ব্রাহ্মণ্য পৌরহিত্যবাদের বিরুদ্ধে সফল অভিযান করার ক্ষমতা রয়েছে কেবল বৌদ্ধ ধম্মের মধ্যেই। বৌদ্ধ ধম্মের তত্ব সমূহ ব্রাহ্মণ্যবাদের অলীক বিশ্বাস সমূহের মূল থেকে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা রয়েছে। বৌদ্ধ ধম্মের অনাত্তবাদ এবং অনিত্যবাদ তত্ব তো ব্রাহ্মন্য ধর্মকে এক ঝটকায় শূণ্য করে দেয়। এজন্য ব্রাহ্মণ্যবাদ দ্বারা সৃষ্ট বিষমতাবাদকে নষ্ট করে দেশে সমতামূলক সমাজ এবং রাষ্ট্র নির্মাণের ক্ষমতা একমাত্র রয়েছে বৌদ্ধ ধম্মে।
কালে কালে বৌদ্ধ ধম্মকে বিনাশ করার জন্য ব্রাহ্মণেরা ভারতে নিজেদের প্রভূত প্রভাব বিস্তার করেছিল, যা এখনও চলমান রয়েছে। প্রাচীন এবং মধ্য কালীন সময়ে ভারতে উৎপন্ন বৌদ্ধ ধম্ম ব্যতীত বাকী সমস্ত ধর্ম বিষমতাবাদী ব্রাহ্মণ্য মতবাদের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমজোতা করে নিয়েছে। তাতে মধ্যকালীন ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদ ফলে-ফুলে অধিক বিকশিত হয়েছে এবং ব্রাহ্মণ্য জাতি ব্যবস্থার রূপান্তরণ হয়েছে অস্পৃশ্যতায়। সম্রাট অসোক বুদ্ধের সমতা মূলক ও অহিংস ধম্মের দ্বারা প্রেরণা লাভ করে যেভাবে বিষমতাবাদী তথা জাতি-বর্ণ ভিত্তিক ব্রাহ্মণ্যবাদের সমূল উচ্ছেদ করে প্রাচীন ভারতে সমতামূলক সমাজ এবং রাষ্ট্রের নির্মাণ করেছেন, সেরকম রাষ্ট্র নির্মাণ ভারতে বৃটিশ আসার পূর্ব পর্যন্ত সম্রাট অসোকের পরে আর কেহ করতে পারেননি। সকলে এমনকি মুসলিম শাসকেরাও বিসমতাবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের সাথে সমজোতা করে নিয়েছিল, তাতে ভারতে বহুজন সমাজ জাতি-ধর্ম ব্যবস্থার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে দিনের পর দিন দুর্বল হয়ে পড়েছিল। মধ্যযুগীয় সময়ে এরূপ দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছিল বিদেশী আক্রমণকারীরা এবং বৌদ্ধ ধম্ম শূণ্য ভারতবর্ষে লুঠপাট ও অন্যায়-অবিচার-অত্যাচারের কেন্দ্র তৈরী হয়েছিল। ইহাই হল এক বাস্তবিক দুঃখজনক স্থিতি, যা কেহ অস্বীকার করতে পারবেনা।
বৌদ্ধ ধম্ম প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে আত্ম প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক জবাবদিহিতার অনুভব করিয়ে থাকে। এজন্য ব্যক্তি কেবল নিজের একক জীবন নিয়ে ব্যস্ত না থেকে সমাজ এবং রাষ্ট্রের একাত্মতা এবং বিকাশকে অধিক প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বৌদ্ধ ধম্মের দ্বারা প্রেরণা লাভ করে ব্যক্তি নিজেকে অহঙ্কারী মনে না করে সবাইকে সমান মনে করে থাকে এবং সকলের উত্থানের জন্য প্রয়াস করে থাকে। তাতে সমতা, স্বতন্ত্রতা, বন্ধুত্ব এবং ন্যায় ভিত্তিক শক্তিশালী সমাজ ও রাষ্ট্রের নির্মাণ হয়ে থাকে। নিজেদের মধ্যে সংগ্রাম-সংঘর্ষ করার পরিবর্তে এবং নারী, অস্পৃশ্য বা সংখ্যালঘু ইত্যাদি দুর্বল শ্রেণীর লোকদের উপর অত্যাচার করার পরিবর্তে একে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা করার মধ্যেই কল্যাণ মনে করে থাকে। এতে সামগ্রিক শক্তির নির্মাণ হয়ে থাকে এবং রাষ্ট্রও শক্তিশালী হয়ে যায়।
