বৌদ্ধরা কর্মফলে বিশ্বাসী এটা সবাই জানেন৷ তাহলে এই কর্মফল বা ভাগ্য জিনিসটা কি বা কেমন তা জানা আবশ্যক৷
বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন, “চেতনাহং ভিক্খবে কম্মং বদামি” অর্থাৎ চেতনাকেই আমি কর্ম বলি, হে ভিক্ষুগণ৷ অনেকগুলি চিত্তের সমন্বয়েই চেতনা৷ আর ঐ চেতনাটাই কর্মফল৷ যা ভাগ্য বলা হয়৷ এই ভাগ্য জিনিসটি কোন অলৌকিক নয়৷ যা একান্তই নিজের প্রকৃতিগত ভাবে সৃষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত৷
অাজ যা ভোগ করছি তা নির্ধারিত করেছিলাম আমি নিজেই৷ এবং ভবিষ্যতে অামি যা ভোগ করব তারও নির্ধারন করছি অাজ আমি নিজেই৷
আমি যদি গত একমাস ধরে সরকারের চাকরিকত্ব না করতাম৷ আজকের এই মাসিক টাকাটি পেতাম না৷ তাহলে আজকে যে অর্থটি পেলাম সেটিতো অামার পূর্ব কৃত কাজেরই ফসল৷ নাকি? ঠিক একই ভাবে, আমি যদি অাজ বিদ্যা অর্জন না করি৷ তাহলে ভবিষ্যতের বিদ্যাহীনতার দরুণ যে ফল লাভ করব তার প্রত্যেকটি কাজের জন্য বর্তমানের আমিই দায়ী৷ ভবিষ্যতে অামার সাথে যা ঘটবে সেগুলির ভাগ্য বিধাতা আজকের অামি৷ আর এখন যা ঘটছে সেগুলিরও ভাগ্য বিধাতা আমিই ছিলাম৷
পৃথিবীতে কোন কিছুই কারণ ব্যতিত হয় না৷
হয়তো আপনারা পদার্থ বিজ্ঞাণে নিউটনের বল প্রয়োগের সূত্রগুলি পড়ে থাকবেন৷
১ম সূত্র—বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু স্থির থাকবে এবং সমবেগে চলতে থাকবে৷
২য় সূত্র—বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হার তার উপর প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক এবং যেদিকে বল প্রয়োগ করা হয় ভরবেগের পরিবর্তনও সেদিকে হয়৷
অর্থাৎ প্রথম সূত্রানুসারে; বল প্রয়োগ না করা পর্যন্ত স্থির বস্তুটি স্থিরই থাকবে৷ এবং যেভাবে চলছিল তার সেভাবেই সমবেগে চলতে থাকবে৷ দ্বিতীয় সূত্রানুসারে; যেই বল প্রয়োগ করা হলো অমনি ঐ বলের সমানুপাতি বেগে ধাবমান হবে এবং যেদিকে বল প্রয়োগ করে সেদিকেই পরিবর্তন হবে৷
অনুরূপভাবে আমাদের মনের গতিও এই প্রাকৃতিক নিয়মের বিপরীত নয়৷ বাহ্যিক চিত্ত যতক্ষন না পর্যন্ত প্রবেশ না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত মন তার স্বাভাবিক গতিতেই চলমান থাকে৷
ধরুন, ধ্যান করার মূহুর্তে মনের গতি স্বাভাবিক তরঙ্গের গতিতেই চলমান থাকবে৷ যেই বাহ্যিক একটা চিত্ত এসে মনকে স্পর্শ করল৷ মনটা অমনি ঐ চিত্তের আঘাতে তার দিকে ধাবমান হবে৷ যেমন উদাহারণ স্বরূপ বলা যায়, যেই ঈর্ষা চিত্ত প্রবেশ করল অমনি ঐ ঈর্ষা চিত্তের উপর মনের আরম্মণ বসে গেল৷ ঐ ঈর্ষার চিত্তের উপর কত কল্পনা-যল্পনা চলে অাসবে৷
