ঢাকার অভয় দাস লেনের ভোলানন্দ গিরি আশ্রমে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এক শান্ত সন্ধ্যা প্রার্থনার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান আতঙ্ক ও শঙ্কার এক স্পষ্ট চিত্র। সান্ধ্য আরতিতে যোগ দেওয়া সুস্মিতা দেবী বলেন, “মন্দিরে নিয়মিত আসলেও এখন একটা ভয় ঢুকে গেছে মনে,”—এবং এই ভয় জন্ম নিয়েছে দেশজুড়ে সাম্প্রতিক হামলার ঘটনাগুলো থেকে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে হিন্দু বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলার ঘটনা বেড়েছে, যা হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকেই এ ধরনের হামলার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন সংখ্যালঘুরা। সুস্মিতা দেবীর মতো অনেকেই সরাসরি হামলার শিকার না হলেও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উপর হামলার কথা তুলে ধরে এই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হামলার প্রতিবাদে গেলো দুই মাস ধরে চলছে বিক্ষোভ-সমাবেশ। এসব সমাবেশে দেখা গেছে সাধারণ হিন্দুদের ব্যাপক অংশগ্রহণ, যেখানে রাজনীতিবিদদের অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। বরং ছাত্র-তরুণদের নেতৃত্বে এই আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং আন্দোলনের সংগঠক নির্মল বিশ্বাস বলছিলেন, “আমরা রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্যে রাজপথে নামিনি, আমরা আট দফা দাবির বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করছি।”
হিন্দু সম্প্রদায়ের আট দফা দাবি
বিক্ষোভকারীরা আটটি প্রধান দাবির পক্ষে আন্দোলন করছেন, যার মধ্যে রয়েছে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার এবং সুরক্ষার জন্য তদন্ত কমিশন গঠন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার, দুর্গাপূজায় পাঁচ দিনের ছুটি, এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘুদের জন্য উপাসনালয় স্থাপন। এই দাবিগুলো নতুন নয়, তবে এবারের আন্দোলন এই দাবিগুলোর সমন্বিত বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ জোর দিচ্ছে।
‘ভোট ব্যাংক’ তকমা কাটাতে চায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়
আওয়ামী লীগের ‘ভোট ব্যাংক’ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এবার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্ষোভও প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলাদেশ হিন্দু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুমন কুমার রায় বলেন, “২০০১ সাল থেকে আজকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের উপর যত অত্যাচার হয়েছে, তার সুষ্ঠু বিচার কখনোই হয়নি।”
তিনি আরো বলেন, “আওয়ামী লীগ হিন্দু বান্ধব বলে দাবি করলেও আমাদের দাবি বাস্তবায়নে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আর এ কারণেই এবার হিন্দুরা আর কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি করবে না।”
সরকারের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনো হিন্দুদের আট দফা দাবির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ধর্ম উপদেষ্টা জানিয়েছেন, “দাবিগুলো সরকারের বিবেচনায় আছে, কিন্তু এগুলো বাস্তবায়নে নির্বাচিত সরকার এবং সময়ের প্রয়োজন।”
তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, তারা কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ না দেখলে আন্দোলন থেকে সরে আসবেন না। বরং তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন যতক্ষণ না তাদের দাবি পূরণ হয়।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা এবং তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি নতুন নয়। তবে এবারের বিক্ষোভ এবং আন্দোলন নতুন ধাঁচের, যেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রভাব নেই এবং সনাতন সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের দাবি আদায়ে মাঠে নেমেছে। সরকারের প্রতিক্রিয়ার অভাবে সংখ্যালঘুদের মধ্যে চরম হতাশা ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলতে পারে।