনর্জন্ম হয় না।
প্রাগুক্ত মরণকালীন চ্যুতি চিত্ত নিরুদ্ধ হয়ে গেলেই প্রতিসন্ধি চিত্ত লাভ হয়, বা অপর জন্মগ্রহণাবস্থা প্রাপ্ত হওয়া যায়। আরও বলা হচ্ছে, মৃত্যুর সময় চিত্তের চ্যুতি হলেও-পর, চ্যুতি চিত্তের সমুদয় শক্তি প্রতিসন্ধি চিত্তে প্রবাহিত হয়। মাতৃগর্ভে ভ্রুণ হিসেবে উৎপন্ন হওয়ার সময় বা অন্যকোন লোকভূমিতে উৎপন্ন হবার সময় যে চিত্ত উৎপন্ন হয় তাই ‘প্রতিসন্ধি চিত্ত’। চ্যুতি চিত্তের নিরোধে মৃত্যুর পর কর্ম শক্তির দ্বারা নিক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিসন্ধি চিত্ত অন্য ‘ভব’ বা অস্তিত্ব লাভ করে।
প্রতিসন্ধির সাথে সাথেই যুগপৎ বা একইসাথে পঞ্চস্কন্ধ (রূপ-বেদনা-সংজ্ঞা-সংস্কার ও বিজ্ঞান) উৎপন্ন হয়। পঞ্চস্কন্ধ উৎপত্তির প্রথম ক্ষণেই লিঙ্গ নির্দ্ধারিত হয়ে যায়। তবে, যেই ব্যক্তির চ্যুতি চিত্তের নিরোধে প্রতিসন্ধি চিত্তোৎপত্তিতে জীবের প্রাদুর্ভাব হয়েছে উভয় জীব বা ব্যক্তি একইও নয়, আবার ভিন্নও নয়। কেননা, পঞ্চস্কন্ধের বিভিন্নতার দরুণ এক ব্যক্তি বা জীব নয়, আবার কর্মবিপাকজ ধর্মসন্ততি বা চিত্তসন্ততির প্রবহমানতার দরুণ ভিন্ন ব্যক্তি বা জীব নয়। অভিধর্মে পট্ঠানের প্রত্যয় ব্যাখ্যায় এটাকে ‘অনন্তর প্রত্যয়’ বলা হয়েছে।
বিশুদ্ধিমার্গে উপমা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, নদীর ঢেউয়ের একটির প্রবাহে যেমন অপর ঢেউ উৎপন্ন হয়, কিন্তু উভয় ঢেউ একও নয়, আবার আলাদাও নয় তদ্রূপ; দর্পণে প্রতিবিম্বিত ব্যক্তি ও বাস্তব ব্যক্তি যেমন একও নয়, বিভিন্নও নয় তদ্রূপ।
পূর্বেই বলা হয়েছে, জন্ম হচ্ছে ‘নাম-রূপ’ বা পঞ্চস্কন্ধের প্রাদুর্ভাব। মৃত্যু হচ্ছে অস্থায়ী বস্তুর অস্থায়ী অবসান। শারীরিক অবস্থা যেমন পূর্ব অবস্থা হতে উৎপন্ন, তেমনি নাম-রূপের আবির্ভাবও পূর্ব জন্মের কারণ হতে উৎপন্ন। জীবনের প্রবাহ যেমন স্থায়ী অস্তিত্ব ছাড়াও এক চিত্তক্ষণ হতে আরেক চিত্তক্ষণে চলতে পারে, তদ্রূপ বহু জীবন প্রবাহও অমর আত্মার অনুপস্থিতি ব্যতীত এক অস্তিত্ব হতে অন্য অস্তিত্বে রূপ পরিগ্রহ করতে পারে।
এই যে প্রবাহ এটাকে ‘সন্তান’ বলা হয়। এই সন্তান কিন্তু ক্লীব লিঙ্গ। এটি পিতামাতার ঘরে যেই সন্তান উৎপন্ন হয়, আমরা যেমন কারো না কারো সন্তান-সন্ততি তেমন নয়। এটি হলো ঐকিক ব্যক্তির বা জীবের চিত্তপ্রবাহ, চিত্তস্রোত, চিত্তধারা।
পালি ভাষার পুনর্ভবের প্রবাহরূপ ‘সন্তান’ চিত্ত সন্ততি বা চিত্ত প্রবাহ। অনেকেই এই ‘সন্তান’কে পুং লিঙ্গ, মাতা-পিতার ঔরসজাত সন্তান ভেবে মহাভ্রমে পতিত হচ্ছেন, ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। আবারো মনে করিয়ে দিচ্ছি এটি চিত্ত প্রবাহরূপ সন্তান, এবং এটি ক্লীব লিঙ্গ, এটি গতানুগতিক ধারণার সন্তান নয়। এটির আভিধানিক অর্থ হলো বিস্তৃতি, ব্যাপ্তি, প্রবাহ।
