তথাগত গৌতম বুদ্ধ জনসাধারণ বুঝার উদ্দেশ্যে পালি ভাষায় তাঁর ধর্ম দর্শন প্রচার করেছিলেন । যার ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে পালি চর্চা শুরু ও জনপ্রিয়তা পেতে থাকে । ঊনবিংশ শতকে ভারতবর্ষে নবজাগরনের শুরু দিকে প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে পালি টোল স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বাঙ্গালী বৌদ্ধরা পালি ভাষার বিষয়ে গুরুত্বরোপ করেন । পালি ভাষার শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখে দিলে সর্ব প্রথম মহামনি পাহাড়তলী গ্রামে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ঊনাইনপুরা নিবাসী দ্বিতীয় সংঘরাজ পূর্ণাচার ধর্মধারী চন্দ্রমোহন মহাস্থবির (১৮৩৪-১৯০৯) ও তৃতীয় সংঘরাজ জ্ঞানালঙ্কার মহাস্থবির (১৯৩৮-১৯২৭) এবং জমিদার হরগোবিন্দ মুৎসুদ্দি (১৮৪৩-১৯১৪) পৃষ্ঠপোষকতায় পালি টোল প্রতিষ্ঠা করা হয় । এছাড়া বৈদ্যপাড়া নিবাসী অগমহাপণ্ডিত প্রজ্ঞালোক মহাস্থবির (১৮৭৯-১৯৭১) কর্তৃক নাইখাইন সন্তোষালয় বিহারে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে পূর্ণাচার পালি টোল স্থাপন করেন ।
বৃটিশ শাসনামলে বৌদ্ধ বিহার ভিত্তিক পালি টোল প্রতিষ্ঠা করার জন্য আরো যারা অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন, তাদের মধ্যে ঊনাইনপুরা নিবাসী কর্মযোগী কৃপাশরণ মহাস্থবির (১৮৬৫-১৯২৬), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (১৮৬৪-১৯২৪), নাইখাইন নিবাসী বিনয়াচার্য বংশদীপ মহাস্থবির (১৮৮০-১৯৭০), চত্তরপেটুয়া নিবাসী অধ্যাপক সমন পূন্নানন্দ স্বামী (১৮৭০-১৯২৮), আধাঁরমানিক নিবাসী সংঘনায়ক প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবির (১৮৮৩-১৯৬০), তালসরা নিবাসী পণ্ডিত প্রজ্ঞাতিষ্য মহাস্থবির (১৮৭১-১৯৫২), মির্জাপুর নিবাসী সংঘরাজ ধর্মানন্দ মহাস্থবির (১৮৭৩-১৯৫৭), কুলকুরমাই নিবাসী রাজগুরু ধর্মরত্ন মহাস্থবির (১৮৯৩-১৯৬৭), নজরটিলা নিবাসী পণ্ডিত ধর্মালোক মহাস্থবির (১৮৯০-১৯৬৬), শুকবিলাস নিবাসী রাজগুরু ভগবান চন্দ্র মহাস্থবির (১৮৬৪-১৯৫২), করল নিবাসী পণ্ডিত প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবির (১৮৬১-১৯৩৮), শিলক নিবাসী কবিধ্বজ্জ গুনালঙ্কার মহাস্থবির (১৮৭৪-১৯১৬), কড়ৈয়ানগর নিবাসী উ: কেতুমালা মহাস্থবির, আর্যবংশ মহাস্থবির (১৮৯৪-১৯৬৮), শীলকূপ নিবাসী বিনয়াচার্য অগ্রলঙ্কার মহাস্থবির (১৮৮৬-১৯৭৬), মিঞ্জিতলা নিবাসী সংঘরাজ অভয়তিষ্য মহাস্থবির (১৮৮৫-১৯৭৪), মুকুটনাইট নিবাসী জ্ঞানীশ্বর মহাস্থবির (১৮৮৭-১৯৭৪), ধর্মপুর নিবাসী ধর্মাধার মহাস্থবির (১৯০১-২০০০), চাম্বল নিবাসী জ্ঞানসেন মহাস্থবির (১৮৯০-১৯৭৭), দমদমা নিবাসী আনন্দ মহাস্থবির (১৯০৮-১৯৯৫), পাহাড়তলী নিবাসী ড. বেনীমাধব বড়ুয়া (১৮৮৮-১৯৪৮), কর্তালা নিবাসী ডা: শান্ত কুমার চৌধুরী (১৮৮৩-১৯৩৬), পাইরোল নিবাসী পণ্ডিত গিরিশ চন্দ্র বড়ুয়া (১৮৭৯-১৯৬৩), পাহাড়তলী নিবাসী পণ্ডিত বীরেন্দ্র লাল মুৎসুদ্দি (১৮৭৪-১৯৪৮), ব্যারিস্টার ড. অরবিন্দ বড়ুয়া (১৯০২-১৯৭৫) প্রমুখ ।