কিংবা দানের সময়কেই দেখুন৷ যার আরম্মণ যেদিকে অর্থাৎ যার শ্রদ্ধা বল যেদিকে সে সেদিকের ফল বিবেচনা করেই প্রার্থনা করবে দায়ক৷ কারো শ্রদ্ধা বল থাকে ভোগ সম্পত্তি লাভের দিকে, কারো শ্রদ্ধাবল থাকে দেবত্বের দিকে, কারো থাকে নির্বানের দিকে এবং সে অনুসারেই ফল লাভ করবে৷ অাবার সে ঐটুকুই ফল লাভ করবে যেটুকু শ্রদ্ধাবল ঐ দানের উপর বলবৎ ছিল৷ ঐ চিত্তগুলি সেদিকেই ধাবিত হয় যেদিকে তাদের অধিপতি নির্দেশ করে৷ কখনো ছন্দেশ কারণে পথ পরিবর্তন হয়, কখনো বীর্যের কারণে পথের পরিবর্তন হয়, কখনো চিত্তের কারণেই পথের পরিবর্তন হয়(ছন্দাধিপতি, বীরিযাধিপতি,..)৷
যদি তৃতীয় সূত্রটি( প্রত্যেক বস্তুর সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া অাছে অর্থাৎ যখন কোন একটি বস্তু অন্য একটি বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করে তখন সেই বস্তুটিও প্রথম বস্তুটির উপর বিপরীত দিকে সমান বল প্রয়োগ করে) দেখেন,
অনুরূপভাবে প্রত্যেকটি চিত্তেরও স্ব স্ব প্রতিক্রিয়া অাছে৷ ঐ প্রতিক্রিয়াগুলি তখনি হয় যখন ইন্দ্রিয়সমূহ ঐ চিত্তগুলির সাথে স্পর্শিত হয়৷
যেমন, চক্ষু ইন্দ্রিয়ের সাথে বাহ্যিক রূপের স্পর্শারম্মণে( আলম্বনের দ্ধারা স্পর্শিত) যে বিজ্ঞাণচিত্ত উৎপন্ন হয়৷ সেই বিজ্ঞাণ চিত্ত যদি লোভ চিত্তকে আরম্মণ করে৷ তাহলে ঐ লোভ চিত্তও তার সম্প্রযুক্ত চৈতসিকগুলি দিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাবে৷
যদি ঐ বিজ্ঞাণচিত্ত কুশলকে অারম্মণ করে তাহলে মহাকুশল চিত্তগুলিও তাদের স্ব স্ব প্রতিক্রিয়া দেখাবে৷
বিঃদ্র—যেহেতু কুশল চিত্তের মধ্যেও নানান ধরণের(জ্ঞাণসম্প্রযুক্ত, বিপ্রযুক্ত, সৌমনস্য, উপেক্ষা ভেদে) অাছে৷ তাই এখানে “তাদের” শব্দটি ব্যবহার করেছি৷
অর্থাৎ প্রত্যেকটি চিত্তেরই বল প্রয়োগকারীর দিকে পাল্টা আঘাত হানার স্বভাব ধর্মতা অাছে৷
এমন কোন চিত্ত নেই যেগুলি বলের প্রতিক্রিয়া করে না৷ প্রত্যেকটি চিত্তেরই স্ব স্ব স্ভাব ধর্মতা রয়েছে৷ প্রতিক্রিয়া রয়েছে৷
যদি লোভারম্মণের(লোভ চিত্তের উপর অালম্বন করে) হয় অর্থাৎ সরাসরি যদি বলি, কেউ যদি লোভনীয় দৃষ্টিতে দেখে৷ তাহলে ঐ মুহুর্তে ঐ লোভ চিত্তের সাথে যতগুলি চৈতসিক সম্পর্কিত আছে৷ ঐ সবগুলি চৈতসিকই চলে আসবে৷ এবং তাদের মধ্য থেকে ঐ চৈতসিকটাই বলবান হবে যেটা পূর্ব লোভ চিত্তের সাথে সহজাত ধর্মরূপে অবস্থান করে৷ আপনি লোভ করছেন একজন নারীর প্রতি৷ কিন্তু সেই লোভনীয় দৃশ্যটি প্রথমেই প্রকাশিত হবে আপনার রূপের মধ্যেই৷ পাওয়া না পাওয়া পরের ব্যাপার৷ যেমনি লোভ করলেন তেমনি ঐ লোভটা আপনার রূপের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে গেল৷
একজন প্রেমিক বিরহের যন্ত্রনা যখন অনুভব করে৷ তখন সেই যন্ত্রনাটি কোন ঈশ্বর বা ভগবানে প্রদত্ত নয়৷ ঐ যন্ত্রনাগুলি কেবল তার মনের দ্ধারাই সৃষ্ট কষ্টের অনুভূতি মাত্র৷
