বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার মহামান্য ত্রয়োদশ সংঘরাজ, অগ্গমহাপণ্ডিত, শাসন শোভন, সদ্ধর্মাদিত্য ড. জ্ঞানশ্রী মহাথের ২০২৪ সালে তিনি তাঁর জীবনের শতবর্ষে পদার্পণ করেছেন। দীর্ঘ ১০০ বছরের জীবনে তিনি ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, এবং মানবতার সেবায় নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করেছেন। তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২২ সালে বাংলাদেশ সরকার সংঘরাজ ড. জ্ঞানশ্রী মহাথের কে একুশে পদকে ভূষিত করেছে।
প্রাথমিক জীবন ও ধর্ম যাত্রা
১৮ নভেম্বর ১৯২৫ সালে চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার উত্তর গুজরা ডোমখালী গ্রামে এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি ধর্মের প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন। খুব অল্প বয়সে তিনি ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ১৯৪৪ সালে শ্রামণ্য ধর্ম দীক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি ভিক্ষু হিসেবে উপসম্পদা গ্রহণ করেন। এই সময় থেকে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন এবং প্রবেশিকা পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে অবদান
১৯৫৮ সালে ড. জ্ঞানশ্রী মহাথের পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি জেলায় গমন করেন, যেখানে তিনি স্থানীয় জনগণের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নে নিজেকে নিবেদিত করেন। তিনি ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়, যা পার্বত্য অঞ্চলের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দরিদ্র ও অনাথ শিশুদের জন্য আবাসিক শিক্ষার সুযোগ দেয়। মোনঘর আজও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং হাজারো শিশু এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন জীবন শুরু করেছে। এটি বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম বৌদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও প্রসার
পার্বত্য চট্টগ্রাম ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ড. জ্ঞানশ্রী মহাথের বহু ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়িতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ মন্দির ও শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে এখনো বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে খাগড়াছড়ির গুইমারা মন্দির এবং জয়পুরহাটের বৌদ্ধ শিক্ষা কেন্দ্র, যেখানে শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পাচ্ছে। তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মানিত।
বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে আন্তর্জাতিক অবদান
ড. জ্ঞানশ্রী মহাথেরের শিষ্যরা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্ম প্রচারের কাজে নিয়োজিত। তাঁদের অনেকেই ধর্মীয় ও শিক্ষাগত ক্ষেত্রে অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। মহাথের সবসময় শান্তি, মানবতা এবং কল্যাণের বার্তা প্রচার করে এসেছেন। তাঁর শিষ্যরা আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন, যা দেখে মহাথের সবসময় তৃপ্তি বোধ করেন।
ব্যক্তিগত জীবনদর্শন ও শেষ ইচ্ছা
ড. জ্ঞানশ্রী মহাথের’র ব্যক্তিগত জীবনদর্শন অত্যন্ত সরলতা এবং কৃচ্ছ্রতায় পরিপূর্ণ। তিনি কখনো নিজের জন্য কোনো সম্পদ সঞ্চয় করেননি। তাঁর সমস্ত অর্থ-সম্পত্তি তিনি সমাজ ও মানবতার কল্যাণে দান করেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর দেড় কোটি টাকার সম্পত্তি সংঘের উন্নয়নে ট্রাস্টি করে গেছেন। তিনি চান, তাঁর মৃত্যুর পর কোনো বাড়াবাড়ি যেন না হয় এবং তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অত্যন্ত সরলভাবে ৫-৬ দিনের মধ্যে যেন সম্পন্ন করা হয়। তাঁর এই সরল জীবন ও দানশীলতার মূলমন্ত্র আজও অনুপ্রেরণার উৎস।
পুরস্কার ও সম্মাননা
ড. জ্ঞানশ্রী মহাথের তাঁর জীবনে অনেক সম্মান ও পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু পুরস্কার হলো:
- – শাসন শোভন জ্ঞানভানক (১৯৮১), থাইল্যান্ড
- – বিনয়াচার্য্য (২০০১), বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা
- – মহাসদ্ধর্মজ্যোতিকাধবজ (২০০৭), মায়ানমার সরকার
- – একুশে পদক (২০২২), বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সমাজসেবায় অসামান্য অবদানের জন্য
- – অগ্রমহাপন্ডিত (২০২৩), মায়ানমার সরকার
ড. জ্ঞানশ্রী মহাথেরের জীবন এক নিবেদিত আধ্যাত্মিক ও মানবিক যাত্রা। শতবর্ষ ধরে তিনি ধর্ম, শিক্ষা, এবং মানবসেবায় অসামান্য অবদান রেখে চলছেন। তাঁর দীক্ষা ও শিক্ষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়েছে এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারে তিনি আজও অবিচল রয়েছেন। ড. জ্ঞানশ্রী মহাথেরের জীবনকর্ম শুধু বাংলাদেশেই নয়, আন্তর্জাতিকভাবে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার এবং মানবতার কল্যাণে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
স্বপ্ন এবং দায়িত্ববোধ থেকে ধম্মইনফো-ডট-কম এর সূচনা। ২০১১ সালে বাংলায় প্রথম অনলাইন বৌদ্ধ সংবাদ পোর্টাল হিসেবে ধম্মইনফো যাত্রা শুরু করে, যা বৌদ্ধধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং নীতিমালা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রচারে পাঠকের ব্যাপক গ্রহণ যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। ২০১২ সালে রামুতে মৌলবাদী হামলার পর এটি একটি শক্তিশালী সংবাদ মাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তর বাংলা ভাষী বৌদ্ধদের কাছে পরিচিতি লাভ করে। যদিও নিরাপত্তাজনিত কারণে ২০১৮ সালে সাইটটি প্রকাশনা বন্ধ করা হয়, ২০২৪ সালে ধম্মবিরীয় ভিক্ষুর নেতৃত্বে এটি আবার চালু হলে ধম্মইনফো বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার, বাংলাদেশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে সংবাদ, ঐতিহাসিক নিদর্শন, মণিষীদের জীবনী প্রকাশ, এবং ধর্মীয় উন্নয়নে কাজ করছে