আমা চাঙমা জাদর পত্থম ধর্মগুরু অলাক্কে “লুরী”। ১৮৫৭ সাল’ আগত্তুন ধুরি এই লুরীউন্দোই সমাজর আদং-কাজর,আপদ-বিপদ কাজেদাক। লুরীউনর মন্দিরবোরে “কিয়ং” কদাক। ১৮৫৬ সালত চাকমা রাণী কালিন্দী বার্মাত্তুন নাঙকরা সারমেধ মহাস্থবির ভান্তেরে আনিহ্ রাজগুরু ইজেবে গুজি লোয়্যে। সেক্কেত্তুন ধুরি এই লুরীউন আজি যাদন। ইক্কু হিল সেরে আদে গণা দিয়েন এক্কান জাগাত লুরী কিয়ং আগেদে বানা। ভান্তেউন আহ্ দেজ সংসার দেকখ্য আমা সমাজর মুনুচ্ছরউনে লুরীউনরে এক্কে মাজারা লুগেবার চেলেও চাঙমা রাজা দেবাশীষ রায় দাগী ইয়েন মানি লোই ন পারন। তারার কধা অলদে, লুরীউন আমা চাঙমা সমাজর পোল্যে খেবর ধর্মীয় গুরু, আমা জাদর এক্কান আলাদা মাজারা, ইয়ুনরে মাজারা লুগানা আমাত্তেই কত্তমান গম বজং ওই পারে। যে মানিয়্যে মানিবাক। লুরীউনর পোইদেনে সেক্কে আমলত আমা সমাজত ইক্ক ছড়া মানজোর মুয়্যে মুয়্যে শুনা যেদ। ইক্কু বুড় বুড়িউনত্তুনও দ্বিএক্কা শুনা যায়। সিবে অলদে-
ছড়া আগারে লুরী কিয়ঙ
বৌ ঝিও ন দেলং
বৌও নেই, ঝিও নেই
তোনে পাদে ভাত খেলং।
ধুন্দো সুবোরী বেক খেলং
কাবর সুবরে ঘুম গেলং
কন্না দিলগি ন দেলং
ধর্ম কধা শুনিলং
মন শান্দিয়্যে ঘরত ফিরিলং।
উগুরু ছড়াবোই বুঝা যায়, সেক্কে আমলত লুরীউন কদ যে নাঙকারা এলাক।
তবে, আমার জীবনে আমি এখনও লুরী দেখিনি শুধু লোকমুখে শোনা আর বইয়ে পড়েছিলাম। আসলে বিলুপ্তপ্রায় লুরীদের রক্ষার জন্য সমাজের সর্বস্তরের জনগণের এগিয়ে আসা উচিত। লুরী অধ্যুষিত আঞ্চলের লোকজনকে এ বিষয়ে অর্থাৎ লুরীদের জাতিগত উপকারীতা বিষয়ে সচেতন করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পরেছে। এছাড়াও আমাদের বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরও লুরীদের বিষয়ে মিথ্যা প্রচারণা বন্ধ করে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্প্রীতির মেলবন্ধন করতে হবে।
লুরী বা রাউলী প্রসঙ্গে বোধিলঙ্কার ভিক্ষুর ফেসবুক স্ট্যাটাসের মতামত দিতে গিয়ে উপতিস্য ভিক্ষু কি মতামত দিয়েছেন তা পাঠকগণ অনুধাবন করতে পারেন। তিনি লিখেন-
আমার বন্ধু দুজন লাউরি (লুরি)। তাদের নামগুলো এখন মনে নেই। গত ১৮ই ফেব্রুয়ারী ২০১২ সালে দীঘিনালা স্টেশনে গাড়িতে দেখা হয়। থাকেন দিঘীনালার কোন এক জায়গায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে একটা সময়ে তারাই আমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মীয় কার্যাদি করে দিতেন। বড়দের কাছ থেকে অনেক অবিশ্বাস্য কাহিনী শুনেছি লাউরিদের