জীবন, দর্শন ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ শিক্ষা ও সমাজগঠনে তাঁর অবদান
সারসংক্ষেপ
রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের (১৯১৯–২০০৮) ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমাজের ইতিহাসে এক অনন্য মনীষী। তিনি একাধারে একজন ত্রিপিটক-পণ্ডিত, বৌদ্ধ শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সংগঠক এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মানবাধিকার বিষয়ে সক্রিয় কণ্ঠস্বর। এই গবেষণাপত্রে তাঁর জন্ম ও পারিবারিক পটভূমি, ভিক্ষুজীবনের সূচনা, ধর্মীয় ও উচ্চশিক্ষা, আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ড, প্রাতিষ্ঠানিক অবদান, সাহিত্যকর্ম, দর্শনচিন্তা এবং মহাপরিনির্বাণ পরবর্তী প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই প্রবন্ধটি উপস্থাপন করা হয়েছে, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের কেবল একজন ধর্মগুরু ছিলেন না; তিনি ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমাজের আধুনিক পুনর্জাগরণের অন্যতম প্রধান স্থপতি।
ভূমিকা
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের এক স্বতন্ত্র ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিমণ্ডল। এই অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক পরিবর্তন, সামাজিক সংকট ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে বৌদ্ধ শিক্ষা ও সংগঠিত ধর্মচর্চা নানাবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়।
এই প্রেক্ষাপটে রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের আবির্ভূত হন এক যুগসন্ধিক্ষণের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে। তাঁর জীবন ও কর্ম পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমাজকে নতুন দিশা প্রদান করে। এই গবেষণাপত্রের উদ্দেশ্য হলো—তাঁর জীবন ও অবদানকে একাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা এবং তাঁর ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিরূপণ করা।
জন্ম, শৈশব ও পারিবারিক পটভূমি

রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের ১৯১৯ সালের ২ নভেম্বর রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার কুতুবদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর গৃহী নাম ছিল ফুল নাথ তঞ্চগ্যা। তিনি এক ধর্মপরায়ণ ও সামাজিকভাবে সম্মানিত তঞ্চঙ্গ্যা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রুদ্রু সিংহ তঞ্চগ্যা এবং মাতা ইচ্ছাপুদি তঞ্চগ্যা সন্তানদের নৈতিকতা, মানবিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার শিক্ষা প্রদান করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের গ্রামীণ বৌদ্ধ সমাজে বেড়ে ওঠার ফলে শৈশব থেকেই তিনি ধর্মীয় আচার, সংঘজীবন ও প্রকৃতিনির্ভর জীবনদর্শনের সঙ্গে পরিচিত হন, যা পরবর্তীকালে তাঁর চিন্তা ও কর্মধারায় গভীর প্রভাব ফেলে।
গৃহস্থ জীবন ও আত্মিক অন্বেষা
সামাজিক রীতিনীতির অনুসরণে তিনি অল্প বয়সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯২৯ সালে চিংপুদি তঞ্চগ্যার সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। তাঁদের সংসারে এক কন্যাসন্তান কনিকা তঞ্চগ্যা জন্মগ্রহণ করেন। গৃহস্থ জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁকে জীবনের অনিত্যতা, দুঃখ ও দায়িত্ববোধ সম্পর্কে বাস্তব উপলব্ধি প্রদান করে।
এই অভিজ্ঞতাই তাঁর মধ্যে গভীর আত্মজিজ্ঞাসা সৃষ্টি করে এবং ধীরে ধীরে তাঁকে সংসারত্যাগ ও ধর্মজীবনের পথে আহ্বান জানায়।
প্রব্রজ্যা ও ভিক্ষু জীবনের সূচনা
২২ বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। তাঁর দীক্ষাগুরু ছিলেন খ্যাতনামা পণ্ডিত ভিক্ষু শ্রীমৎ উ. তিস্স মহাথের। দীক্ষালাভের পর তিনি অগ্রবংশ নাম ধারণ করেন।
১৯৩৯ সালে বগলতলী বিহারের পার্শ্ববর্তী উদকসীমায় তিনি উপসম্পদা গ্রহণ করে পূর্ণ ভিক্ষুতে পরিণত হন। এই সময় থেকেই তিনি সাধনা, অধ্যয়ন ও সমাজসেবাকে জীবনের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন।
ধর্মীয় শিক্ষা ও পালি অধ্যয়ন