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ২১ শে মে সাংগঠনিক ভাবে অবিভক্ত ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম, বিনয় ও সদ্ধর্ম প্রচার প্রসার মানসে এবং পালি শিক্ষা বিস্তার তৎকালীন বার্মা সিংহল থেকে বুদ্ধের ধর্ম ও পালি ভাষায় ত্রিপিটক বিশারদ শিক্ষা প্রাপ্ত ভিক্ষুরা সন্মেলিত ভাবে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট পণ্ডিত ভিক্ষুদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় “জিনসাসন সমাগম” নামে ভিক্ষু সমিতি । এর প্রধান উদ্যােক্তা ছিলেন বংশদীপ মহাস্থবির ও জ্ঞানীশ্বর মহাস্থবির মহোদয় । সমন পূন্নানন্দ স্বামী এবং প্রজ্ঞালোক মহাস্থবির যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিবার্চিত হন । এই সমিতির মূল উদ্দেশ্যের একটি হলো সরকারী অনুমোদনের মাধ্যমে প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে পালি টোল প্রতিষ্ঠা করে পালি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা । পালি টোল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সমিতির কর্মকর্তাগন অধ্যাপক সমন পূন্নানন্দ স্বামী উপর দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তিনি এই বিষয়ে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন । ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ১১ ফেব্রুয়ারী তাহার নেতৃত্বে সরকারী ভাবে কলকাতা সংস্কৃত বোর্ড কর্তৃক পালি শিক্ষা অনুমোদন লাভ করে । জিনসাসন সমাগম ও সমন পূন্নানন্দ স্বামী অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সর্ব প্রথম সরকারী সুযোগ সুবিধা নিয়ে বৌদ্ধ বিহারে পালি টোলের মাধ্যমে পালি শিক্ষা শুরু হয় ।
১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে বাকখালী পালি টোল । ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ঊনাইনপুরা পালি টোল । ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ কর্তালা পালি টোল । ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মহামুনি পালি কলেজ । ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা নালন্দা বিদ্যাভবন । ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে মির্জাপুর গৌতমাশ্রম পালি টোল । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম বিনাজুরী পালি টোল । ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে কর্তালা প্রজ্ঞালঙ্কার পালি কলেজ । ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব জোয়ারা শ্রদ্ধানন্দ পালি টোল । ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে রাজানগর রাজবিহার পালি টোল । ১৯৩৮ খিস্ট্রাব্দে সাতবাড়িয়া প্রজ্ঞালঙ্কার পালি টোল । ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে পিঙ্গলা রত্নাঙ্কুর পালি টোল । ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে পাঁচরিয়া অজান্তা পালি টোল । ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে পূর্বগুজরা অগগসার পালি টোল । লাখেরা অভয় পালি টোল । বেপারিপাড়া রত্নাঙ্কুর পালি টোল । ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে কর্তালা এংলো পালি কলেজ । ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে দমদমা পালি টোল । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বিনাজুরী শ্মশান বিহারে পালি টোল । ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কৈড়য়ানগর পালি টোল । ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে আলোকদিয়া সূর্যমনি পালি টোল । ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে কুমিল্লা বঁরইগাও পালি কলেজ । ১৯৩১ খিস্টাব্দে জলদী পালি টোল । ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে উখিয়া পাতাবাড়ী পালি টোল । ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে শিলং পালি টোল । উপরে উল্লেখিত অনেক পালি টোল আবার কলেজে রুপান্তরিত হয় ।
কলকাতা নালন্দা বিদ্যাভবন ।
১৯৩৫ খ্রি. কলকাতা বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভার উদ্যোগে পণ্ডিত বংশদীপ মহাস্থবির (১৮৮০-১৯৭০) ও পাহাড়তলী নিবাসী ড. বেনী মাধব বড়ুয়া (১৮৮৮-১৯৪৮) প্রচেষ্টায় এবং কর্তালা নিবাসী ডা: শান্ত কুমার চৌধুরী (১৮৮৩-১৯৩৬) সম্পাদকত্বে কলকাতা ধর্মাঙ্কুর বিহারে “নালন্দা বিদ্যাভবন” প্রতিষ্ঠিত হয় । ১লা জুলাই বিদ্যাভবনের দ্বারোদঘাটন করেন পণ্ডিত ড. বিমলা চরণ লাহা (১৮৯২-১৯৬৯) মহোদয় । পাইরোল নিবাসী পণ্ডিত গিরিশ চন্দ্র বড়ুয়া (১৯৯১-১৯৬৩) মহোদয় সম্পাদক নির্বাচিত হন । এ সময় বংশদীপ মহাস্থবির কলকাতা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে বারশত টাকা মন্জুরী আদায়ের ব্যবস্থা করেন । বরদার মহারাজ ধর্মাঙ্কুর বিহার পরিদর্শনে আসলে তিনি ও একহাজার টাকা বিদ্যাভবনের জন্য দান করেন ।
নালন্দা বিদ্যাভবনের অধ্যাপনার কাজে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে- ড. বেনী মাধব বড়ুয়া (১৯৮৮-১৯৪৮), কৈড়য়ানগর নিবাসী আর্যবংশ মহাস্থবির (১৮৯৪-১৯৬৮), বৈদ্যপাড়া নিবাসী পণ্ডিত প্রজ্ঞানন্দ মহাস্থবির (১৮৯২-১৯৬২), ধীরানন্দ মহাস্থবির, মিঠাছড়ি নিবাসী ধর্মপাল মহাস্থবির (১৯২৫-২০০৯), অনোমদর্শী ভিক্ষু, পণ্ডিত গিরিশ চন্দ্র বড়ুয়া (১৮৯১-১৯৬৩), ঊনাইনপুরা নিবাসী শীলানন্দ ব্রক্ষচারী (১৯০৭-২০০২), ঢেমসা নিবাসী অনাগরিক মুনীন্দ্রজী (১৯১৫-২০০৩) প্রমুখ অন্যতম ।