ধর্মীয় আচারের। সেসব কি যাদু-ইন্দ্রজাল ছিল নাকি বৌদ্ধ ধর্মে বর্ণিত ঋদ্ধি জাতীয় কিছু- এখনো আমাকে ভাবায়। তবে যাই হোক আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ তাঁরাই অতীতে সমাজকে নৈতিক শিক্ষা দিয়ে পরিচালিত করেছিল। আজকে তাঁরা হারিয়ে যেতে বসেছেন। সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে খুঁজলে দু-একজন পাওয়া যেতে পারে হয়ত। তাদের সাথে দেখা হওয়ার পর তাঁদের ধর্ম গ্রন্থ “আগরতারা” নিয়ে একটু জানার চেষ্টা করি। রাঙ্গামাটি উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সিটিউট থেকে প্রকাশিত বই “আগরতারা” ও “মালেনতারা অর্থসার” থেকে অনেক কিছুই জানতে পারি। আগরতারায় ২৮টি তারা (সূত্র) আছে। এই ২৮টি তারা নাকি ২৮ জন সম্যক সম্বুদ্ধের গুণাগুণ বর্ণনা করে লেখা। এই ২৮টি তারা বিভিন্ন উপলক্ষ অনুসারে পাঠ করা হত। গবেষকেরা দাবী করেছেন আগরতারা মূলত ত্রিপিটকের বিভিন্ন সুত্রেরই অপভ্রংশ। নানা কারণে বিলুপ্তি ও বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া বৌদ্ধধর্মকে তারাই মূলত আমাদের মাঝে টিকিয়ে রাখার মহান চেষ্টাটি করেছিলেন।
১৮৫৬ সালে সংঘরাজ সারমেধ ভান্তে আসার পরে আমাদের ধর্মীয় চিন্তায় আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। এর ফল স্বরূপ বর্তমান আমরা। আজকাল লাউরি/লুরি শব্দটি আমাদের কতিপয় সাধক/ভাবনাকারী শীলবান ভান্তেরা একটি ঠাট্টা/মস্করার শব্দ হিসেবে ব্যবহার করেন!!! ইতিহাসকে অস্বীকার করা এই সব তথাকথিত ধ্যানী শীলবান ধুতাঙ্ক ভান্তেরা এককালের আমাদের পূর্বপুরুষদের অসহায়ের সহায় লাউরিদের/লুরিদের অবদানকে ছোট করে কি এমন মহান পরিচয় দেন আমি বুঝিনা!! আমরা যত বড় শিক্ষিত হই,ধার্মিক হই কিংবা জ্ঞানী হই না কেন আমাদের ইতিহাসকে,ঐতিহ্যকে, আমাদের শেকড়কে যেন আমরা ভুলে না যায়,অস্বীকার না করি।
বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় সম্প্রতি বাংলার আধ্যত্মিক সাধক সম্প্রদায় বাউলদের জন্য আশ্রম তৈরি করতে একটি কোটি টাকার কাছাকাছি প্রজেক্ট সরকারী অনুমোদনের জন্য অপেক্ষমান বলে জানি। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের সেরকম আধ্যত্মিক সম্প্রদায় বিলুপ্তপ্রায় লুরি সম্প্রদায়ের সংরক্ষণের জন্যও সদাসয় সরকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এব্যাপারে পার্বত্য তিন জেলার সম্মানিত এমপি মহোদয়েরা নজর দিতে পারেন। কেননা প্রায় বিলুপ্তির পথে আধ্যত্মিক এই সম্প্রদায় কেবল চাকমাদের ঐতিহ্যগত সম্পত্তি নয়, পুরো বাংলাদেশের সম্পদ। তাই লুরিদের সংরক্ষণে সমাজের অগ্রসর মানুষদের এগিয়ে আসা উচিত। প্রয়োজনে বিশ্ব ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কোর সাথেও যোগাযোগ করা যেতে পারে।
