কবি বলেন ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে (জীবন যুদ্ধ, কীর্তিধারী হবার, সৃষ্টি করার) যাবার শ্রেষ্ঠ সময় তার’। সত্যিই যৌবন এমন এক সময় যা জীবনের পরম সুবর্ণকাল। বিশ্বের তাবৎ ধর্মবেত্তা, রাষ্ট্রনায়ক, চিত্রকর, কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, ক্রীড়াবিদ, সঙ্গীত শিল্পী, বিজ্ঞানী যৌবনের জয়গান করেছেন এবং তাঁদের জীবনের যা কিছু অর্জন সেগুলোর অধিকাংশই যৌবন কালেই তাঁরা অর্জন করেছেন। আবার পৃথিবীর প্রায় ধর্মপ্রচারক বা ধর্র্মবেত্তাগণ পূর্ণ যৌবনেই বা পৌঢ় বয়সের আগেই ধর্ম আবিষ্কার ও প্রচারে ব্রতী হয়েছেন। যেমন বুদ্ধ গৌতম ২৯ বছর বয়সে ধর্ম লাভার্থে সংসার ত্যাগ করে ৬ বছর কঠোর সাধনাবলে ৩৫ বছর বয়সে বুদ্ধত্ব লাভ করেছেন। সম্রাট অশোক, মহাকবি ভিক্ষু অশ্বঘোষ, মহাকবি ভিক্ষু বুদ্ধঘোষ, মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাস্টার দা সূর্যসেন, বিপ্লবী ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বিদ্রোহী কবি নজরুল, মহাপণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন, কার্ল মার্কস, মাও সেতুং, স্টিভ জবস্, নেলসন ম্যান্ডেলা, চে গুয়েভারা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, দালাই লামা, কে.শ্রী ধর্মানন্দ মহাথেরো, কর্মযোগী কৃপাশরণ মহাস্থবির, বাবা সাহেব ড. ভীমরাও রামজী আম্বেদকর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ কীর্তিমান সকলে তাঁদের যৌবনেই সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে উঠেছিলেন বলে তাঁরা আজও বিশ্বব্যাপী বরণীয় ও স্মরণীয় এবং অনুকরণীয় তাঁদের কর্মকীর্তি।
যে যৌবন দুর্বার, যে যৌবন গতিময়, যে যৌবন সৃষ্টি সুখের উল্লসিত হবার সে যৌবনে যদি কোন যুবক বা যুবতী বিপথগামী হয় তবে তা তাদের পরিবার, সমাজ, তথা দেশের জন্য মহাক্ষতিকর, সর্বাগ্রে তাদের নিজেদের জন্যে তো অবশ্যই।
উল্লিখিত শিরোনামে বৌদ্ধ যুবক-যুবতীদের মোহ মলিন অতি দুর্দিন এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সে নিরিখে আলোচনা করা যাক্। বর্তমান সময়ে বৌদ্ধ সমাজের অনেক যুবক যুবতীদের মাঝে বেশ কিছু নেতিবাচক দিক(কিছু কিছু মারাত্মক নেতিবাচক) পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা কোন অবস্থাতেই পরিবারের বা সমাজের জন্য সুখবর নয় বরং অতি বেশি উদ্বেগজনক। বর্তমান সমাজে বৌদ্ধ যুবক-যুবতী বা তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বিরাজিত নেতিবাচক দিকের মধ্যে প্রধান হল ধর্মান্তর গ্রহণ। নেশাপান সমেত অপরাপর বিচ্যুতি বা নেতিবাচক বিষয়গুলো গুলো কিন্তু ফেলে দেবার মত নয়। কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে ধর্মান্তরই আমাদের সমাজের উঠতি বয়সী বা যুবক-যুবতীদের জন্য সর্বাগ্রগণ্য মহা অশনি সঙ্কেত। ধর্মান্তর এজন্যই মহা অশনি সঙ্কেত, কারণ অপরাপর বিচ্যুতিগুলো বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির আলোকে ব্যক্তির বা সমাজের যত না ক্ষতি করতে পারে তার চাইতে ধর্মান্তর বিষয়টি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য এই অবৌদ্ধ দেশে অনেক বেশী পরিমাণে সুদূর প্রসারী ক্ষতি করতে পারে এবং করছে। কিন্তু অপরাপর বিচ্যুতিগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ বা ক্ষুদ্র এই ধারণা করে কোন অবস্থাতেই সহ্য বা মেনে নেবার অবকাশ নেই। কেননা ক্ষুদ্র হতেই বৃহৎএর সৃষ্টি। তথাগত বুদ্ধও ধর্মপদে বলেছেন,
“সামান্য ভাবিয়া পাপে যে উপেক্ষা করে
সে নির্বোধ রাশি রাশি পাপে ডুবে মরে,
বিন্দু বিন্দু বারি যদি হয় সংগঠন
কে না জানে হয় শ্রীঘ্র কলসী পুরণ। ”
দেখা যায় আমাদের অনেক বৌদ্ধ ছেলেমেয়েরা খুব কমই ধর্মীয় বই পঠন-পাঠন করে। তারা তাই ধর্মের গুঢ়তত্ত্ব বা মৌলিক বিষয়, যেমন চারি আর্যসত্য, আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ, কার্য কারণ নীতি, নির্বাণ, কর্ম ও কর্ম ফলের বিষয়; সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে বৌদ্ধ ধর্মের অবস্থান ইত্যাদি সম্পর্কে যথাযথ জানে না। না জানার দরুণ নিজ ধর্ম সম্পর্কে যেমনি তারা অজ্ঞ রয়ে যায় বা ভাসাভাসা জ্ঞানী হয় তেমনি ভাসাভাসা জ্ঞান অনেক ক্ষেত্রে অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী হয়। তাদের অন্য ধর্মীয় সহপাঠি বা লোকদেরকে নিজ ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারে না। সপ্তাহে অনেক যুবক-যুবতী ও উঠতি বয়সীরা একবারও বিহারে যায় না বা বাড়িতে উপাসনা করে না। উল্লেখ্য, বৌদ্ধধর্মে উপাসনা মূর্তিপুজা নয়, অলীক নয় বা আন্দাজে ঢিল ছোঁড়া নয় অথবা লোভযুক্ত প্রার্থনা নয়; বরং সুমহান শিক্ষক, বিশ্বের প্রথম ঐতিহাসিক আধুনিক মানবপুত্রের প্রতি তাঁর উপদেশের জন্য তাঁর প্রতি ও তাঁর ধর্মের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, সত্যক্রিয়া ও অমানবিক তথা আত্মপরের দুঃখ উৎপাদনকারী কর্ম হতে নিজেকে বিরত রাখার শপথ গ্রহণ। পার্শ্ববর্তী মুসলিম সম্প্রদায়ের বন্ধুরা অধিকাংশ যেখানে ৫ বেলা নামায পড়ছে সেখানে বিহারে যাবার ক্ষেত্রে বৌদ্ধ অনেক যুবক যুবতীর অনীহা, অশ্রদ্ধা ও অগৌরব। বিহারে না যাবার দরুণ এবং বাড়িতে উপাসনা না করার দরুণ অন্তরের অস্থিরতা বাড়ে, ধর্মের প্রতি গারবতা, মূল্যবোধ, শ্রদ্ধাবোধ কমে যায়, উপাসনা করার বা বিহারে যাবার পর যে মানসিক তৃপ্তি আসে তা থেকে তারা বঞ্চিত হয়।
বুদ্ধের ধর্ম অন্ধ বিশ্বাস, অতিপ্রাকৃত শক্তি, সৃষ্টিকর্তা বা ভক্তিবাদের উপর স্থিত নয়। এ ধর্ম এসে দেখে পরীক্ষা করে বর্তমান বা চলমান জীবন প্রয়োগ করে চলমান জীবনেই ফল পাবার যোগ্য ধর্ম। কালাম সূত্রে তথাগত বুদ্ধ নিজেই বলেছেন, “শোনা কথায় বিশ্বাস করিও না। বংশ পরম্পরায় প্রচলিত বলে বিশ্বাস করিও না। সর্ব সাধারণে বলেছে বলে বিশ্বাস করিও না। শাস্ত্রে লিখিত আছে বলে বিশ্বাস করিও না। গুরুজন বা বয়োজ্যেষ্ঠরা বলছে বলে বিশ্বাস করিও না। কারো ব্যক্তিত্বের প্রভাবে