পরম সম্মানিত প্রধান অতিথি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় ধর্ম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জনাব মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, উপস্থিত আয়ুষ্মান ভিক্ষুসংঘ, অতিথিবৃন্দ, শ্রদ্ধাবান দায়ক-দায়িকাবৃন্দ।
আজিকার এই মহতী অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে আপনারা আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও প্রীতি গ্রহণ করুন। আপনাদের সকলেরই শুভ কল্যাণ কামনা করি। পটিয়া উপজেলার একটি অবহেলিত বৌদ্ধ গ্রামে বাংলাদেশ সরকারের একজন সুযোগ্য মন্ত্রীর আগমনে আমি অভিনন্দিত করছি। আমার মনে হয় এই এলাকায় সরকারের উর্ধ্বতন পর্যায়ের প্রতিনিধির এই প্রথম আগমন। আজ এলাকাটি ধন্য হয়েছে। বৌদ্ধ গ্রামে স্পন্দন জেগেছে। আমি আপনাদের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধান অতিথিকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জ্ঞাপন করছি।
আপনারা জানেন মাননীয় প্রধান অতিথি আমাদের ধর্মমন্ত্রী। বাংলাদেশ বৌদ্ধ-ধর্মের বিকাশে তার ভূমিকা গৌরবের। তিনি বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাষ্টের চেয়ারম্যানও; এই উভয় দায়িত্ব পালনকালে তাঁর প্রজ্ঞা ও বিছক্ষণতার পরিচয় পেয়েছি। আমাদের সরকারও বৌদ্ধদের ও বৌদ্ধ-ধর্মের সমৃদ্ধিতে সর্ব প্রকার সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। কাজেই তাঁর মত একজন বিদগ্ধ ব্যক্তির এই অনুষ্ঠানে যোগদান আমাদের আশান্বিত ও অনুপ্রাণিত করেছে। আমাদের দৃঢ় প্রত্যয় যে, তাঁর মাধ্যমে বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং বৌদ্ধ-ধর্ম সর্ববিধ অগ্রগতিতে গতিবেগ লাভ করবে। আপনার কাছে আজকের এই পুণ্যময় দিনে নিবেদন করব, আমাদের বৌদ্ধ-সমাজ, বৌদ্ধধর্ম এবং বৌদ্ধ বিহারগুলি যাতে অধিকতর হারে উন্নয়ন-পরশ লাভ করে।
হে সজ্জনমন্ডলী, আপনারা জানেন বৌদ্ধ সম্প্রদায় আজ শিক্ষাদীক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নত হলেও পারস্পরিক অবিশ্বাস আর বিরোধে নিজেদের মর্যাদা হারাতে বসেছে। আমাদের সমাজে অর্থের সাথে চিত্তের সংযোগ নাই। অর্থ অনেক সময় কল্যাণের পথে পরিচালিত না হয়ে বিদ্বেষে পরিণত হচ্ছে। এ সময়ে গৃহী সমাজ ও ভিক্ষু সমাজ নেতৃত্বের অহমিকায় দ্বিধাবিভক্ত হতে বসেছে, অথচ এগুলি বৌদ্ধাদর্শ নহে। তথাগত বুদ্ধ বলেছেন, যে জাতি একতাবদ্ধ নহে সে জাতির মঙ্গল নাই। যে জাতি ভিক্ষুসংঘকে সম্মান করে না, প্রাচীন বিহার, চৈত্য ও প্যাগোডাকে রক্ষা করে না, সে জাতির কল্যাণ নাই। যে জাতি পরস্পর পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস হারায় সে জাতির ধ্বংস অনিবার্য। কই আমরা বুদ্ধের শিষ্যেরা সেই বাণীর কতটুকু অনুসরণ করতে পেরেছি? আজকে বৌদ্ধ সমাজে কি ঘটছে! জাতির বিবেকবান ব্যক্তিত্ব আপনারা সত্যিকার আদর্শে উজ্জীবিত হউন এবং অবক্ষয়প্রাপ্ত সমাজকে রক্ষা করুন।