নালন্দা বিদ্যাভবন সর্ম্পকে মিঠাছড়ি নিবাসী অখিল ভারতীয় সংঘনায়ক ধর্মপাল মহাস্থবির (১৯২৫-২০০৯) মহোদয় তাহার “কোথায় জগজ্যােতি জবাব” পুস্তিকায় ২ পৃষ্ঠা উল্লেখ করেন— কর্মবীর কৃপাশরণ মহাস্থবির (১৮৬৫-১৯২৬) অপরিসীম আত্মত্যাগ ও জনসাধারণের অকুন্ঠ সহযোগিতায় ধর্মাঙ্কুর বিহার সভার (১৮৯২খ্রি.) তাহার জীবদ্দশায় এই সকল কার্য সুচারুরূপে সম্পাদিত হইত কিন্তু তাহার লোকান্তরের পর এই সকল কাজ প্রায় বন্ধ হইয়া যায় । কর্তালা নিবাসী বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভার সাধারণ সম্পাদক ডা: শান্ত কুমার চৌধুরী (১৮৮৩-১৯৩৬) মহোদয় ও বিহারাধ্যক্ষ বংশদীপ মহাস্থবির (১৮৮০-১৯৭০) মহোদয়ের আমলে পাহাড়তলী নিবাসী ড. বেনী মাধব বড়ুয়া (১৯৮৮-১৯৪৮) “নালন্দা বিদ্যাভবন” প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাহাদের প্রচেষ্ঠায় দানবীর শেঠ যুগল কিশোর বিড়লা (১৮৮৩-১৯৬৭) কর্তৃক ধর্মাঙ্কুর বিহারে ত্রিতল ভবন (আর্য ভবন) প্রতিষ্ঠিত হয় ।
তাহার ঐ পুস্তিকায় ১৫ পৃষ্ঠা আরো উল্লেখ করেন— আমরা সকলে জানি শ্রদ্ধেয় বংশদীপ মহাস্থবির বিহারাধ্যক্ষ এবং কর্তালা নিবাসী নিঃস্বার্থ কর্মী ডা: শান্ত কুমার চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন ড. বেনী মাধব বড়ুয়া প্রচেষ্টায় বিড়লাজী ত্রিতল ধর্মশালা প্রস্তুত হয় । এই কথা বড়ুয়া সমাজ এখন ও স্মরণ করেন । তখন সমাজ ৫০ বৎসর আগাইয়া গিয়াছে ।
“নালন্দা বিদ্যাভবন” সর্ম্পকে বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির ভূতপূর্ব সাধারণ সম্পাদক কিরিটী বিকাশ বড়ুয়া (১৯২৬-২০০৪) মহোদয় ১৯৭১ খ্রি. ৭ই মার্চ পণ্ডিত বংশদীপ মহাস্থবিরের অন্ত্যােষ্টিক্রীয়া উপলক্ষে তাহার লিখিত অভিভাষণে উল্লেখ করেন—– কলকাতা বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর বিহারের অধ্যক্ষ থাকাকালে বংশদীপ মহাস্থবিরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং বেঙ্গল বুড্ডিষ্ট এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কর্তালা গ্রামের কৃতিপুরুষ ডা: শান্ত কুমার চৌধুরী (১৮৮৩-১৯৩৬) ও পাহাড়তলী নিবাসী বিশ্ববিশ্রুত পণ্ডিত ড. বেনী মাধব বড়ুয়া (১৮৮৮-১৯৪৮) ডিলিট মহোদয়ের বলিষ্ট সহায়তায় এবং দানবীর শেঠ যুগল কিশোর বিড়লার (১৮৮৩-১৯৬৭) মহোদয়ের প্রচুর অর্থব্যয়ে এক সুরম্য অট্টালিকা নির্মিত হয় । তার অল্পদিন পরেই বংশদীপ মহাস্থবিরের পূর্ব সংকল্পিত বিদ্যাকেন্দ্র “নালন্দা বিদ্যাভবন” প্রতিষ্ঠিত হয় । তিনি এ বিদ্যাভবনের অধ্যক্ষ নির্বাচিত হন ।