অভিভূত হয়ে বিশ্বাস করিও না। তর্কের চাতুর্যে বিশ্বাস করিও না। নিজের মতের সাথে মিল আছে বলে বিশ্বাস করিও না। দেখতে সত্য বলে মনে হয়- এ কারণে বিশ্বাস করিও না। এমনকি আমি বুদ্ধ বলছি বলে বিশ্বাস করতে হবে তা নয়। নিজেদের জিজ্ঞেস করÑ এগুলো অযোগ্য কিনা, এগুলো নিন্দার্হ কিনা। এগুলো জ্ঞানীদের দ্বারা নিন্দনীয় কিনা। এগুলো দুঃখ দুর্দশার দিকে পরিচালিত করে কিনা? নিজের বিচার বুদ্ধি, বিচক্ষণতা প্রয়োগ করে যদি দেখতে পাও- এগুলো যুক্তির সাথে মিলে এবং নিজের ও সকলের জন্য মঙ্গলজনক, কল্যাণকর, তাহলে গ্রহণ করবে, এবং সেই অনুযায়ী জীবন যাপন করবে।” তাই বৌদ্ধধর্মের ছয়টিগুণের অন্যতম গুণ বা বৈশিষ্ট্য হলো এটি ‘এহি পস্সিকো’ অর্থাৎ, এই ধর্ম এসে দেখার যোগ্য।
যৌবনের অনুসন্ধিৎসু সময়ে ধর্মীয় বিষয়াদি বা অপরাপর বিষয় সম্পর্কে সন্দেহ-সংশয় মনে আনা অস্বাভাবিক বা অপরাধ নয় বরং না আসাই অজ্ঞানতার নামান্তর। আমাদের অনেক যুবক যুবতীদের মনে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা অন্তরে উদিত হয়, উঁকি মারে, কিন্তু অন্তরে উদিত হওয়া প্রশ্ন, সংশয় বা সন্দেহ যদি মনেই রেখে দিয়ে নিজে নিজে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়া হয় তবে তা নিশ্চয়ই ভাল কোন ফল বয়ে আনে না। মনে উৎপন্ন হওয়া প্রশ্ন নিয়ে বিহারাধ্যক্ষ ভান্তে বা বিজ্ঞ কোন ভিক্ষু বা গৃহির সাথে আলাপ করা যায় তাতে তিনি সন্দেহ বা জিজ্ঞাসার সদুত্তর পাবেন এবং বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান বাড়বে, শ্রদ্ধা বাড়বে যা জীবনের প্রগতির ক্ষেত্রে সহায়ক। আমাদের অধিকাংশ কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী বিশেষ করে তারা যে সময় হতে উপন্যাস, গল্প কাহিনী পড়ার অভ্যাস তৈরী করেন তা সে অনলাইনে হোক বা ছাপানো কাগজের বইয়ে হোক সে সময় হতে পাঠ্য বই, উপন্যাস, কবিতা প্রভৃতি পাঠ করার পাশাপাশি বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শন বা হিতোপদেশমূলক বইগুলো না পড়ার করার দরুণ আগামী জীবনটা ধর্মবোধে উজ্জীবিত হয় না। তবে অবশ্যই মাতা পিতাদের একান্ত কর্তব্য ও দায়িত্ব শৈশবেই এই অভ্যাসটি তাদের সন্তানদের রপ্ত করানো।
আগেই চিহ্নিত করেছি ধর্মান্তর গ্রহণ বর্তমান সময়ে আমাদের যুবক যুবতীদের প্রধান মোহ মলিনতার বিষয়। ধর্মান্তর গ্রহণটা বৌদ্ধ সমাজে দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এটা যেন একটা বিষবৃক্ষ এবং ক্রমান্বয়ে তা বেড়ে বিষফল প্রসব করেই যাচ্ছে। সমাজে যারা উচ্চ শিক্ষিত ,অনার্স পড়ুয়া, মাস্টার্স পড়ুয়া, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারিং বা অন্য কোন ভাল বিষয় নিয়ে লেখা পড়ায় রত সেই ধরণের যুবক যুবতীরাই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ধর্মান্তরের মত বিচ্যুতি ঘটাচ্ছে। যেই ধর্মে তারা ধর্মান্তরিত হয় তারা সেই সেই ধর্ম-পরিবেশের আভ্যন্তরীণ কৃষ্টি, সংস্কৃতি সম্বন্ধে জানে না। তারা