রাউলী বা লুরীদের ধর্ম গ্রন্থ বা সূত্র গুলোর বিবরণ দিয়েছেন শ্রদ্ধাজ্যোতিঃ ভিক্ষু। ওনার লেখা ২৮ টি তারা বা সূত্র পাঠক সমাজের জন্য উপস্থাপন করা হল।
লুড়িদের ধর্ম গ্রন্থ গুলো হলঃ-
১. আগর তারা (ধর্মীয় সুত্র) ২.মালেম তারা (এটি ধর্মীয় কাজও জাতি পুজায় ব্যবহার হত । এটি মঙ্গল সুত্রের অনুরুপ) ৩. সাধেংগিরি তারা ( এতে প্রাচীন রাজা সাধেং গিরির বিবরণ আছে এটি শবদাহে ব্যবহার করা হত) ৪. অনিজা (অনিচ্চ)তারা (অনিত্য সংসারের কথা। মৃত ব্যক্তিকে পিন্ড দেওয়ার সময় পাঠ করা হত) ৫. শীল মোগল তারা (এটি জয়মঙ্গল সুত্রের অনুরূপ এবং বিবাহ অনুষ্ঠানে পাঠ করা হয়) ৬. দশো পারামী তারা (দশ পারমিতার অনুরূপ। পিন্ড দানে ব্যবহৃত হত) ৭. ত্রিকুদ্দ তারা ( তিরোকুড্ড সুত্রের অনুরূপ) ৮. রড় কুরুক ও ছোট কুরুক ( এটি মাথা ধোয়া বা শুচিত্ব গ্রহণ করার কাজে ব্যবহৃত হত) ৯. তাল্লিক শাস্ত্র তারা ( এটি চিকিৎসা শাস্ত্র) ১০. আরিন্তামা তারা ( এটি রাজা অরিন্দম উপ্যাখান এবং পিন্ড উৎসর্গ কাজে ব্যবহৃত হত) ১১. রাকেন ফুল তারা ( এটি মৃত ব্যক্তির সাপ্তাহিক বার্ষিক শ্রাদ্ধ কাজে ব্যবহৃত হত) ১২. সাহস ফুল তারা ( প্রেত পূজায় ব্যবহৃত হত) ১৩. আরিন্নামা তারা ( বিবাহ অনুষ্ঠানে পাঠ করা হয়) ১৪. ঝিয়ন ধারণ তারা ( ভ্যাদ্যা বা পিন্ড উৎসর্গ কাজে ব্যবহৃত হত) ১৫. অজিনা তারা (মৃত ব্যক্তিকে মুখে ভাত দিতে ব্যবহৃত হত ) ১৬. পুদুম ফুরু তারা ( পিন্ড দানে ব্যবহৃত হত) ১৭. ফুদুম ফুল তারা (পিন্ড দানে ব্যবহৃত হত) ১৮. সবা দিবা তারা (ভ্যাদ্যা অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হত) ১৯. চেরাক ফুল তারা (ভ্যাদ্যা অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হত) ২০. সানে ফুলু তারা ( পিন্ড ও চান্নূয়া উৎসর্গ কাজে ব্যবহৃত হত) ২১. বুদ্ধ ফুল তারা (পিন্ড ও চান্নূয়া উৎসর্গ কাজে ব্যবহৃত হত) ২২. সাক সুত্তন তারা (আগুনে ভয় বিদুরিত করার জন্য পিন্ড ও চান্নূয়া উৎসর্গ কাজে ব্যবহৃত হত) ২৩. রাজা হোড়া তারা (পিন্ড ও চান্নূয়া উৎসর্গ কাজে ব্যবহৃত হত) ২৪. সরক দান তারা (ধর্ম কাজে ব্যবহৃত হত) ২৫. সুবা দিজা তারা ২৬. শাক্য তারা (ধর্ম কাজে ব্যবহৃত হত) ২৭. ফকিরি তারা ( নীতি জ্ঞান সম্পর্কে) ২৮. আঙারা সুত্র তারা।