সাতবাড়ীয়া নিবাসী রেঙ্গুন চট্টল বৌদ্ধ সমিতির সভাপতি দানবীর পুলিন বিহারী চৌধুরী তাহার লিখিত অভিভাষনে সংঘশক্তি পত্রিকা জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় সংখ্যা ৫৭৮ পৃষ্ঠা উল্লেখ করেন——- কৃপাশরণ মহাস্থবির তাঁহার মৃত্যুর অব্যহিত পূর্বে ধর্মাঙ্কুর বিহার এবং সকল শাখার দানপত্র প্রাপ্ত জমির যাবতীয দলিল আমার হাতে গচ্ছিত রাখিয়া মৃত্যু মুখে পতিত হয় । এর পর চত্তরপিঠুয়া নিবাসী পূন্নানন্দ স্বামী (১৮৭০-১৯২৮) সাথে আমার মামলা মূখরর্দমা শুরু হয় । আমি সমস্ত মামলা উঠাইয়া লইলে পূন্নানন্দ ধর্মাঙ্কুর বিহার বন্ধক দিতে সক্ষম হন । এই ঘটনার বহুদিন পরে কর্তালা নিবাসী ডা: শান্ত কুমার চৌধুরী (১৮৮৩-১৯৩৬) ও পাহাড়তলী নিবাসী অধ্যাপক বেনী মাধব বড়ুয়া (১৮৮৮-১৯৪৮) অক্লান্ত চেষ্টায় এবং বিড়লা মহাশয়ের সহায়তায় উল্লিখিত বন্ধক মুক্ত করা হইয়াছে এবং মনোরম ত্রিতল সৌধ নির্মিত হইয়াছে । বর্তমানে ইহা আর্যভবন নামে অভিহিত ।
“নালন্দা বিদ্যাভবন” প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে দেশ বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষার্থীর আগমন ঘটে । বরইগাও নিবাসী দশম সংঘরাজ জ্যােতিপাল মহাস্থবির (১৯১৪-২০০২), নানুপুর নিবাসী রাজগুরু আর্যমিত্র মহাস্থবির (১৯০০-১৯৭৫), জুলদা নিবাসী প্রিয়দর্শী মহাস্থবির (১৯০৪-১৯৮৮), শ্রদ্ধানন্দ মহাস্থবির, পুটিবিলা নিবাসী শীলাচার শাস্ত্রী (১৯১৩-১৯৮৯), জ্ঞানশ্রী ভিক্ষু, চেঁদিরপুনি নিবাসী শান্তপদ মহাস্থবির (১৯১৫-১৯৮৭), শিলক নিবাসী জ্ঞানবংশ মহাস্থবির (১৯০০-১৯৯৩), ড. দীপক বড়ুয়া (১৯৩৮-২০২২), ড. সুকোমল চৌধুরী, ড. অমল বড়ুয়া, ড. বিনেয়ন্দ্র নাথ বড়ুয়া প্রমুখ উক্ত বিদ্যাভবনের শিক্ষার্থীরুপে অদ্য, মধ্য, উপাধী পরীক্ষায় উত্তীন হন এবং অনেকে আবার পরবর্তী পর্যায়ে কেউ অধ্যক্ষ পদে বা অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন ।
১৯৩৮ খ্রি. ৯ই সেপ্টেম্বর কৃপাশরণ হলে নালন্দা বিদ্যাভবনের উন্নতির জন্য শিক্ষক ও ছাত্রদের যৌথ উদ্দেগে ” নালন্দা ছাত্র সংঘ” নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করা হয় । এ সমিতি মূল উদ্দেশ্য ধর্ম, সাহিত্য, কবিতা, রচনা ও আধুনিক রুচিসম্মত নানা বিষয়ে ধারাবাহিক ভাবে তর্ক বিতর্ক সভার আয়োজন করা । যথাক্রমে এ সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন পণ্ডিত বংশদীপ মহাস্থবির ও শ্রদ্ধানন্দ মহাস্থবির মহোদয় । সহ: সম্পাদক নির্বাচিত হন শীলাচার শাস্ত্রী মহোদয় । সমিতির মূল কার্যক্রমকে গতিশীল করার মানসে নালন্দা বিদ্যাভবনের পরিচালনায় কৃপাশরণ হলে বিকাল ৪ ঘটিকায় নালন্দা ছাত্র সংঘের ষোড়শ সভায় কবি নবীন চন্দ্র সেনের (১৮৪৭-১৯০৯) স্মৃতি বার্ষিকী অনুষ্টিত হয় । অধ্যক্ষ বংশদীপ মহাস্থবির উক্ত স্মৃতি সভায় সভাপতিত্ব করেন । শীলাচার শাস্ত্রী, পাহাড়তলী নিবাসী সাব রেজিস্ট্রার অধরলাল বড়ুয়া (১৮৭৮-১৯৫৩) প্রমুখ কবির বহুমুখী প্রতিভা এবং বুদ্ধ নীতি ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি কবি নবীন চন্দ্র সেনের আন্তরিকতা ইত্যাদি গুণাবলী উল্লেখ করে বক্তৃতা দেন ।