অগ্রবংশ মহাথের ইছামতি ধাতুচৈত্য বিহারে শ্রীমৎ পণ্ডিত ধর্মানন্দ মহাথেরের সান্নিধ্যে ত্রিপিটকের সুত্ত, বিনয় ও অভিধম্ম গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন।
১৯৩৫ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত তিনি পালি টোলে আদ্য, মধ্য ও উপাধি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই শিক্ষা তাঁকে পার্বত্য অঞ্চলের অন্যতম প্রধান পালি পণ্ডিত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
উচ্চশিক্ষা ও আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ পরিমণ্ডল
১৯৪৮ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য বার্মা (মিয়ানমার) গমন করেন এবং লেপেডা বিশ্ববিদ্যালয় ও কামায়ুডা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালি সাহিত্যে এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন। বার্মায় অবস্থানকালে তিনি আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ শিক্ষা ও গবেষণার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন।
১৯৫৪–৫৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ বৌদ্ধ সংগীতিতে তিনি সংগীতিকারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যা তাঁকে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ অঙ্গনে সুপরিচিত করে তোলে।
আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ড ও মানবাধিকার ভূমিকা
১৯৭৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতে দীর্ঘকাল অবস্থান করে বৌদ্ধধর্ম প্রচার, গবেষণা ও সমাজসেবায় নিয়োজিত থাকেন। এই সময় তিনি শিশু করুণা সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৮২ সালে নেদারল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত মানবাধিকার সম্মেলনে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাতিষ্ঠানিক অবদান
দেশে ফিরে তিনি ১৯৫৮ সালে পার্বত্য চট্টল ভিক্ষু সমিতি (বর্তমান পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ) প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৬০ সালে রাজবিহারে পালি টোল, পালি কলেজ ও পালি পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করেন।
১৯৬১ সালে তিনি কম্মবাচ্য আচার্য হিসেবে শ্রমণ সাধনানন্দ মহাথের (বনভন্তে)-কে উপসম্পদা প্রদান করেন, যা বৌদ্ধ ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
সাহিত্যকর্ম ও বৌদ্ধ প্রকাশনায় অবদান
তিনি মোট ৩৫টি গ্রন্থ রচনা করেন—এর মধ্যে ১০টি প্রকাশিত ও ২৫টি অপ্রকাশিত। তাঁর রচনাসমূহ পালি সাহিত্য, বৌদ্ধ নীতিশাস্ত্র, দর্শন, নাটক ও কাব্যকে সমৃদ্ধ করেছে এবং পার্বত্য বৌদ্ধ সাহিত্যের একটি শক্ত ভিত্তি নির্মাণ করেছে।
প্রয়াণ
২০০৮ সালের ৫ জানুয়ারি রাত ৯:৩০ মিনিটে রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে তিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর (৬৯ বর্ষা)। রাজবিহারে তিন দিনব্যাপী তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় মর্যাদায় সম্পন্ন হয়।
উপসংহার
রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমাজের এক যুগস্রষ্টা ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবন প্রমাণ করে যে, একজন ভিক্ষু কেবল ধর্মীয় আচারেই সীমাবদ্ধ নন; বরং শিক্ষা, সমাজসংস্কার ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন। তাঁর আদর্শ ও অবদান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
তথ্যসূত্র:
১. রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের, সমবায় বুদ্ধোপাসনা, রাঙ্গামাটি, ১৯৫৯।
২. রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের, বৌদ্ধ পঞ্জিকা, রাঙ্গামাটি, ১৯৬১।
৩. রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের, শ্রমণ কর্তব্য, ভারত, ১৯৭৭।
৪. পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ আর্কাইভ, রাঙ্গামাটি।
৫. ধর্মানন্দ মহাথের, পালি শিক্ষা ও বৌদ্ধ পরম্পরা, চট্টগ্রাম।
৬. Sixth Buddhist Council Proceedings (1954–1956), Myanmar.
৭. রাজবিহার স্মারকগ্রন্থ ও মৌখিক ইতিহাস, রাঙ্গামাটি।
৮. পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী বৌদ্ধ ইতিহাস সংকলন।

প্রকাশক ও সম্পাদক, ধম্মইনফো-ডট-কম