আমি বলতে চাই, সমাজের দুটি চাকা, একটি গৃহীচাকা অপরটি ভিক্ষুচাকা। এই দুটি চাকা একসংগে না চললে প্রগতি সম্ভব নহে। একটির অবক্ষয় অপরটিকে অবক্ষয়ের পথে টেনে আনে, সেইজন্য ভিক্ষুর প্রতি গৃহীর শ্রদ্ধাবোধ যেমন থাকতে হবে, সেই রকম গৃহীর প্রতিও ভিক্ষুর আচরণ সন্তোষজনক হতে হবে, অন্যথায় বিরোধ ও অবিশ্বাসের জন্ম হবে।
প্রাচীনকালে দেখা যায় গৌতম বুদ্ধের ধর্ম ও দর্শনকে এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংঘকে রক্ষার জন্য রাজা শ্রেষ্ঠী ও শ্রদ্ধাবান দায়ক-দায়িকা অভাবনীয় সহযোগিতা প্রদর্শন করেছেন, তাঁরা সর্বপ্রকারের ত্যাগ স্বীকার করে সংঘকে গতিময় করেছেন ঠিক তদ্রুপ বুদ্ধ এবং ভিক্ষু সংঘও বিভিন্ন বিষয়ে রাজা প্রজার সাথে পরামর্শ করেছেন, তাদের সাহায্যে, তাঁদের কল্যাণে অবদান রেখেছেন। উভয়ের মধ্যে ছিল নৈকট্য, শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাস। তাই বৌদ্ধ-ধর্মের অতীত ইতিহাস গৌরবময় ইতিহাস।
বর্তমানে বৌদ্ধ সমাজে উভয়ের মধ্যে সেই মধুর সম্পর্ক নাই- ভিক্ষুরা এখন মানুষের কল্যাণের চেয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মকল্যাণে নিমগ্ন, অহমিকার স্বর্গ-সিংহাসনে চড়ে আধুনিক ভিক্ষু-সমাজ নেতৃত্বাভিলাষী হয়েছে, মিথ্যা ও ছলনার আশ্রয় নিয়ে ক্রমাগত বিরোধ-বিদ্বেষে জড়িয়ে পড়েছে, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে মরণখেলায়ও মেতে উঠেছে। ঠিক তেমনিভাবে গৃহীরা ভিক্ষুদের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেছে, নিজেদের ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠাকে সমুন্নত রাখার জন্য ভিক্ষুদের নানাভাবে অসম্মানি করছে- এমনকি মামলা-মোকদ্দমায়ও জড়িয়ে ফেলেছে। এই যখন সমাজের অবস্থা তখন এই সমাজে কল্যাণকর কিছু আশা করা যায় কি? কাজেই, আর দেরী নয়- চলুন দুর্যোগের পূর্বে আসুন ধর্ম ও সমাজকে রক্ষা করি- আসুন এই দুই শস্তিকে সুসংবদ্ধ করে সমস্ত সংকীর্ণতার বেড়া জালকে উপড়ে ফেলি। আমাদের অতীত গৌরব পুনরুদ্ধার করি।
হে দায়ক-দায়িকাবৃন্দ, আমার জীবনের দীর্ঘতম অভিজ্ঞতায় যেটুকু দেখেছি সেটা হল সমাজের কূপ মন্ডুকতা আর পরশ্রীকতরতা। এসমাজে কৃতজ্ঞতাবোধ নাই। আমার সারা জীবন অতিবাহিত হল মিথ্যাকে জয় করার সংগ্রামে, আমি যদি বিনা বাধায় কাজ করে যেতে পারতাম, তাহলে এই সমাজকে এর চেয়েও বহু উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতাম। আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য দলের কুলের নিকায়ের শতকরা হিসাবের বহু বাধার প্রাচীর তোলা হয়েছিল, এখনও সে ধারা অব্যাহত- আমি কাজ করে যত ক্লান্ত হইনি এই