এই চিত্ত সন্তান বা চিত্ত সন্ততিরূপ প্রবাহ নিয়ত চলমান থাকবে কর্মানুসারে, যতকাল চিত্তের বৃত্তিসমূহ বা চিত্তের তৃষ্ণাবলী নিরুদ্ধ হবে না ততদিন পর্যন্ত। চিত্তবৃত্তির নিরোধ হলেই, চিত্তের তৃষ্ণা সমূলে উৎপাটিত হলেই এই ‘চিত্ত সন্তান’ নিরুদ্ধ হয়ে যাবে, যেটিকে বলা হচ্ছে নির্বাণ। তাই বলা হয়েছে, ‘চিত্তবৃত্তির নিরোধই নির্বাণ’।
চিত্তবৃত্তির নিরোধ হলেই চিত্ত সন্তান আর ব্যপ্তি হতে পারবে না, বিস্তৃত হতে পারবে না। এখানেই পুনর্জন্মের নিরোধ, পুনর্ভবের নিরোধ, পুনরুভ্যুদয়ের চিরতরে নিঃশেষ, জন্মান্তরের লীলাখেলা সমাপ্ত।
আকর গ্রন্থ:
১. ড. সুকোমল চৌধুরী, গৌতম বুদ্ধের ধর্ম ও দর্শন, ২য় সংস্করণ, ঢাকা: জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ২০১৪।
২. মহাস্থবির, শান্তরক্ষিত। পালি-বাংলা অভিধান (২য় খণ্ড)। ঢাকা: বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, ২০০৮।
৩. ভিক্ষু, আর্য্যনন্দ। পঞ্চস্কন্ধের পরিচয়। রাঙ্গামাটি: কাচালং কচুছড়ি উপাসক-উপাসিকাবৃন্দ, ১৯৯৮।
৪. ভিক্ষু, রাহুল।পট্ঠান-১ম খণ্ড। রাঙামাটি: রাজবন অফসেট প্রেস, ২০১৬।
৫. আচার্য বুদ্ধঘোষ। বিশুদ্ধিমার্গ-১ম খণ্ড। অনুবাদক, সমণ পূণ্নানন্দ। তাইপেই: দ্য কর্পোরেট বডি অব দ্য বুদ্ধ এডুকেশনাল ফাউণ্ডেশন, ২০০৬।
৬. পুরবাসী, জম্বুদ্রোণী। সার-সংগ্রহ (১ম ও ২য় খণ্ড)। অনুবাদক, স্থবির, ধর্মতিলক। রেঙ্গুন: বৌদ্ধ মিশন প্রেস, ১৯৩২।
- Rinpoche, Trunga. Glimpses of Abhidharma. Boston: Shambhala Publications, 1975.
- Ñyanatiloka, Ed. by Ñyanaponika. Buddhist Dictionary: Manual of Buddhist Terms and Dotrines. Taiwan: The Corporate Body of the Buddha Educational Foundation, 2009.
- A Manual of Abhidhamma (Abhidhammattha Sangaha), 4th revised ed. Trans. Maha Thera, Narada. Kuala Lumpur: Buddhist Missionary Society, 1987.
- Bhikkhu Bodhi, A comprehensive Manual of Abhidhamma (The Philosophical Psychology of Buddism). Onalsaka: Buddhist Publication Soceity, 2000.
- Mahathera, Narada. Buddhism in a Nutshell. Kandy: Buddhist Publication Society, 1982.
নিপুন বড়ুয়া চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী থানার অন্তর্গত বঙ্গীয় বৌদ্ধদের খ্যতিসম্পন্ন ও সুপরিচিত শীলকূপ গ্রামের জন্মজাত সন্তান। নিপুন বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে PhD Degree অর্জনের জন্য গবেষণায় নিয়োজিত আছেন। অদ্যাবধি তাঁর বহু প্রবন্ধ ও গ্রন্থ পাঠক মহলে ব্যাপক নন্দিত হয়েছে।