বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্প্রতি রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে একাধিক কমিশন গঠন করেছে, যার মূল উদ্দেশ্য সংবিধানকে গণতান্ত্রিক ও কার্যকর করে তোলা। ৭ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত এক সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জনগণের ক্ষমতায়ন ও প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের বিদ্যমান সংবিধান পর্যালোচনা এবং প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন তৈরির জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হলো।” এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাঠামো আরও গণমুখী ও শক্তিশালী করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব না থাকা একটি গুরুতর ব্যর্থতা হিসাবে দেখা দিয়েছে।
রাষ্ট্র সংস্কারের প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট প্রায় প্রতিটি কমিটিতে বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু আদিবাসী কিংবা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাউকে এই প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত করা হয়নি, যা এই জনগোষ্ঠীর কাছে হতাশা ও ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি শুধু জাতিগত বৈচিত্র্যকে উপেক্ষা করে না, বরং রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণকেও বাধাগ্রস্ত করে। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে আদিবাসীরা রাষ্ট্রের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তাদের অবদান রাখলেও, রাষ্ট্রীয় নীতিতে তাদের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ কম।
আদিবাসীদের সংগ্রাম ও সংবিধানে তাদের স্বীকৃতির অভাব
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং পরবর্তী সময়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোতে আদিবাসীরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি। দীর্ঘদিন পরে পঞ্চদশ সংশোধনীতে শুধুমাত্র তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, যা অনেকের মতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা পূরণে অপর্যাপ্ত।
১৯৯৭ সালে আদিবাসী গোলটেবিল বৈঠকে সংবিধান কমিটির প্রধান ড. কামাল হোসেন উল্লেখ করেছিলেন যে, সংবিধানে জাতিসত্তার স্বীকৃতি না থাকাটা একটি বড় ত্রুটি। তার বক্তব্য অনুসারে, যদি নতুন করে সংবিধান লেখার সুযোগ দেওয়া হতো, তবে অবশ্যই সেই বিষয়ে সংশোধন আনা হতো। এই মন্তব্য আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতির জন্য রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারের প্রয়োজনীয়তাকে স্পষ্ট করে তোলে।
সংস্কার প্রক্রিয়ায় আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্তি না থাকা: বর্তমান বাস্তবতা
বর্তমান সরকার কর্তৃক গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিষয়ে কতটুকু সচেতন এবং তাঁদের সংবিধানিক অধিকার সুরক্ষায় কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে আদিবাসী মহলে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। প্রায় ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রাণের দাবি তাদের আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাওয়া। দেশের সচ্ছল নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণের বিষয়টি যেভাবে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে, সেভাবে আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।
আদিবাসীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করা যায়। যেমন, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ধর্মীয় স্থান এবং অন্যান্য স্থানে তাদের প্রবেশাধিকার সীমিত। আদালতে অধিকার রক্ষা ও সম্পত্তির বিষয়ে মামলা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চললেও ন্যায়বিচারের অভাবে আদিবাসীরা অসহায়। আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা দুর্বল হওয়ায় অধিকাংশ আদিবাসী ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
সম্পত্তির অধিকার: সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন
আইনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, আদিবাসীদের সম্পত্তি বিক্রয়ে অবশ্যই এডিসি (রাজস্ব) এর পূর্বানুমতি প্রয়োজন। কিন্তু ক্ষমতাশালীরা প্রভাব খাটিয়ে কিংবা সম্পত্তির প্রমাণকে অবহেলা করে তাদের জায়গা-জমি দখল করে চলেছে। যদিও আদিবাসীদের কাছে প্রয়োজনীয় দলিল-দস্তাবেজ আছে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের সমর্থনের কেউ থাকে না। আদালতে তাঁদের জমি ও বসতভিটার অধিকার নিয়ে অসংখ্য মামলা চলছে, যা যুগের পর যুগ স্থগিত অবস্থায় থাকে। ফলে আদিবাসীরা নিজেদের জমি হারাচ্ছে এবং ধীরে ধীরে স্থানচ্যুত হয়ে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও সংরক্ষিত আসন: অংশগ্রহণ নিশ্চিতের পদক্ষেপ
রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আদিবাসীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত জরুরি। যদি স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করা হয়, তবে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ও ন্যায়বিচারে আদিবাসীরা অবদান রাখতে সক্ষম হবে। স্বাধীনতার পর থেকে যতবারই নারী সংরক্ষিত আসনের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ এসেছে, এতে পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীরা সুযোগ পেলেও বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলের আদিবাসী নারীরা বারবার এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সকল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি অপরিহার্য।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি ও প্রতিকার
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা নিয়োগে উত্তরবঙ্গের আদিবাসীরা আশায় বুক বাঁধলেও, তারা বর্তমানে হতাশায় ভুগছেন। সংস্কার কমিশনের গঠনে আদিবাসীদের প্রতিনিধি না রাখায় আদিবাসী মহলে একটি চরম হতাশা ও হতাশা তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় আদিবাসীদের অবদান সত্ত্বেও, তাদের প্রতি এ অবহেলা বৈষম্যপূর্ন আচরণের একটি উদাহরণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। আদিবাসীরা যে দেশের জন্য তাদের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছে, তার প্রতিদান হিসেবে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব ও উন্নয়নে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়া তাদের প্রাপ্য অধিকার।
রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়ায় তাদের অন্তর্ভুক্তি ছাড়া এই সংস্কার কার্যকরী হবে না। আদিবাসীরা বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠী যারা দেশের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষায় অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা। রাষ্ট্র পরিচালনার মূল চালিকাশক্তি সংবিধান, যা আদিবাসীসহ দেশের সকল জনগণের অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে পারে।
স্বপ্ন এবং দায়িত্ববোধ থেকে ধম্মইনফো-ডট-কম এর সূচনা। ২০১১ সালে বাংলায় প্রথম অনলাইন বৌদ্ধ সংবাদ পোর্টাল হিসেবে ধম্মইনফো যাত্রা শুরু করে, যা বৌদ্ধধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং নীতিমালা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রচারে পাঠকের ব্যাপক গ্রহণ যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। ২০১২ সালে রামুতে মৌলবাদী হামলার পর এটি একটি শক্তিশালী সংবাদ মাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তর বাংলা ভাষী বৌদ্ধদের কাছে পরিচিতি লাভ করে। যদিও নিরাপত্তাজনিত কারণে ২০১৮ সালে সাইটটি প্রকাশনা বন্ধ করা হয়, ২০২৪ সালে ধম্মবিরীয় ভিক্ষুর নেতৃত্বে এটি আবার চালু হলে ধম্মইনফো বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার, বাংলাদেশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে সংবাদ, ঐতিহাসিক নিদর্শন, মণিষীদের জীবনী প্রকাশ, এবং ধর্মীয় উন্নয়নে কাজ করছে