বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের একটি প্রতিনিধিদল ১০ অক্টোবর, ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎটি মূলত দেশের সমতল ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের আসন্ন ধর্মীয় উৎসব ‘শুভ প্রবারণা’ এবং ‘কঠিন চীবরদান’ উদ্যাপনকে কেন্দ্র করে ছিল। সেনাপ্রধান এসময় বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা এবং আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের অঙ্গীকার করেন, বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য।
সেনাসদরের বৈঠকের বিষয়টি আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গণমাধ্যমকে জানায়। এতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে দেশব্যাপী পূজামণ্ডপগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে।
পার্বত্য অঞ্চলে নিরাপত্তা সংকট ও বৌদ্ধদের উদ্বেগ
এ বছর পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা—রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবানে বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘ ‘কঠিন চীবরদান’ অনুষ্ঠান উদ্যাপন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে মূল কারণ হিসেবে নিরাপত্তা হীনতা উল্লেখ করা হয়েছে। ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাসের শুরু পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বৌদ্ধ বিহার এবং দোকানপাটে আক্রমণ করা হয়, বুদ্ধমূর্তি ভাঙচুর এবং দানবাক্স লুটের ঘটনা ঘটে।
পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের সভাপতি ভদন্ত শ্রদ্ধালংকার মহাথের জানান, এই সহিংসতার প্রেক্ষিতে পার্বত্য অঞ্চলের বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘ নিরাপত্তার কারণে কঠিন চীবরদান অনুষ্ঠান না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য অঞ্চলে সংখ্যালঘু বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে হামলা এবং লুটপাটের ঘটনা ব্যাপক আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে।
সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
সামাজিক মাধ্যমে এই ঘটনা নিয়ে সাধারণ বৌদ্ধ জনতা এবং পাহাড়িদের প্রতিক্রিয়া তীব্র ছিল। অনেকেই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
Religious Jumm নামে এক ব্যবহারকারী মন্তব্য করেছেন, “ এরা হলো লোভী ভান্তে, তাদের জাত বলে কিছু নেই।লাখ টাকার লোভ সামলাতে পারলো না,এরা কেমন ভান্তে যে বৌদ্ধ জাতিকেও ভুলে গেছে। পার্বত্য জেলায় ভিক্ষু সংঘ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কঠিন চীবর দান করবে না, সহমত না করে,এরিয়ে গেলো দান পাবার আশায়। এক বারও মনে পড়লো না পার্বত্য জেলায় বৌদ্ধকে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে,চিবর পুড়িয়ে দিয়েছে,বিহার ভাংচুর করে দিয়েছে ”
আরেকজন ব্যবহারকারী, Dipak Baru, সরাসরি সেনাবাহিনীর কার্যকলাপকে কটাক্ষ করে বলেন, “বর্তমান সেনাবাহিনী দেশের সুরক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখে না। তাদের উপস্থিতি শুধুই লোক দেখানো। যদি সত্যিই তারা কার্যকর হতো, তাহলে পার্বত্য অঞ্চলে কেন চীবরদান বন্ধ হয়ে যায়?”
অনেক ব্যবহারকারী সেনাবাহিনীর সাথে বৌদ্ধ ফেডারেশনের এই সাক্ষাৎকারকে ‘নাটক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। Aongthoiching Marm মন্তব্য করেছেন, “আমরা আর এই নাটক দেখতে চাই না। যারা আমাদের শত্রু, তাদের নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো মানে নেই।”
Mong Hai Nu Marm স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন খাগড়াছড়ির সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর কথা, যেখানে সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় পাহাড়ি জনগণের ঘর-বাড়ি এবং দোকানপাট পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
ক্ষোভ ও বিভক্তি
সামাজিক মাধ্যমে পাহাড়ি এবং সমতলের বৌদ্ধদের মধ্যে এক ধরনের ভিন্নমত ও ক্ষোভ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। অনেকেই সমতলের বৌদ্ধদের অভিযুক্ত করেছেন যে, তারা পাহাড়িদের দুর্ভোগকে উপেক্ষা করছে। Fx Rijen Chakm মন্তব্য করেছেন, “আজ থেকে আমি আর সমতলের বড়ুয়া বৌদ্ধ বিহারে যাব না। তারা নিজেদের স্বার্থের জন্য পাহাড়িদের কষ্টকে ভুলে গেছে।”
এই ধরনের মনোভাব সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বারবার উঠে এসেছে। U Tun Yei মন্তব্য করেছেন, “উনারা কি জানেন না পার্বত্যাঞ্চলের ভিক্ষুরা এবছর কঠিন চীবরদান অনুষ্ঠান বর্জন করেছেন?”
পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি এবং পার্বত্য বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘের কঠিন চীবরদান অনুষ্ঠান না করার সিদ্ধান্ত সামাজিক মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। অনেকেই সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে সমালোচনা করেছেন এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মতভেদ প্রকাশ পেয়েছে। এ অবস্থায় পার্বত্য অঞ্চলের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা এবং ঐক্য নিশ্চিত করার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করা প্রয়োজন।