বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বরাবরই সমাজের একটি অবহেলিত অধ্যায় হিসেবে থেকে গেছে। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার ও এর পরবর্তী সংঘর্ষ কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি বহুবছর ধরে চলমান একটি গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার প্রতিফলন। এই ঘটনাগুলো আমাদের এক কঠিন প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়: আমাদের সংবিধান, যার মূল ভিত্তি সাম্য, ন্যায় ও মানবাধিকার, কি সত্যিই সংখ্যালঘুদের জন্য কার্যকর?
ধর্মীয় সহাবস্থানের সংকট
বাংলাদেশের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও বাস্তবে ধর্মীয় সহাবস্থান এক বড় সংকটে রয়েছে। সংখ্যালঘুদের ভূমি দখল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা, এবং সামাজিক বঞ্চনা যেন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের নেতৃত্বে সংখ্যালঘুদের দাবি আদায়ের চেষ্টা শুধু তাদের মৌলিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য। তার মতো একজন নেতাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করা, প্রশ্ন তোলে যে, দেশে সংখ্যালঘুদের জন্য ন্যায়বিচারের কোনো জায়গা আছে কি?
সরকারের দ্বিমুখী ভূমিকা
বাংলাদেশ সরকার সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিয়ে একদিকে আশ্বাস দেয়, অন্যদিকে কার্যত ব্যর্থ হয় তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মতো নেতাকে চরম দমননীতি দিয়ে থামানোর চেষ্টা সরকারের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। রাষ্ট্রদ্রোহের মতো অভিযোগ তুলে তার আন্দোলনকে দমিয়ে দেওয়ার যে প্রচেষ্টা চলছে, তা আসলে বৃহত্তর সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
সরকার যদি মনে করে শুধুমাত্র বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের আন্দোলন থামানো সম্ভব, তবে তা মারাত্মক ভুল। ইতিহাস সাক্ষী যে, দমননীতি কখনও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান আনতে পারেনি।
সামাজিক অবক্ষয় ও আমাদের দায়
এখানে সাধারণ জনগণের ভূমিকা কী? চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারের ঘটনায় যদি কেউ মনে করে এটি কেবল একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সমস্যা, তবে তা অজ্ঞতার পরিচায়ক। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ যে শুধু সংখ্যালঘুদের জন্য নয়, বরং সমাজের সামগ্রিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য—এটি আমাদের বোঝা জরুরি।
আমাদের সমাজে এমন একটি প্রবণতা দেখা যায়, যেখানে সংখ্যালঘুদের কণ্ঠস্বরকে ‘অহেতুক অভিযোগ’ হিসেবে দেখা হয়। এই মনোভাবই মূলত সাম্প্রদায়িক হানাহানির ক্ষেত্র তৈরি করে। প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হল অন্যায় দেখলে তার প্রতিবাদ করা এবং সবার জন্য ন্যায়ের দাবিতে এগিয়ে আসা।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ভারত ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ইতোমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি সতর্ক সংকেত। দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমালোচনার শিকার হলে তা রাষ্ট্রের মর্যাদা এবং স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলবে।
পরিবর্তনের সময় এখনই
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সংখ্যালঘুদের অধিকার কেবল তাদের নয়, বরং এটি পুরো জাতির সমানভাবে বহন করা একটি দায়িত্ব।
সরকারকে সংখ্যালঘুদের দাবিগুলো মনোযোগ সহকারে শুনতে হবে এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। একইসঙ্গে, সমাজের প্রতিটি স্তরে ধর্মীয় সহনশীলতা এবং ন্যায়ের চর্চা বাড়াতে হবে।
নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে সাম্প্রদায়িকতার শেকল ভেঙে একটি সমতাপূর্ণ এবং সহনশীল সমাজ গড়ার জন্য। এখনই সময় চিন্তা ও চেতনায় পরিবর্তন আনার, নাহলে ভবিষ্যত আমাদের ক্ষমা করবে না।
প্রকাশক ও সম্পাদক, ধম্মইনফো-ডট-কম