মিথ্যা অহমিকাকে বিচূর্ণ করতে ততোধিক ক্লান্ত হয়েছি। আমি অপরাজেয় মনোবল নিয়ে কাজ করেছি। আমার পেছনে ছিল বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের বিরাট কর্মীবাহিনী। আমার সম্বল ছিল সত্য ও ন্যায়। আমার আদর্শ ছিল মানবকল্যাণ- তাই ঢাকা ও চট্টগ্রামে জনকল্যাণমূখী কমপ্লেক্স গড়ে তুলেছি। শিক্ষার আলো প্রজ্বলিত করে সমাজের অন্ধকার দূরীকরণ কর্মসূচী নিয়েছি। সবচেয়ে যে জিনিষটা আমি করতে চেয়েছি সেটা হল শান্তির স্বেচ্ছাসেবক তৈরী করা। সরকার ও জনগণের সহযোগিতায় আমাদের সাফল্য এসেছে- আমরা আজ বিশ্ব জোড়া পরিচিতি লাভ করেছি। আমাদের সংঘ আজ বিশ্ব-নন্দিত একটি প্রতিষ্ঠান। আমরাই এদেশের বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতিকে বহির্বিশ্বে তুলে ধরেছি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের মৈত্রী সম্পর্ক জোরদার করেছি। বৌদ্ধ সমাজ যখন অগ্রগতির দিকে ধাবমান, সে সময়ে সমাজের বর্তমান অবস্থায় হতাশা বোধ করি।
এই সংকট উত্তরণে আমি জাতির যৌবন-শক্তিকে ডাক দিতে চাই। হে যৌবনশক্তি, তোমরা অংগুলিমালের মত বীর্যবান হও, তোমরা বোধিদ্রম যূলে সিদ্ধার্থ গৌতমের বীর্যের মত প্রদীপ্ত হও। যুবকেরা সবকিছু পারে- তারা শক্তিশালী বৃটিশ সিংহের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে- একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামে দুর্জয় সাহসের পরিচয় দিয়েছে, দেশের স্বাধীনতার জন্য হাসিমুখে শহীদ হয়েছে, কারাবরণ করেছে- আজ সেই যুবকের প্রয়োজন, যারা সমাজের এই বিশৃঙ্খলাকে রোধ করতে পারে। আমার মনে হয় যুবকেরাও বিভ্রান্ত- তারাও সমাজ নায়কের লিজুর হয়ে পড়েছে- নইলে আজকের এই জীর্ণদশা হবে কেন? আজ সত্যিকার যুবক চাই যারা প্রত্যয়ী, সাহসী, উদার, ন্যায়বান, সত্যনিষ্ট ও আদর্শবান। যুবকের ধর্ম তোষণধর্ম হতে পারে না- যখনই যৌবনশক্তি তোষণ নীতির দ্বারা প্রভাবান্বিত হবে তখনই তাদের শক্তির অপচয় হবে। তাই সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে প্রকৃত আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে বর্তমান সমাজকে উদ্ধারের জন্য আমি জাতির যৌবনশক্তির শুভ উদ্বোধন কামনা করে গেলাম।
হে গৃহী সমাজ, আপনারা সৎপথের অনুসারী হবেন, বুদ্ধের নির্দেশিত পথে চলবেন, অন্যায় করবেন না। পঞ্চশীলের মহান নীতিগুলি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবেন। আপনারা যা আজ করবেন তা চারভাগে খরচ করবেন- একভাগ জমা রাখবেন, একভাগ ধর্মকর্ম ও শিক্ষার জন্য ব্যয় করবেন, একভাগ সংসারের খরচের জন্য ব্যয় করবেন, অন্যভাগ দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করবেন। যারা ব্যবসা করেন না তারা ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করবেন। অত্যন্ত হিসেব করে সংযত হয়ে জীবন-যাপন করবেন। সকল প্রকার পাপ কার্য থেকে নিজেদের বিরত রাখবেন। সব সময়ে কুশলকর্ম সম্পাদনে সজাগ থাকবেন এবং নিজের মনকে সত্যিকার ভাবে প্রতিষ্ঠিত করবেন, দেখবেন এতে আপনার নিজের কল্যাণ এবং অপরের কল্যাণ হবে- এভাবেই বৌদ্ধ সমাজের কল্যাণ আসবে।
