সম্রাট অশোকের নাম আজকের দিনে ভারতীয় ইতিহাসে সবার মুখে মুখে, কিন্তু এক সময় এই মহান শাসকের অস্তিত্ব প্রায় বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল। এই গল্পের শুরু কর্ণাটকের একটি ছোট্ট গ্রামে, যেখানে একটি দুর্ঘটনাবশত আবিষ্কৃত হয় অশোকের শাসনামলের অমূল্য প্রমাণ।
১৯১৫ সালে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার সি. বি. রাইস কর্ণাটকের মাস্কি গ্রামে সোনা খুঁজতে গিয়ে কিছু পুরোনো ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এক ধরনের হিজিবিজি লিপি খুঁজে পান। যদিও তিনি তা পড়তে পারেননি, তিনি বিষয়টি ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ব বিভাগের কাছে জানান। তখনই ইতিহাসের এক হারিয়ে যাওয়া অধ্যায় নতুন করে সামনে আসে।
পুরাতত্ত্ববিদরা লিপিটি পরীক্ষা করে আবিষ্কার করেন, এটি সম্রাট অশোকের একটি শিলালিপি। এখানে ‘প্রিয়দর্শী’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল, যা পরে নিশ্চিত করা হয় যে এটি অশোকেরই উপাধি। এর আগ পর্যন্ত কেউ জানত না এই ‘প্রিয়দর্শী’ কে, কিন্তু এই লিপি অশোকের পরিচয় ও তার শাসন সম্পর্কে বহু নতুন তথ্য প্রকাশ করে।
সম্রাট অশোকের পরিচয় ও তাঁর ফিরে আসা
১৮৩৭ সালের ৭ জুন কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সভায় প্রথমবার ব্রাহ্মী লিপির অর্থ উদ্ঘাটন করেন জেমস প্রিন্সেপ। এটি ছিল ইতিহাসের একটি বিরাট পদক্ষেপ, কারণ এই লিপি থেকেই জানা যায় সম্রাট অশোকের সম্পর্কে। প্রাচীন শিলালিপিগুলোতে অশোকের শাসন ও তাঁর জীবনকাহিনি লুকিয়ে ছিল, যা এই উদ্ঘাটনের মাধ্যমে বিশ্বের সামনে আসে।
যদিও ব্রাহ্মী লিপি বেশ পুরোনো, কিন্তু তৎকালীন সময়ে কেউ সঠিকভাবে এটি পড়তে পারত না। প্রিন্সেপ যখন লিপি পড়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, তখন জানা যায় যে শিলালিপিতে যাকে ‘দেবানামপিয়াস’ বা ‘প্রিয়দর্শী’ বলা হয়েছে, তিনিই সম্রাট অশোক। এই শিলালিপি গুলো থেকে বোঝা যায়, অশোক তাঁর শাসনামলে কেবল যুদ্ধ ও সাম্রাজ্য বিস্তার করেননি, বরং এক মহান ধর্মপ্রচারক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
কৌটিল্যের পরামর্শক এবং কলিঙ্গ যুদ্ধ
অশোকের শাসনামল সম্পর্কে আরও বিশদ জানার জন্য কলিঙ্গ যুদ্ধের কাহিনি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর শাসনামলের শুরুতে অশোক ছিলেন এক শক্তিশালী সামরিক শাসক, যিনি নিজ রাজ্যের সীমান্ত বৃদ্ধি করতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ২৬১ খ্রিষ্টপূর্বে সংঘটিত কলিঙ্গ যুদ্ধ, যা তাঁর শাসনামলে অন্যতম বৃহত্তম যুদ্ধ, অশোককে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত করে দেয়।
কলিঙ্গ যুদ্ধ ছিল রক্তক্ষয়ী এবং এতে প্রচুর মানুষ নিহত হন। যুদ্ধের পর, হাজার হাজার মৃতদেহ এবং ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্য অশোকের মনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এই যুদ্ধের পর তিনি সহিংসতা পরিত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নিজের বাকি জীবন ধম্ম (ধর্ম) প্রচারের জন্য উৎসর্গ করেন। এই ধম্ম কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের প্রচার নয়, বরং নৈতিক মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার, এবং অহিংসার উপর প্রতিষ্ঠিত এক জীবনদর্শন।
অশোকের শিলালিপি ও স্তম্ভ
অশোকের শাসনামলে তাঁর আদর্শ এবং বাণীকে জনগণের কাছে পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন স্থানে স্তম্ভ ও শিলালিপি স্থাপন করা হয়। এই স্তম্ভগুলো, যেগুলো প্রায় ৩০ থেকে ৫০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এবং একক পাথর থেকে নির্মিত, আজও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে খুঁজে পাওয়া যায়। স্তম্ভগুলোর উপর খোদাই করা হয়েছে অশোকের বাণী, যেখানে তিনি মানুষকে ধম্মের পথে চলতে এবং অহিংস জীবনযাপনের শিক্ষা দিয়েছেন।
