উপমহাদেশের প্রখ্যাত বৌদ্ধ মনীষা, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব অধ্যাপক, ভারতীয় প্রথম সংঘরাজ অগ্রমহাপণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির। এই জ্ঞানতাপস চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলাধীন ‘ধর্মপুর’ গ্রামে পিতা হরচন্দ্র বড়ুয়া এবং মাতা প্রাণেশ্বরী বড়ুয়ার সংসারে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর গৃহি নাম ছিল বিপিন চন্দ্র বড়ুয়া। তৎকালীন প্রতিকূল শিক্ষাব্যবস্থার কারণে ৩য় শ্রেণিতে পর্যন্ত শিক্ষালাভ করেই তাঁকে থামতে হয়। তেরো বছর বয়সে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৮ জুন পিতা হরচন্দ্র বড়ুয়া পরলোক গমন করলে উক্ত বছরের ২৬ জুন পিতার সাপ্তাহিক সংঘদানানুষ্ঠানে জ্ঞানান্বেষী বিপিনচন্দ্র বড়ুয়া ধর্মকথিক প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবিরের (প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবির ছিলেন অনন্য-সাধারণ গুণসম্পন্ন একজন ‘ধর্মকথিক’। তাঁর অনুপম ধর্মদেশনায় বিমুগ্ধ হয়ে চাকমা রাণী কালিন্দী দেবীর প্রস্তাবে তদানীন্তন ‘সঙ্ঘসম্মিলনী’ তাঁকে ‘ধর্মকথিক’ উপাধিতে বিভূষিত করেন। পরবর্তীকালে তাঁর প্রকৃত নাম প্রজ্ঞালঙ্কার নাম ছাপিয়ে ‘ধর্মকথিক’ নামেই তিনি সুপরিচিত হয়ে পড়েন। (দেখুন, নালন্দা- ধর্মাধার মহাস্থবির জন্মশতবর্ষ স্মরণ সংখ্যা, ৪৫) নিকট প্রব্রজ্যা ধর্মে দীক্ষিত হন। পরবর্তীতে, অধ্যাপক ভগবানচন্দ্র মহাস্থবিরের (১৮৬৪-১৯৫৩) নিকট ধর্মবিনয় শিক্ষা করেন। অতঃপর, ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজগুরু পণ্ডিত ধর্মরত্ন মহাস্থবিরের (১৮৯৩-১৯৬৭) সান্নিধ্যে এসে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপশি ভূজপুরস্থ ইংরেজী স্কুলে ৪র্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ নভেম্বর ‘সত্যদর্শন’ প্রণেতা দার্শনিক-আচার্য বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির (১৮৯০-১৯৬২), সঙ্ঘরাজ বরজ্ঞান মহাস্থবির (১৮৬৭-১৯৩৬), ধর্মকথিক মহাস্থবিরের উপাধ্যায়ত্বে উপসম্পদা লাভ করে ‘ধর্মাধার’ নাম ধারণ করেন। উল্লেখ্য, তিনি আচার্য বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবিরের নিকট কয়েক বৎসর ধর্ম-বিনয় শিক্ষা করে নিজেকে ঋদ্ধ করেন।
১৯২৮-১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি শ্রীলঙ্কার পানাদুরাতে সর্বসিংহলী বংশোদ্ভূত মহাপণ্ডিত আচার্য উপসেন মহাথের, আচার্য বুদ্ধদত্ত মহাথের, আচার্য বাগীশ্বর মহাথের প্রমুখদের কাছে অর্থকথা সহ ত্রিপিটক, বৌদ্ধ দর্শন ও বিজ্ঞান শিক্ষা ও চর্চা করে প্রভূত বুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্ম দেশ (বার্মা, অধুনা মায়ানমার) ভ্রমণ করে স্বদেশে ফিরে আসেন। তারপর শুরু হয় তাঁর কর্মযজ্ঞ। চট্টগ্রামের মহামুনি পাহাড়তলী গ্রামে গড়ে তোলেন পালি কলেজ (১৯৩৩)। তাঁর কর্মধারার মধ্যে আছে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে খাগড়াছড়ি পার্বত্য রাজ্যের মান রাজার ‘রাজগুরু’ পদে অভিষেক, ‘চট্টল ভিক্ষু সমিতি’ প্রতিষ্ঠা, সূত্রপিটকের পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য স্বর্ণপদক লাভ, ১৯৩৪ হতে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ‘বঙ্গীয় সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদ’র অধীনে ‘ত্রিপিটক বিশারদ’ উপাধি লাভ এবং ‘অনাগারিক ধর্মপাল গোল্ড মেডেল’ লাভ প্রভৃতি।
পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির ছিলেন তদানীন্তন সঙ্ঘরাজ ভিক্ষু মহামণ্ডলের সাধারণ সম্পাদক, পরবর্তীতে, তিনি ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে সঙ্ঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়, যা তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ (৪৩ এর রাঠ) হিসেবে খ্যাত ছিল। খাদ্যদ্রব্যের অভাবে বহু মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করেছে। সামনে যা পেয়েছে, তা-ই খেয়ে জীবন বাঁচার চেষ্টায় ছিলেন অসংখ্য বুভুক্ষু মানুষ। পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির তখন অসহায়, গরীব-দুঃখী দুর্ভিক্ষপীড়িত হাড্ডিসার মানুষদের জীবন বাঁচানোর জন্য ‘রিলিফ সেন্টার’ খুলে সাহায্যের ব্যবস্থা করেন। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতার বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর বিহারের (১৮৯২ প্রতিষ্ঠা) দায়িত্ব, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ধর্মাঙ্কুর বিহার চত্বরস্থ নালন্দা বিদ্যাভবনের অধ্যক্ষ পদ গ্রহণ, ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে মায়ানমারে অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ সঙ্ঘায়নে যোগদান, ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর হতে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে যোগদান, ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ হতে দুই বাংলার খ্যাতিমান মুখপত্র ‘নালন্দা’ পত্রিকা প্রকাশ, যেটি অধ্যাবধি চলমান, প্রভৃতির দায়িত্ব গ্রহণ করে সমাজ ও সদ্ধর্মকে বিরল ও উন্নতভাবে সমৃদ্ধ করেছেন।
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ অক্টোবর ভারতের মহারাষ্ট্রের নাগপুরে যেই পাঁচজন ভিক্ষু পণ্ডিত ভিক্ষু কুশীনগর বিহারের অধ্যক্ষ বর্মী বংশোদ্ভূত চন্দ্রমুণি মহাস্থবিরের নেতৃত্বে ভারতের সংবিধান প্রণেতা ও প্রথম আইনমন্ত্রী ড. আম্বেদকর সহ পাঁচলক্ষ দলিত হিন্দুকে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা প্রদান করেছিলেন, তন্মধ্যে ধর্মাধার মহাস্থবির ছিলেন অন্যতম। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১৮ নভেম্বর ‘ভারতীয় সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা’ কর্তৃক পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির মহোদয়কে ভারতের প্রথম ‘মহামান্য সংঘরাজ’ হিসেবে ভূষিত করা হয়; প্রয়াণের আগ-পর্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি এই দায়িত্ব পালন করে সংঘকে নানা দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। তাঁর পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ‘বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা’ কর্তৃক ‘অগ্রমহাপণ্ডিত’ উপাধি লাভ করেন। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি হতে ড. বি.সি. লাহা গোল্ড মেডেল (১৯৯৮) এবং সর্বোপরি অর্জন করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি পুরস্কার (১৯৯১)।