শুধু সাময়িক মোহের কারণে ধর্মান্তরিত হয়। না জেনে, না বুঝে শুধু সাময়িক ভালবাসা বা প্রেমাসক্তির টানে ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন ধর্মে, ভিন্ন সংস্কৃতিতে চলে যাওয়া তা অবশ্যই বিজ্ঞতার পরিচায়ক নয়, বরং আত্মঘাতী, সমাজঘাতী। ধর্মান্তরের দিকে ধাবিত হওয়া ভাই বোনদের সর্বাগ্রে চিন্তা করা উচিত নিজের মাতা পিতার কথা। তৎপর ভাই বোন, পরিবার পরিজন এবং সমাজ সম্প্রদায়ের দিকে। মা বাবা তাদেরকে জন্মাবধি লালন পালন করেছে, তাদেরকে শিক্ষিত করেছে বা করছে। তারা ধর্মান্তরিত হলে মা বাবা, ভাই বোন স্বজনদের মাথা সমাজে নত হয়ে যায়। এমনকি অনেক মাতা পিতা রোগ গ্রস্থ হয়ে যান অনেকে আবার হৃদ রোগ বা মানসিক আঘাত-অবসাদ জনিত বিভিন দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মারাও যান। এর দায়ভার ধর্মান্তর হওয়া ভাইটি বা বোনটি এড়াতে পারে না। একজনের ধর্মান্তরের জন্য পরিবারের অপরাপর ভাইবোনদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যা হয়, বিয়ের ক্ষেত্রে ভাল সম্বন্ধ আসে না, তারা সমাজে মুখ দেখাতে পারে না, মাথা উচুঁ করে কথা বলতে পারে না। সভা সমিতিতে মাতা-পিতা, পরিবার-পরিজন লাঞ্ছিত হন। যারা ধর্মান্তরিত হওয়ার রাস্তায় পা বাড়িয়েছে বা বাড়াচ্ছে তারা কি কখনও খবর নিয়েছে শুধু ভালোবাসার টানে যে মানুষকে বিশ্বাস করে জীবন যৌবন সমুদয় সঁপে দিয়ে মা বাবা, ভাই-বোন, পরিবার ও সমাজের সবার মুখে চুনকালি লেপন করে যারা ধর্মান্তরিত হয়েছে তারা কি অবস্থায় আছে? ভালবাসার মানুষটা কি আগের মত তাদের ভালবাসছে, নাকি প্রয়োজন ফুরানোর পর লাঞ্ছিত করছে? সে ধর্মের ভালবাসার মানুষের আত্মীয় পরিজন ও সমাজ কর্তৃক ধর্মান্তরিত ছেলেটি বা মেয়েটি কি সমাদৃত হচ্ছে নাকি বঞ্চনা, লাঞ্ছনা ও অপমান ভোগ করেছে। এ+ বা ভালো রেজাল্ট করে, বৌদ্ধ সমাজের মাতা পিতা বা অপর আত্মীয়ের অর্থে উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে, বৌদ্ধ সমাজের বিভিন্ন ঋণ গ্রহণ করে, সমাজ হতে সংবর্ধনা নিয়ে অন্য ধর্মে মোহ বা প্রেম বশতঃ চলে যাওয়া সমাজের সাথে যেমন বিশ্বাস ঘাতকতা তেমনি নিজের কাছে নিজের চরম বিশ্বাস ঘাতকতাও বটে। মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু, স্বজনের মনে দুঃখ দিয়ে, সমাজের মুখে চুনকালি লেপে আসলে কি ধর্মান্তরিতরা সুখে আছে, থাকতে পারে? এই যে এতোগুলো মানুষের মনে, শুভাকাক্সক্ষীর মনে দুঃখ দিচ্ছে, কষ্ট দিচ্ছে তাদের অভিশাপ কি মোটেও লাগবে না, তারা কি অভিশাপ নিয়ে সুখে থাকবে আদৌ? মা বাবারা যেখানে তাদের ছেলে-মেয়েদের অনেক আশা ভরসা নিয়ে লেখা পড়া শিখিয়ে মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ করার জন্য মুখিয়ে থাকে সেখানে যদি তাদের ছেলে-মেয়েরা এরকম চরম বিচ্যুতিমূলক কাজ করে তা কি মেনে নেওয়া সম্ভব? আর মা বাবার আশাকে জলাঞ্জলী দিয়ে তারা ধর্মান্তরিত হচ্ছে তাদের ছেলে-মেয়েরাও যে একই কাজ করবে না তার নিশ্চয়তা কি?