আপনি যখন সুখে থাকবেন তখন আপনার চেহারা থাকবে একধরণের৷ অাবার যখন খুব কষ্ট যন্ত্রনায় থাকবেন তখন থাকবে আরেক ধরণের৷ সামান্য রূপের এই পরিবর্তনও যে আপনার মনের উপরেই নির্ভর করে৷ কিন্তু সেগুলি আপনার দৃষ্টিগোচরীভূত নয়৷ অথচ এই রূপের কারণ আপনার ঐ পূর্ব ক্রোধ চিত্তগুলি৷ অর্থাৎ আপনি ক্রোধের উপর যেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবেন ক্রোধও একইভাবে আপনার উপর প্রতিক্রিয়া দেখাবে৷ এগুলোই যে চিত্তের ফল৷
এভাবে অনেকগুলি চিত্তের সমন্বয়ের ফলে যে চেতনা৷ সেটাই বিশাল কর্মের রূপ নেয়৷ অার ঐ চেতনাটাই আপনার বর্তমান ফলের কারণ৷ ঠিক একইভাবে, আপনি বর্তমানে যে লোভ চিত্ত, দ্বেষ চিত্ত, কামরাগ চিত্ত, অহংকার চিত্ত, হিংসা চিত্ত, পরশ্রীকাতরতা চিত্তগুলির উপর রমিত হচ্ছেন৷ এই চিত্তগুলি একসময় আপনাকে আক্রমন করবে৷ প্রত্যেকটি চিত্তেরই প্রতিক্রিয়া অাছে এবং সে অনুসারেই বল প্রয়োগ করে৷ কিন্তু ঐ বলের চাইতেও যদি অারেকটি শক্তিশালী বল প্রবেশ করে৷ তাহলে পূর্বের বলটি(শক্তি) ক্ষীন হয়ে যায়৷ এবং অকেজো হয়ে যায়৷ যদি পূর্বের বলটির মধ্যে সুপ্ত বল থাকে তাহলে কোন একসময় পুনঃ সঞ্চালিত হয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাবে৷ অার এই প্রতিক্রিয়াগুলিই মানুষের স্ব স্ব ভাগ্যের কারণ৷
যদি পট্ঠান অনুসারে দেখি, “পুরিমা পুরিমা অকুশলা ধম্মা পচ্ছিমানং পচ্ছিমানং অকুশলা ধম্মানং নিস্সয পচ্চযেন পচ্চযো৷”
অর্থ, পরের যে অকুশল ধর্মগুলি(চিত্তগুলি) উৎপন্ন হবে সেগুলি বর্তমানের অকুশল ধর্মের(অকুশল চিত্তগুলির) উপরই নির্ভর করে উৎপন্ন হয়৷
অর্থাৎ দ্বিতীয় বা পরের চিত্তগুলি সেদিকেই ধাবমান হবে প্রথম চিত্ত যেদিকে থাকে৷ পূর্বে অকুশল থাকার কারণে পরের চিত্তগুলিও ঐ অকুশল ধর্মের উপর নির্ভর করে অকুশলই উৎপন্ন হবে৷
এভাবে মানুষ প্রতিনিয়ত ঐসব চিত্তের উপর রমিত হয়৷ এবং তার প্রত্যেকটি চিত্তের জন্যে, চেতনার জন্যে ফল ভোগ করে৷ এটাই ঐ চিত্ত-চেতনাগুলির ফল৷ যা কর্মফল নামে পরিচিত৷
অার এই কর্মফলগুলি কোন ঈশ্বর বা ভগবানের দ্ধারা নির্ধারিত নয়৷ মানুষ নিজেই নিজের কর্মফল এভাবেই তৈরী করছে প্রতিনিয়ত৷ অার প্রাকৃতিকভাবেই এই ফলগুলি ভোগ করছে৷ এই ভাগ্য বা কর্মফল জিনিসটি কোন অলৌকিকও নয়৷ সম্পূর্ণ কারণজিত ফল, একটির কারণজনিত অারেকটি উৎপন্ন হওয়া মাত্র৷ অার যদি অলৌকিক ভাবেন তাহলে প্রতিটি মূহুর্তে উৎপন্ন অাবেগ, অনুভূতি, বিরহের বেদনা, মানসিক যন্ত্রনা সবগুলোই অলৌকিক৷ যা অদৃশ্যভাবে এসে অাপনাকে দুঃখ দিচ্ছে৷
চিত্তের প্রতিক্রিয়াগুলোই কর্মফল৷
তরুণ একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু আশিন ধর্মপালা। ধর্ম – বিনয়ে পাণ্ডিত্যের অধিকারী ধর্মপালার লেখাতে মানব জীবনের দৈনন্দিন বিষয়েগুলো অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও সহজবোধ ব্যাখ্যায় ফুটে উঠে।