আমি এই বৃদ্ধ বয়সে আর বেশীদিন আপনাদের কাছে হয়ত আসতে পারব না- তাই আপনাদের প্রতি নিবেদন আপনারা নিম্নের উপদেশগুলি পালন করবেন এতে সকলের কল্যাণ ও মংগল নিহিত আছে-
- ১। আপনারা পঞ্চশীলে প্রতিষ্ঠিত থাকবেন।
- ২। পাড়ায় পাড়ায় সমাজের সঙ্গে একতাবদ্ধ থাকবেন এবং সকল সময়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
- ৩। সমাজের প্রবীনদের, ভিক্ষুদের, সম্মানিত ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা করবেন- তাদের পরামর্শ মতে চলবেন।
- ৪। পরশ্রীকাতর হবেন না এবং অকপটে উপকারীর উপকার স্বীকার করবেন।
- ৫। অন্যায় ও অসত্য পথে না চলে সত্য ও ন্যায়কে জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবেন- সমাজের বিরোধ বিদ্বেষে পক্ষ অবলম্বন না করে এর সত্যিকার সমাধানে আত্মনিয়োগ করবেন।
- ৬। নিজে কাজ করবেন এবং অপরকেও কাজ করতে দেবেন- কোন সময় অন্যের মহৎ কাজে বাধার সৃষ্টি করবেন না- প্রতিহিংসার বশবতী হয়ে অন্যের কর্মসূচীকে বানচাল করার কাজে লিপ্ত থাকবেন না।
- ৭। নিজের কষ্টার্জিত অর্থ মানবকল্যাণে ব্যয় করবেন- এর অপচয় করবেন না। আপনার অর্থ ধর্ম ও সমাজের মংগলে উৎসর্গিত হউক।
মাননীয় প্রধান অতিথিকে ধন্যবাদ দিয়ে উপস্থিত নর-নারীকে আমার শুভেচ্ছা ও শুভাশীর্বাদ দিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করলাম।
“সব্বে সত্ত্বা সুখীতা হোন্তু”
জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক।
স্বপ্ন এবং দায়িত্ববোধ থেকে ধম্মইনফো-ডট-কম এর সূচনা। ২০১১ সালে বাংলায় প্রথম অনলাইন বৌদ্ধ সংবাদ পোর্টাল হিসেবে ধম্মইনফো যাত্রা শুরু করে, যা বৌদ্ধধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং নীতিমালা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রচারে পাঠকের ব্যাপক গ্রহণ যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। ২০১২ সালে রামুতে মৌলবাদী হামলার পর এটি একটি শক্তিশালী সংবাদ মাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তর বাংলা ভাষী বৌদ্ধদের কাছে পরিচিতি লাভ করে। যদিও নিরাপত্তাজনিত কারণে ২০১৮ সালে সাইটটি প্রকাশনা বন্ধ করা হয়, ২০২৪ সালে ধম্মবিরীয় ভিক্ষুর নেতৃত্বে এটি আবার চালু হলে ধম্মইনফো বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার, বাংলাদেশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে সংবাদ, ঐতিহাসিক নিদর্শন, মণিষীদের জীবনী প্রকাশ, এবং ধর্মীয় উন্নয়নে কাজ করছে।