সর্বজন শ্রদ্ধেয় আর্য্যশ্রাবক ডাঃ রাজেন্দ্র লাল মুৎসুদ্দী জন্ম হাটহাজারী থানার গুমানমর্দন গ্রামে। সেই শুভদিনটি ছিল ৮ই জ্যৈষ্ঠ রবিবার ১২৯৫ সন (২৪৩২ বুদ্ধাব্দ_ ১৮৮৮ ইং) পিতা হরচন্দ্র মুৎসুদ্দী ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ সমাজহিতৈষী ব্যাক্তি। তাঁর পুত্রদ্বয় রাজেন্দ্র লাল ও যোগেন্দ্রলাল পিতৃগুণে গুণান্বিত। প্রথমজন হলেন সাধক এবং তাঁর অনুজ খ্যাতিমান সমাজসেবক ও চিন্তানায়ক। আর্য্যশ্রাবক রাজেন্দ্র লাল মুৎসুদ্দী সম্বন্ধে সঙ্ঘনায়ক শ্রীমৎ ধর্মাধার মহাস্থবিরের লেখা হতে যদিও কিছুটা জানা যায় তাঁর জীবনী অদ্যাবধি লিখিত হয়নি। আমরা আশা করি কোন ব্যক্তি এ দুরুহ কাজ করলে সমাজ উপকৃত হবেন। শ্রদ্ধেয় শ্রীমৎ ধর্মাধার মহাস্থবির প্রয়াত প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া (ধর্মবিহারী ভিক্ষু) রচিত “বিদর্শন ভাবনা’ গ্রন্থের অভিমত প্রকাশ করে উল্লেখ করেন “বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে বাংলার সাধকের মধ্যে বিদর্শন সাধকের প্রচলন হয়। আর্য্যশ্রাবক ডাঃ রাজেন্দ্র লাল মুৎসুদ্দী এ বিষয়ে অগ্রণী। ব্রহ্মদেশের ডাইউ নগরীতে বিদর্শনারাম প্রতিষ্ঠা করিয়া তিনি অনেক মুকুক্ষ সাধককে সাধনা_প্রাণালী শিক্ষা দিয়েছেন। তথায় ভিক্ষু উপাসক উপাসিকাদের এক সাধক সম্প্রদায় গড়িয়া উঠে। “বিদর্শন_ভাবনা’র গ্রন্থকার সেই সম্প্রদায়ের অন্যতম কৃতবিদ্যা সাধক। পরম পুজ্যাষ্পদ সাধকপ্রবর জ্ঞানেশ্বর মহাস্থবিরও রাজেন্দ্র লাল মুৎসুদ্দীর নিকট সাধনা প্রণালী শিক্ষা নেন। আর্য্যশ্রাবক রাজেন্দ্র লাল মুৎসুদ্দী সাধনা প্রদ্ধতিসহ বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন দার্শনিক বিষয় বর্মীভাষায় প্রাঞ্জল্ভাবে বুঝাতে পারতেন তাই বার্মার বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জ ও নগরস্থিত ফুঙ্গি-চং (বিহার) হতে আমন্ত্রিত হতেন ধর্ম দেশনার জন্য। বর্মীরা তাঁকে সেয়াড রুপে শ্রদ্ধা করত। এখানে একটি সন্ধ্যায় (১৯৩৭ সালে) তাঁর ধর্ম দেশনার কথা উল্লেখ করছি যা আমাদের স্মৃতিতে চির ভাস্বর হয়ে আছে_ আর্য্যশ্রাবক তাঁর প্রিয় বর্মী শিষ্যসহ ইনসিল (রেঙ্গুনের নিকটবর্তী শহর) বিহারে ধর্ম-দেশনার উদ্দেশ্যে যান। আমি আমার পিতার সাথে তাঁর অনুগমন করি। বিহারে আর্য্যশ্রাবকের উপস্থিতির সাথে সাথে প্রায় শ পাঁচেক উপাসক-উপাসিকা এবং বিহারাধ্যক্ষসহ প্রায় একশত বৌদ্ধ ভিক্ষু দাঁড়িয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। আমি এই অভূত দৃশ্য দেখে পিতাকে প্রশ্ন করি ভিক্ষুমণ্ডলী কেন দাঁড়িয়েছেন; তিনি বললেন তিনি (আর্য্যশ্রাবক) যে সেয়াড (গুরু)। আর্য্যশ্রাবক দেশনা করার সময় ব্ল্যাক বোর্ড ব্যবহার করতেন। বোর্ডে তিনি দুরূহ বিষয় সহজ করার জন্য বিভিন্ন ডাইগ্রাম ও চিন্ত্র আঁকতেন। আরেকটি পন্থার আশ্রয় তিনি নিতেন_ সেটি হচ্ছে তাঁর শিষ্য, জটিল বিষয় যা শ্রোতাদের সহজে বোধগম্য হওয়ার কথা নয়, প্রশ্ন করে গুরু (আর্য্যশ্রাবক) হতে উত্তর আদায় করে নিতেন। বহুদিন পরে বুঝতে পারি তাঁর শিক্ষা পদ্ধতি বর্তমান প্রশ্ন-উত্তরে visual aid মাধ্যমে শিক্ষার মতন। কেবল যে বার্মার ভিক্ষু, উপাসক উপাসিকারা তাঁকে শ্রদ্ধা করত তা নয় এদেশের ভিক্ষুরাও তাঁকে সে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে দেখা গেছে। তিনি যখন অন্তিম শর্য্যায় তখন তাঁর প্রিয় শিষ্য সাধকপ্রবর জ্ঞানেশ্বর মহাস্থবির তাঁকে দেখতে যান এবং তাঁর আশীষ প্রার্থনা পূর্বক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন আর্য্যশ্রাবক মৃদুস্বরে বলেন “আপনি চীবরধারী ভিক্ষু’ আপনিই আশীর্বাদ করুন” গুরু-শিষ্যের সেদিনের ভাব বিনিময়ের ঘটনা গুমানমর্দনবাসীর মনে এখনও চির জাগ্রত। মহান সাধক আর্য্যশ্রাবক ডাঃ রাজেন্দ্র লাল মুৎসুদ্দী রবিবার, ১৪ই অগ্রহায়ণ ১৩৫৯ সন (২৪৯৬ বুদ্ধাব্দর-১৯৫২) পরলোক গমন করেন।
জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক।
তথ্যসূত্র: সঙ্ঘরাজ শ্রী জ্যোতিঃপাল মহাথের কর্তৃক রচিত সাধনার অন্তরায়।