সভার শেষ পর্যায়ে সভাপতির ভাষনে বংশদীপ মহাস্থবির বলেন—- কবি নবীন চন্দ্র সেনের প্রণীত পলাশীর যুদ্ধের মূলীভূত অংশগুলি আলোচনা করে সকলে দৃষ্টি আকর্ষন করেন । তিনি আরো বলেন— নবীন সেনের অমিতাভ পড়ে তাঁহার মনে বৈরাগ্য সঞ্চারে বিশেষ সাহায্য করিয়াছেন ।
উক্ত সভায় কবি নবীন চন্দ্র সেনের স্মৃতি রক্ষাকল্পে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বাঙলা দেশের সমস্ত সাহিত্যনুরাগী এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছয় দফা দাবী অনুমোদনের মাধ্যমে সভা ভঙ্গ হয় ।
১৯৩৯ খ্রি. পণ্ডিত বংশদীপ মহাস্থবির নালন্দা বিদ্যাভবন ত্যাগ করলে পণ্ডিত জগদীশ চন্দ্র চ্যাটর্জী অধ্যক্ষ পদে বরিত হন । এরপর যথাক্রমে পুটিবিলা নিবাসী শীলাচার শাস্ত্রী (১৯১৩-১৯৮৯), মুকুটনাইট নিবাসী ড. জিনানন্দ ভিক্ষু (১৯১০-১৯৮৯), নজরটিলা নিবাসী দার্শনিক বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির (১৮৯০-১৯৬২), ধর্মপুর নিবাসী ধর্মাধার মহাস্থবির (১৯০১-২০০০) প্রমুখ অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন ।
মহামুনি পালি কলেজ ।
১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মহামুনি সংঘরাজ বিহারে ভারতীয় সংঘরাজ ধর্মধার মহাস্থবির উদ্যোগে ও পণ্ডিত বীরেন্দ্র লাল মুৎসুদ্দি এবং প্রজ্ঞারত্ন মহাস্থবিরের সহযোগিতায় পালি কলেজ স্থাপন করেন । বেতাগী নিবাসী ধর্মানন্দ মহাস্থবির উক্ত কলেজ স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । এ কলেজ থেকে যারা অদ্য, মধ্য, উপাধী পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বে সহিত উর্ত্তীন হয়েছিলেন তাদের মধ্যে—– কুমিল্লা নিবাসী দশম সংঘরাজ জ্যােতিপাল মহাস্থবির (১৯১৪-২০০২), ঘাটচেক নিবাসী উপসংঘরাজ সুগতবংশ মহাস্থবির (১৯১২-১৯৯৮), চেঁদিরপুনি নিবাসী ভূতপূর্ব সাধারণ সম্পাদক শান্তপদ মহাস্থবির (১৯১৫-১৯৮৭), পুটিবিলা নিবাসী অধ্যাপক শীলাচার শাস্ত্রী (১৯১৩-১৯৮৯), কৈড়য়ানগর নিবাসী ধর্মরক্ষিত মহাস্থবির (১৯১২-১৯৯৪), চেঁদিরপুনি নিবাসী বুদ্ধ রক্ষিত মহাস্থবির (১৯০২-১৯৯৮), লাকসাম নিবাসী পূর্ণানন্দ মহাস্থবির (১৯১২-১৯৯১), চাঁনগাও নিবাসী জিনরতন মহাস্থবির (১৯১৩-১৯৮৩), মির্জাপুর নিবাসী শীলানন্দ মহাস্থবির, সুকবিলাস নিবাসী শীল ভদ্র ভিক্ষু, নোয়াখালী নিবাসী আর্যকীর্তি শ্রমন, ধর্মপুর নিবাসী সুদর্শন শ্রমন, চেঁদিরপুনি নিবাসী পূর্ণানন্দ শ্রমন, পালং নিবাসী ধর্মাঙ্কর শ্রমন প্রমুখ । এছাড়া ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে উক্ত কলেজে নজরটিলা নিবাসী দার্শনিক বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির (১৮৫৯-১৯৮৭), ও বীরেন্দ্র লাল মুৎসুদ্দি অধ্যাপনার কাজে ব্রত হন ।
কর্তালা এংলো পালি কলেজ ।