এই স্তম্ভগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল “সারনাথের অশোক স্তম্ভ,” যা ভারতের জাতীয় প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এই স্তম্ভের শীর্ষে রয়েছে চারটি সিংহ, যা ভারতের একতা ও শক্তির প্রতীক। অশোক স্তম্ভের অন্যান্য প্রতীকগুলোর মধ্যে ধর্মচক্র, হস্তী, ষাঁড় প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত।
বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার ও অশোকের ভূমিকা
অশোক বৌদ্ধ ধর্মের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তার শাসনামলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার এক অনন্য মাত্রা পায়। অশোকের নির্দেশে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দল ভারতে এবং দেশের বাইরে বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা প্রচারের জন্য পাঠানো হয়। তাঁর শাসনামলে শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, মিয়ানমার, নেপাল, এবং আরও কিছু দেশে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটে।
অশোক শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকেননি, তিনি তাঁর শাসনের বিভিন্ন প্রশাসনিক, বিচারিক এবং সামাজিক নীতি বৌদ্ধ ধর্মের আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে তুলেছিলেন। তিনি প্রজাদের কল্যাণে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পানীয় জলের জন্য ব্যবস্থা করেছিলেন, যা তৎকালীন সময়ে অসাধারণ উদ্যোগ হিসেবে গণ্য হয়।
সম্রাট অশোকের মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
অশোকের মৃত্যুর পর মউর্য সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে, এবং ধীরে ধীরে তার সাম্রাজ্যটি পতনের দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু তাঁর ধর্মপ্রচার এবং মঙ্গলময় শাসন ব্যবস্থা তাঁর উত্তরাধিকারকে অমর করে রেখেছে।
অশোক ছিলেন ইতিহাসের এক মহান রূপান্তরের প্রতীক—যিনি যুদ্ধবাজ রাজা থেকে অহিংসা এবং ধম্মের ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছিলেন। আজকের দিনে, অশোকের নাম ভারতীয় সংস্কৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে রয়ে গেছে, এবং তাঁর আদর্শ নতুন প্রজন্মের কাছে অহিংসা, ন্যায়বিচার, এবং মানবিকতার শিক্ষা দেয়।
অশোকের শাসনামল প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে আছে, যা আধুনিক যুগেও অনুপ্রেরণা হয়ে রয়ে গেছে।
স্বপ্ন এবং দায়িত্ববোধ থেকে ধম্মইনফো-ডট-কম এর সূচনা। ২০১১ সালে বাংলায় প্রথম অনলাইন বৌদ্ধ সংবাদ পোর্টাল হিসেবে ধম্মইনফো যাত্রা শুরু করে, যা বৌদ্ধধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং নীতিমালা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রচারে পাঠকের ব্যাপক গ্রহণ যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। ২০১২ সালে রামুতে মৌলবাদী হামলার পর এটি একটি শক্তিশালী সংবাদ মাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তর বাংলা ভাষী বৌদ্ধদের কাছে পরিচিতি লাভ করে। যদিও নিরাপত্তাজনিত কারণে ২০১৮ সালে সাইটটি প্রকাশনা বন্ধ করা হয়, ২০২৪ সালে ধম্মবিরীয় ভিক্ষুর নেতৃত্বে এটি আবার চালু হলে ধম্মইনফো বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার, বাংলাদেশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে সংবাদ, ঐতিহাসিক নিদর্শন, মণিষীদের জীবনী প্রকাশ, এবং ধর্মীয় উন্নয়নে কাজ করছে