বর্তমানে Face Book, Twiter, Whatsapp, Viber ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে কিছু ধর্মান্ধ, কাপুরুষ, পরশ্রীকাতর, পরসম্পদলোভী মানুষ লাবণ্যবতী, মেধাবী, উচ্চশিক্ষিতা মেয়েদেরকে ফাঁদে ফেলে বিপথগামী করছে। এ সম্পর্কে আমাদের সকলকে সজাগ-সচেতন হতে হবে।
পার্বত্য এলাকায় দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি সেখানকার দরিদ্র ও অশিক্ষিত বৌদ্ধ জনগোষ্ঠিকে শিক্ষা, চাকরী, স্বাস্থ্যসেবা প্রভৃতির প্রলোভন দেখিয়ে, পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত জিইয়ে রেখে, উস্কে দিয়ে ধর্মান্তর করণের নিরবিচ্ছিন্নতা চালিয়ে যাচ্ছে।
আবার অনেক অভিভাবক নিজেদের অর্থের অহংকারে বা শিক্ষার অহংকারে ছেলেমেয়েদের জন্যে বৌদ্ধ সমাজে উপযুক্ত পাত্র-পাত্রী খুঁজে পান না, তারা অন্য সমাজেই ঘটা তাদের সন্তান-সন্ততিদের বিয়ে দিয়ে নিজেদের স্ট্যাটাস বজায় রাখছে!!!
ধর্মান্তর হবার ক্ষেত্রে যেগুলো পূর্ব কারণ বলে আমার ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে মনে হয় সেগুলো হল-
১. শৈশবে মাতা পিতা কর্তৃক সন্তানদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দান না করা।
২. মা-বাবা ও স্বজনদের প্রতি যুবক-যুবতীদের দায়বদ্ধতার, মূল্যবোধের, সচেতনার অভাব।
৩. অন্য ধর্মের কৃষ্টি-সংস্কৃতি বা রীতিনীতির ব্যাপারে অজ্ঞতা এবং অপরিণামদর্শিতা।
৪.বৌদ্ধ যুবক-যুবতীদের মাঝে পারস্পরিক সৌহার্দ ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে মেলামেশার অভাব।
৫. উচ্চ বিলাসী ও অহংকারী মনোভাব।
৬.‘আমাদের উচ্চ শিক্ষিত মেয়ের উপযুক্ত ও আমাদের মত বিত্তশালী পরিবারের সাথে সম্পর্ক করার মতো পাত্র বৌদ্ধ সমাজে নেই’ মাতা পিতার এমন হীনমন্য, ভয়ংকর ও মিথ্যা ধারণা, এবং সন্তানদের সামনে এ রকম ধারণার প্রকাশ করা।
৭.ছেলে মেয়েরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তারা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে ভেবে মা বাবারা ছেলে মেয়েদের যথাযথ দেখাশোনা করে না।
৮.ছেলে মেয়েদের আচরণগত পরিবর্তন, পড়ার টেবিলে কি করছে, কতক্ষণ বাড়ির বাইরে অসময়ে অযথা সময় কাটাচ্ছে সে ব্যাপারে অভিভাবকদের উদাসীন মনোভাব।
৯. সৎ বন্ধুর সাহচর্যে না গিয়ে অসৎ বন্ধুর সাথে মেলামেশা এবং অভিভাবক কর্তৃক তাদের সন্তানদের বন্ধুটি কে, কোন প্রকৃতির তার ধারণা না রাখা।
১০.অচেনা পরিবশে অসহায়ত্ব ও একাকীত্বের কারণে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরতা বা কোন প্রতিষ্ঠানে চাকুরীরতা পাহাড়ী মেয়েরা যৌন লিপ্সা ও লাম্পট্যের শিকারে পরিণত হওয়া।
১১.নিরন্তর বিদেশী টিভি চ্যানেলগুলোতে যৌন আবেদনময়ী অনুষ্ঠান দেখার ফলে তরুণ ও যুব সমাজের অনেকের মধ্যে বিকৃত কামনার প্রতি আসক্তি বেড়ে যাওয়া।
১২.ক্ষণিকের মোহ, সাময়িক উত্তেজনা ও আবেগ এবং নির্বোধ অনুরাগের বশবর্তী হয়ে সহজ সরল অধিকাংশ ক্ষেত্রে বৌদ্ধ মেয়েরা খারাপ ও লম্পট ছেলেদের সাথে অবৈধ সম্পর্কের জালে আটকা পড়া।