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা ধর্মাঙ্কুর বিহার ত্যাগ করে বিনয়াচার্য বংশদীপ মহাস্থবির কর্তালা বেলখাইন সদ্ধমালঙ্কার বিহারে প্রত্যাবর্তন করেন । ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিক ভাবে মহাস্থবির মহোদয় কর্তালা এংলো পালি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি নিজেই উক্ত কলেজের অধ্যক্ষের পদ গ্রহন করেন । প্রতিষ্ঠার অল্প কিছৃ দিন পর বিনয়াচার্য বংশদীপ মহাস্থবিরের কাছে পালি শিক্ষা গ্রহনের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীগন এ কলেজে ভর্ত্তি হন । বার্মা, নেপাল, ভূটান, তিব্বত, আসাম প্রভৃতি দেশের শিক্ষার্থীগন উক্ত কলেজে হতে অদ্য, মধ্য, উপাধী পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সাথে উর্ত্তীন হন ।
তাদের মধ্যে শিলং বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ আসাম নিবাসী রাজগুরু শীলবংশ মহাস্থবির, তিব্বত নিবাসী জ্ঞানতিলক ভিক্ষু, নেপাল নিবাসী সুমন ভিক্ষু, ভুটান নিবাসী শরনতিষ্য ভিক্ষু, আসাম নিবাসী নন্দবংশ মহাস্থবির, প্রজ্ঞাবংশ মহাস্থবির, সারানন্দ ভিক্ষু, পরমানন্দ ভিক্ষু, ঘিরিমানন্দ ভিক্ষু প্রমুখ ।
এছাড়া কর্তালা এংলো পালি কলেজে শিক্ষার্থীরূপে যে সমস্ত বাঙ্গালী বৌদ্ধ ভিক্ষু অদ্য, মধ্য, উপাধী পরীক্ষায় উর্ত্তীন হয়ে অখণ্ড ভারতে থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে—–
১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ঊনাইনপুরা নিবাসী দ্বাদশ সংঘরাজ ধর্মসেন মহাস্থবির (১৯২৮-২০২০) অদ্য, মধ্য, উপাধী পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী অর্জন করেন । আঁধারমানিক নিবাসী অখিল ভারতীয় সংঘনায়ক আনন্দ মিত্র মহাস্থবির (১৯০৮-১৯৯৯), নাইখাইন সন্তোষালয় বিহারের অধ্যক্ষ জুলদা নিবাসী প্রিয়দর্শী মহাস্থবির (১৯০৪-১৯৮৮), আগরতলা বেনুবন বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ নানুপুর নিবাসী রাজগুরু আর্যমিত্র মহাস্থবির (১৯০০-১৯৭৫), বাথুয়া জ্ঞানোদয় বিহারের অধ্যক্ষ বাকখালী নিবাসী প্রিয়ানন্দ মহাস্থবির (১৯০৮-১৯৭৪), কুমিল্লা কনকস্তপ বৌদ্ধ বিহারে অধ্যক্ষ উপসংঘরাজ ধর্মরক্ষিত মহাস্থবির (১৯৩৮-২০২১), নাইখাইন সন্তোষালয় বিহারের অধ্যক্ষ সোমানন্দ মহাস্থবির (১৯১৭-২০০৭), দমদমা অভয়শরণ বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ উপসংঘরাজ আনন্দ মহাস্থবির (১৯০৮-১৯৯৫), কদুরখীল বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ সুমনতিষ্য মহাস্থবির, হাসিমপুর সুনন্দরাম বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ চেঁদিরপুনি নিবাসী বুদ্ধ রক্ষিত মহাস্থবির (১৯০২-১৯৯৮), কর্তালা নিবাসী বিশুদ্ধাচার স্থবির, শ্রদ্ধালঙ্কার স্থবির বিএ, জয়সেন স্থবির, জিনলঙ্কার ভিক্ষু, সুমনাচার স্থবির (পরবর্তীতে গৃহী), জ্ঞানশ্রী ভিক্ষু (পরবর্তীতে গৃহী)
প্রমুখ ।