পৃথিবীতে যে সমস্ত দেশে বৌদ্ধ ধম্মের অস্তিত্ব রয়েছে, সেখানকার লোকেরা সমতামূলকভাবে অর্থাৎ কোনো রকমের বৈষম্যহীনভাবে বসবাস করে যাচ্ছে। বৌদ্ধ ধম্ম সম্প্রদায়, ধর্ম-জাতি-বর্ণ বৈষম্যের শিক্ষা দেয়না। বৌদ্ধদের মধ্যে রয়েছে উচ্চতর নীতি-নৈতিকতার অনুশীলন এবং তারা নিজেদের জীবনের স্বার্থ চিন্তা ত্যাগ করে রাষ্টবাদকেই অধিক প্রাধান্য ও মহত্ব দিয়ে থাকে। এজন্য চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের মত বৌদ্ধ দেশ সমূহ আধুনিক যুগে শক্তিশালী দেশরূপে গড়ে উঠেছে। জাপানে তো রাস্তায় পড়ে থাকা কোন বস্তুকে রাষ্ট্রেরই সম্পত্তি বলে মনে করা হয়। তা হতে আমরা বুঝতে পারি যে, বৌদ্ধ ধম্ম সেখানে কত উচ্চতর নৈতিকতা সম্পন্ন জাতীয়তাবাদ বিকশিত করে দিয়েছে।
ভারতবর্ষে এরকম উচ্চতর নৈতিকতা এবং সমতা মূলক ঐক্যতা সম্পন্ন রাষ্ট্রবাদ কেবল বৌদ্ধ শাসন কালেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সম্রাট অসোক, সম্রাট কনিষ্ক, সম্রাট হর্ষবর্ধন প্রমুখ শাসকেরা জাতি-বর্ণ বৈষম্যহিহীন সমতামূলক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন। তাতে প্রাচীন ভারতে সুবর্ণ যুগের নির্মাণ হয়েছিল। কিন্তু অষ্টম শতাব্দীতে ঘোর ব্রাহ্মণ্যবাদী শঙ্করাচার্যের আক্রমণের সাথে সমতাবাদী বৌদ্ধ ধম্ম ভারত হতে বিলুপ্ত হয়েছে। এরপর হিংস্র আক্রমণ এবং অন্যায়কারী সামন্তবাদের বিকাশ হয়েছে। যদ্বারা মানবতাবাদ ভীষণভাবে পদদলিত হয়েছে।
বর্তমানে পাশ্চাত্য দেশের মত প্রাচ্য তথা বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের দেশ সমূহে সমতা মূলক সমাজ এবং রাষ্ট্র গঠন করার জন্য বৌদ্ধ ধম্মকেই প্রতিষ্ঠা করা সবিশেষ প্রয়োজন। বৌদ্ধ ধম্মের প্রতীক সমূহ এবং তত্ব সমূহ সমাজ ও রাষ্ট্রে স্থাপন ব্যতীত বিষমতা মূলক রাষ্ট্র গঠন কখনও সম্ভব নয়। এজন্য বৌদ্ধ ধম্মের প্রাচীন অমূল্য প্রতীক সমূহ এবং তত্ব সমূহ সামনে নিয়ে আসার জন্য দেশব্যাপী শক্তিশালী সংগঠনের আবশ্যকতা রয়েছে। সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ব্যতীত তা কখনও সম্ভব নয়। বৈষম্যহীন চেতনাই বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্রের উপহার দিতে পারে।
ইদানীং আমরা বিভিন্ন আন্দোলনের শ্লোগানে ‘বৈষম্যহীন’ শব্দটি শুনে থাকি। বৈষম্যহীন শব্দটি শুনতে সকলের অনেক ভাল লাগে। কিন্তু যারা বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখে তাদের চিন্তা-চেতনা ও ধর্ম বিশ্বাসে বিষমতায় ভরা দেখা যায়। পরমত, পরধর্ম ও ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও সমতাভাব না থাকলে বৈষম্যহীন সমাজ তথা রাষ্ট্র কখনও গঠন করা সম্ভব নয়। ‘সকল প্রাণী সুখী হোক, বিপদমুক্ত হোক, কেহ হক-অধিকার বঞ্চিত না হোক’ মনে নিরন্তর এরূপ বৈষম্যহীন ভাবনার শিক্ষা পৃথিবীতে একমাত্র বৌদ্ধ ধম্মই দিয়ে থাকে। অন্যদের শিক্ষায় কেবল জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় ও লিঙ্গের বৈষম্য ব্যতীত আর কিছু নাই।
বৌদ্ধ গবেষক ও পণ্ডিত, ভারতের বিহার রাজ্যের বুদ্ধগয়া মহাবোধি সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট, ধর্মদূত মেম্বার ও মেডিটেশন টিচার।