১৩. বিত্তবান ও স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে মেয়েরা অতিরিক্ত আধুনিকতা ও উদারতার নামে বেশী বেশী মেলা মেশার সুযোগ পায় এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
১৪. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিস আদালতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মেয়ে হিসাবে সহজলভ্য ভেবে লম্পট, মাস্তান ও সুযোগ সন্ধানী সহপাঠী ও সহকর্মীর তার বা তাদের পেছনে লেগে পড়া যাদের খপ্পর থেকে ঐ মেয়েদের মুক্ত হওয়া অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
১৫. নিজেদের সুসমৃদ্ধ জীবনাদর্শ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সভ্যতা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না পাওয়ায় ছেলে মেয়েরা গর্বিত মানুষ হয়ে গড়ে না উঠা।
১৬.বিকৃত রুচি ও মানসিকতার বশবর্তী হয়ে উত্যক্তকারী দুশ্চরিত্র, লম্পট, বখাটে ও মাস্তানদেরকে স্মার্ট মনে করা এবং আবার নিজ সম্প্রদায়ের ভদ্র ও চরিত্রবান ছেলেদের আনস্মার্ট মনে করার কারণে অনেক মেয়ের এসব ছেলেদের বিকৃত লালসার শিকারে পরিণত হওয়া।
১৭. দেশী-বিদেশী নানা, স্বার্থান্বেষী, প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক ও ধর্ম ব্যবসায়ী মহল কর্তৃক নানা কৌশলে (প্রলোভন, অর্থ, যৌনতা) যুব সমাজকে বিভ্রান্ত ও উশৃঙ্খল করার মাধ্যমে তাদের স্বধর্ম ত্যাগ অবারিত করা।
১৮.সমাজে অবৌদ্ধসুলভ সংস্কার ও কুসংস্কার জেঁকে বসা। যেমন একজন তথাকথিত যশÑখ্যাতি বা বিত্ত বৈভবসম্পন্ন পরিবারের সাথে আর একটা যশ-খ্যাতি বা বিত্ত বৈভবসম্পন্ন পরিবারের বৈবাহিক সম্বন্ধ হতে হবে। তা না হলে মান মর্যাদা চলে যাবে এই ধরনের মানসিকতা।
১৯. নিজেদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি সম্পর্ক মাতা-পিতা, অভিভাবক ও ছেলে মেয়েরা নিজেরা যথেষ্ট সজাগ ও সচেতন না থাকা।
২০.বৌদ্ধদের উদাসীনতার সুযোগে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহল ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কর্তৃক এ সম্প্রদায়কে গ্রাস করার অপতৎপরতা।
২১.সমাজ নেতৃত্বে পারস্পরিক রেষারেষি, অনৈক্য ও ঈর্ষা পরায়ণতা বিরাজ করা এবং অনেকের মধ্যে আত্ম প্রচারের মানসিকতার কারণে শিক্ষিত যুব সমাজের মধ্যে নিজেদের ধর্ম ও সমাজ সম্পর্কে নিরুৎসাহ ও অনাগ্রহের সৃষ্টি হওয়া।
২২. অনেক পিতা মাতা অভিভাবক আরো ভাল পাত্র চাই এই মনোভাবের বশবর্তী হয়ে মেয়েকে যথাসময়ের পাত্রস্থ না করায় মেয়ের বিপথগামী হওয়ায়।
২৩.বৌদ্ধদের জীবনধর্মী অনেক সংস্কৃতি, পর্ব, অনুষ্ঠান ও আমোদ-প্রমোদ ইত্যাদি হারিয়ে যাওয়া এবং বৌদ্ধদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি হওয়া।
২৪.সমাজের কারো স্বেচ্ছাচারিতা, উচ্ছৃঙ্খলতা, বিপথগামীতা, অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্য সামাজিক চাপ, বিধি নিষেধ, নিন্দা, তিরস্কার, শাস্তি বা কোনো রকম প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, প্রতিকার ও প্রতিবিধানের ব্যবস্থা না থাকায় তরুণ সমাজে স্বেচ্ছাচারিতা বেড়ে যাওয়া।