সাতবাড়িয়া প্রজ্ঞালঙ্কার পালি টোল ।
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে সাতবাড়িয়া শান্তি বিহারে সংঘরাজ অভয়তিষ্য মহাস্থবির পাহাড়তলী নিবাসী ব্যারিস্টার ড. অরবিন্দ বড়ুয়া (১৯০২-১৯৭৫) মহোদয়ের সহযোগিতায় সাতবাড়িয়া পালি টোল প্রতিষ্ঠা করেন । উক্ত টোল হতে যারা অদ্য, মধ্য, উপাধী পরীক্ষায় উর্ত্তীন হয়েছিলেন তাদের মধ্যে——– ভারতীয় উপসংঘরাজ বড়হাতিয়া নিবাসী অতুলসেন মহাস্থবির (১৯১০-১৯৮৫), বাঁশখালী চাম্বল নিবাসী সমাজ সংস্কারক জ্ঞানসেন মহাস্থবির (১৮৯০-১৯৭৭), শীলকূপ নিবাসী উপসংঘরাজ সুভূতি রত্ন মহাস্থবির (১৯০২-২০০০), আবুখীল নিবাসী ড. শাসনরক্ষিত মহাস্থবির, শীলকূপ নিবাসী ধর্মজ্যােতি মহাস্থবির (১৯০৩-১৯৯২), কাঞ্চনগর নিবাসী ড. সুমঙ্গল বড়ুয়া, শীলকূপ নিবাসী ড. রবীন্দ্র বিজয় বড়ুয়া (১৯৩৩-১৯৯০) প্রমুখ ।
ঊনাইনপুরা পূর্ণাচার পালি টোল ।
১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ঊনাইনপুরা লংঙ্কারাম বৌদ্ধ বিহারে জ্ঞানীশ্বর মহাস্থবির পূর্ণাচা পালি টোল প্রতিষ্ঠা করেন । উক্ত টোল হতে যারা অদ্য, মধ্য, উপাধী পরীক্ষায় উর্ত্তীন হন তাদের মধ্যে——- দ্বাদশ সংঘরাজ ধর্মসেন মহাস্থবির (১৯২৮-২০২০), অখিল ভারতীয় সংঘনায়ক মিঠাছড়ি নিবাসী ধর্মপাল মহাস্থবির (১৯২৫-২০০৯), পণ্ডিত শীলানন্দ মহাস্থবির (১৯১৩-১৯৮৯), মুকুটনাইট নিবাসী ড. জিনানন্দ ভিক্ষু (১৯১০-১৯৮৮), প্রফেসর দিজেন্দ্র লাল বড়ুয়া প্রমুখ ।
তথ্যসূত্র:
১| বৌদ্ধ বন্ধু পত্রিকা, নবপর্য্যায়, ১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা, ১৯১৫ খ্রি., ১৩২২ বাংলা, ২৪৫৯ বুদ্ধাব্দ, পৃ: ২১৪,২১৫,২১৬,২১৭,২১৮, প্রবন্ধ কালী কিঙ্কর মুৎসুদ্দি, সম্পাদক- সমন পূন্নানন্দ স্বামী ।
২| জিনসাসন সমাগম কার্যবিবরণী, ১৯১৪ খ্রি., ১২৭৬ মগী, ২৪৫৮ বুদ্ধাব্দ, পৃ: ২,৩,৫,১৯,২০, সম্পাদক- প্রজ্ঞালোক ভিক্ষু ।
৩| কোথায় জগজ্যােতির জবাব, ১৯৫৬ খ্রি, পৃ:২,১৪,১৫, কলকাতা বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর বিহার, ধর্মপাল ভিক্ষু ।
৪| সংঘশক্তি পত্রিকা, ৭ম বর্ষ ১ম সংখ্যা, ১৯৩৫ খ্রি, ২৪৭৯ বুদ্ধাব্দ, পৃ: ৬৯, আশ্বিনী পূর্ণিমা সংখ্যা ।
৫| জগজ্যােতি পত্রিকা, ৩য় বর্ষ ৫ম সংখ্যা, কার্তিক সংখ্যা, পৃ: ১১৮,১১৯, ১৯১০খ্রি., সম্পাদক- গুণালঙ্কার ভিক্ষু, সমন পূর্ণানন্দ স্বামী ।
৬| সংঘশক্তি পত্রিকা, ১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা, ১৯২৯ খ্রি, ২৪৭৪ বুদ্ধাব্দ, পৃ:১৩৯,১৪০, আষাঢ়ী পূর্ণিমা সংখ্যা ।
৭| বৌদ্ধ বন্ধু পত্রিকা, নবপর্য্যায়, ১ম বর্ষ ২য় সংখ্যা, ১৯১৫ খ্রি, ১৩২২ বাংলা, ১৪৫৯ বুদ্ধাব্দ, পৃ: ৯৯,১০০,১০১,১০২,১০৩,১০৪, সম্পাদক – সমন পূর্ণানন্দ স্বামী ।
৮| সংঘশক্তি পত্রিকা, জয়ন্তী সংখ্যা, ১৯৩৬খ্রি, ২৪৮১ বুদ্ধাব্দ, পৃ: ৭, সম্পাদক- ধর্মপ্রিয় ভিক্ষু ।
কর্তালা, পটিয়া, চট্টগ্রাম ।