তাঁর প্রখর পাণ্ডিত্যের প্রজ্ঞাদ্যুতিতে তিনি রচনা ও অনুবাদ করেছেন- ১. বৌদ্ধ বন্দনা (১৯৩৮); ২. অধিমাস বিনিশ্চয় (১৯৬৩); ৩. সর্দ্ধমের পুনরুত্থান (১৯৬৪); ৪. বৌদ্ধ দর্শন [রাহুল সাংকৃত্যায়নের রচিত হিন্দি হতে অনূদিত] (১৯৫৬); পালি হতে অনূদিত ৫. ধম্মপদ (১৯৫৪); ৬. মধ্যম নিকায় [দ্বিতীয় খণ্ড] (১৯৫৯); ৭. শাসনবংশ (১৯৬২); ৮. মিলিন্দ-প্রশ্ন (১৯৭৭); ৯. বুদ্ধের ধর্ম ও দর্শন- প্রবন্ধ সংগ্রহ (১৯৭৪) প্রভৃতি। উল্লেখ্য, বিগত ২০২২ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক খ্যাতিমান পণ্ডিত ড. সুমনপাল ভিক্ষুর সম্পাদনায় ‘বোধি-নিধি পাবলিকেশন’, কোলকাতা হতে ‘পণ্ডিত ধর্মাধার অগ্রন্থিত রচনা সমগ্র’ প্রকাশিত হয়েছে। বইটিতে পণ্ডিত সঙ্ঘরাজ ধর্মাধার মহাথেরর যে সকল রচনা, বক্ততা, বিভিন্ন বইয়ে লিখিত ভূমিকা, বিভিন্ন জনকে লেখা গুরুত্বপূর্ণ চিঠি প্রভৃতি অগ্রন্থিত ছিল সেসব সঙ্কলন করে প্রকাশ করা হয়েছে।
এছাড়াও সঙ্ঘরাজ ধর্মাধার মহাস্থবির শতাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর লিখিত বিভিন্ন প্রবন্ধ সমূহ জ্ঞানের এক একটি দিককে যেন উন্মোচিত করে। এসব প্রবন্ধ হতে তাঁর প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের প্রমাণ পাওয়া যায়।
তিনি ছিলেন বড়ুয়া সমাজে জন্মজাত অনন্য এক তথ্যকোষ। পূর্ববাংলা বা অধুনা বাংলাদেশের বিভিন্ন বৌদ্ধ গ্রামের ঠিকুজি ও বংশতালিকা সম্পর্কে তাঁর ছিল প্রচুর জানাশোনা। পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির রচিত বেশ কয়টি গ্রন্থ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য বই হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। স্মতর্ব্য যে, তিনি সুদীর্ঘ সময় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন ও বহু পি.এইচ.ডি ও এম.ফিল অভিসন্দর্ভের পরীক্ষক ছিলেন।
উল্লেখ করতে হয়, পূজ্য ভান্তের কর্মময় জীবনকে স্মরণ করে রাখতে কলকাতায় গড়ে উঠেছে ধর্মাধার সড়ক, সংঘরাজ যুব সমিতি, ধর্মাধার বৌদ্ধ গ্রন্থ প্রকাশনী, ধর্মাধার ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, ধর্মাধার সেবা কমিটি।
তাঁর খ্যাতনামা ছাত্র-শিষ্যগণের মধ্যে মহাপণ্ডিত শান্তরক্ষিত মহাস্থবির, সঙ্ঘরাজ জ্যোতিপাল মহাস্থবির, এইচ সুগতপ্রিয় ভিক্ষু, অধ্যাপক ড. সুকোমল চৌধুরী, অধ্যাপক ড. আশা দাশ, ড. অমল বড়ুয়া, অধ্যাপক ড. বেলা ভট্টাচার্য প্রমুখগণ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। মহাযতি, গ্রন্থধূরের জ্বলন্ত প্রতিভূ, সৌম্য সুন্দর মহাভিক্ষু, অগ্রমহাপণ্ডিত সঙ্ঘরাজ ধর্মাধার মহাস্থবির কলকাতাস্থ বিদর্শন শিক্ষা কেন্দ্র, পটারী রোড বিহারে ৪ নভেম্বর ২০০০ খ্রিস্টাব্দে আনাপান বায়ু ত্যাগ করে মরণ সিন্ধুর পারে গমন করেন।
নিপুন বড়ুয়া চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী থানার অন্তর্গত বঙ্গীয় বৌদ্ধদের খ্যতিসম্পন্ন ও সুপরিচিত শীলকূপ গ্রামের জন্মজাত সন্তান। নিপুন বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে PhD Degree অর্জনের জন্য গবেষণায় নিয়োজিত আছেন। অদ্যাবধি তাঁর বহু প্রবন্ধ ও গ্রন্থ পাঠক মহলে ব্যাপক নন্দিত হয়েছে।