২৫.বৌদ্ধদের সভা-সমিতিতে গতানুগতিক ধর্মদেশনা ও আলোচনার বাইরে বিজ্ঞান মনস্ক, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলেমেয়ের কাছে ধর্মের যৌক্তিক, বৈজ্ঞানিক, প্রায়োগিক বিষয়গুলোর এবং সামাজিক বিভিন্ন বিচ্যুতির ও তা প্রতিকারের নির্দেশনা আলোচনা হওয়া।
২৬.ধর্ম-দর্শনমূলক বই পাঠে ও ক্রয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করার অভাব এবং ধর্মীয় বিধিবিধানের অধ্যয়নহীনতা।
২৭. ছুটির দিনে বা অবসর সময়ে বিহারে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা
২৮.অভিজ্ঞ ভিক্ষুদের সাথে ধর্মালাপ না করা, ভিক্ষুদের সাথে মিশতে অতিরিক্ত সংকোচ বা ভিক্ষুদের প্রতি অবহেলার মানসিকতা
২৯. ধর্মীয় বিষয়দি সম্পর্কে সন্দেহ উৎপন্ন হলে তা নিরসনার্থে উপযুক্ত ব্যক্তির কাছে না যাওয়া
৩০. শহরাঞ্চলের বিভিন্ন বাসায় অনুষ্ঠিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অনেক পরিবারে শুধু বয়স্কদের উপস্থিতিতে ধর্মানুষ্ঠান করে ছেলেমেয়েদের যার যার রুমে ব্যক্তিগত কাজে নিমজ্জ থাকা; বাসায় ভিক্ষু এসেছে, ধর্মানুষ্ঠান হচ্ছে, ছেলেমেয়েদের উপস্থিত থেকে ভিক্ষুদের সাথে কুশল বিনিময় করা উচিত, ধর্মদেশনা, সূত্রাদি শোনা উচিত এই বোধ জাগ্রত না হওয়া। (১০নং হতে ২৪নং কারণ বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশন কর্তৃক ২০১১ইংরেজীতে প্রকাশিত দীপঙ্কর স্মারকের দুলাল কান্তি বড়ুয়া’র ‘বৌদ্ধদের টিকে থাকতে এবং আবার জেগে উঠতে হবে’ নামক প্রবন্ধ হতে নেয়া)
উল্লেখিত ধর্মান্তরিত কারণগুলোর বাইরে হয়তো আরো কারণ অনুসন্ধিৎসু জন খুঁজে পাবেন। ধর্মান্তর হবার এ কারণগুলো সম্পর্কে যুবক যুবতীদের, অভিভাবকদের সর্বোপরি সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। বাস্তবতাকে ভুলে গিয়ে আবেগবশতঃ ধর্মান্তরের মত বৌদ্ধ যুবক যুবতীদের যে মারাত্মক ব্যাধি হয়েছে তা ধর্মান্তরিতদের জীবনে প্রকৃতার্থেই যেমন সুখ বয়ে আনে না তেমনি তাদের মা বাবারাও আজীবন কষ্টকে লালন করে অনুতাপ-অনুশোচনা করে। এই যে দুঃসময়, ঘোর বিচ্যুতি, মহা অনর্থকর, সমাজ-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য বিধ্বংসী কাজ তা থেকে বৌদ্ধ সমাজের যুবক-যুবতীরা নিজেদের নিরাপদে রাখবে প্রত্যাশা করি। বিশ্বাস করি,
কাটবেই কাটবেই অমানিশা ঘোর
আসবেই আসবেই আলোময় ভোর,
টুটবেই টুটবেই দ্বিধা আর ভয়
আসবেই আসবেই সত্যের জয়।
নিপুন বড়ুয়া চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী থানার অন্তর্গত বঙ্গীয় বৌদ্ধদের খ্যতিসম্পন্ন ও সুপরিচিত শীলকূপ গ্রামের জন্মজাত সন্তান। নিপুন বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে PhD Degree অর্জনের জন্য গবেষণায় নিয়োজিত আছেন। অদ্যাবধি তাঁর বহু প্রবন্ধ ও গ্রন্থ পাঠক মহলে ব্যাপক নন্দিত হয়েছে।