সমাজের কিছু মানুষ তাঁদের কর্মে, ত্যাগে এবং প্রজ্ঞায় অসাধারণ হয়ে ওঠেন। এঁদের জীবন শুধু নিজস্ব অর্জনেই সীমাবদ্ধ থাকে না; তাঁদের উদ্যোগে এবং নেতৃত্বে একটি সমাজ বা জাতি পায় উন্নতির নতুন দিশা। এমনই এক বিরলপ্রজ কর্মবীর ছিলেন বুদ্ধদত্ত মহাস্থবির, যিনি তাঁর কর্ম, আদর্শ, এবং সেবার মাধ্যমে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে ছিলেন।
শৈশব ও প্রাথমিক শিক্ষা
১৯৩৪ সালের ২১ মার্চ (বাংলা ১৩৪৩ সালের ১৬ চৈত্র) চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার জলদী গ্রামে এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বুদ্ধদত্ত মহাস্থবির। তাঁর পিতার নাম ছিল অশ্বিনী কুমার বড়ুয়া এবং মায়ের নাম সারথী বালা বড়ুয়া। জন্মের পর তাঁর নামকরণ করা হয় দত্ত বড়ুয়া। শৈশবকাল থেকেই তিনি ছিলেন শান্ত, মেধাবী এবং ধর্মনিষ্ঠ। জলদী ক্যাং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর তিনি স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেন।
উপসম্পদা গ্রহণ
কিশোর বয়স থেকেই দত্ত বড়ুয়ার ধর্মের প্রতি অগাধ আকর্ষণ দেখা দেয়। জলদী গ্রামের ধর্মরত্ন বিহারে নিয়মিত আসা-যাওয়ার সুবাদে তিনি বিহারের অধ্যক্ষ সব্যসাচী কর্মবীর জ্ঞানপাল মহাথেরের সান্নিধ্যে আসেন। জ্ঞানপাল মহাথেরের স্নেহ, আদর্শ, এবং শিক্ষায় দত্ত বড়ুয়ার মনে তথাগত বুদ্ধের আদর্শের প্রতি গভীর অনুরাগ জন্মে। কৈশোরে ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়ে তিনি নিজেকে ধীরে ধীরে গৈরিক জীবনের জন্য প্রস্তুত করেন।
১৯৫৪ সালে কর্মবীর জ্ঞানপাল মহাথেরের তত্ত্বাবধানে তিনি উপসম্পদা গ্রহণ করেন। সেই সময় থেকেই তিনি আজীবন শাসন সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। ধর্মের আদর্শ প্রচার, বিহার সংস্কার এবং ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে তিনি হয়ে ওঠেন এক নিরলস কর্মী।
বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ ও সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা
বুদ্ধদত্ত মহাস্থবিরের কর্মজীবনের অন্যতম বড় অবদান ছিল বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ ও সংস্কার। তাঁর নেতৃত্বে এবং প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে যে সমস্ত বিহার পুনর্নির্মাণ বা সংস্কার করা হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- ১৯৬৮ সালে তালসরা আনন্দারাম বিহার, যা ১৯৮৮ সালে পুনরায় সংস্কার করা হয়।
- ১৯৮০ সালে ওষখাইন সদ্ধর্মানন্দ বিহার।
- ১৯৮২ সালে মুৎসুদ্দীপাড়া বিবেকারাম বিহার।
- ১৯৮৩ সালে তিশরী বেণুবন বিহার।
- ১৯৮০ সালে জলদী ধর্মরত্ন বিহার।
- চন্দনাইশের সুচিয়া সুখানন্দ বিহার।
তাঁর হাত ধরে মোট বিশটিরও বেশি বিহার পুনর্নির্মাণ এবং সংস্কার সম্পন্ন হয়। এসব বিহার শুধু ধর্মচর্চার কেন্দ্রই নয়, সমাজকল্যাণের গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবেও পরিচিতি পায়।
পালি শিক্ষার প্রসারে অবদান
বুদ্ধদত্ত মহাস্থবির শুধু বিহার নির্মাণে সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারের জন্য পালি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তাঁর প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়:
- ১৯৬২ সালে তালসরা পালিটোল।
- ১৯৬৯ সালে প্রজ্ঞাতিষ্য পালি কলেজ।
- ১৯৭৭ সালে ওষখাইন পালিটোল।
- ১৯৮০ সালে চেনামতি পালিটোল।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো বৌদ্ধ ধর্মের মূলমন্ত্র ও শিক্ষাকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গ্রামোন্নয়নে ভূমিকা
ধর্মীয় কাজের পাশাপাশি বুদ্ধদত্ত মহাস্থবির সমাজ উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তাঁর নেতৃত্বে এবং উদ্যোগে জলদী গ্রামে বিদ্যুতায়ন করা হয়। গ্রামের উন্নয়নে তিনি নিজের পৈতৃক সম্পত্তির ১৫ গণ্ডা জমি ধর্মরত্ন বিহারের নামে দান করেন।
ধর্মচর্চা ও তীর্থ ভ্রমণ
বুদ্ধদত্ত মহাস্থবিরের জীবনে ধর্মচর্চার পাশাপাশি তীর্থ ভ্রমণের বিশেষ স্থান ছিল। তিনি বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনী, বোধিলাভের স্থান বুদ্ধগয়া, প্রথম ধর্মদেশনার স্থান বারাণসী ইসিপতন মৃগদাব, এবং মহাপরিনির্বাণ লাভের স্থান কুশীনগর—এই চার মহাতীর্থ দশবার ভ্রমণ করেন। প্রতিটি তীর্থযাত্রা তাঁকে আরও গভীরভাবে ধর্মের মর্ম উপলব্ধি করতে সহায়তা করে।
বিশেষ উৎসব ও আয়োজন
বুদ্ধদত্ত মহাস্থবিরের প্রাণবন্ত নেতৃত্বে এবং কর্মদক্ষতায় বিভিন্ন ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসব উদযাপিত হয়েছে। শাসনধ্বজ প্রজ্ঞাতিষ্য মহাথেরের প্রয়াণের ৫০ বছর পূর্তি সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। একইভাবে জলদী ধর্মরত্ন বিহার উৎসর্গ অনুষ্ঠানে এবং তাঁর গুরু জ্ঞানপাল মহাথেরের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া আয়োজনে তিনি অগ্রগণ্য ছিলেন।
মহাপ্রয়াণ
“জন্মিলে মরিতে হবে”—জীবনের এই চিরন্তন সত্যকে আলিঙ্গন করে বুদ্ধদত্ত মহাস্থবির ১৯৯০ সালের ২৪ নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে সমাজ এক মহান নেতাকে হারায়, যিনি আজীবন মানুষের কল্যাণ এবং ধর্মের প্রচারে নিবেদিত ছিলেন।
বুদ্ধদত্ত মহাস্থবির ছিলেন এক বিরলপ্রজ কর্মবীর, যাঁর জীবন ছিল শাসন সেবার এক অনন্য উদাহরণ। তাঁর কর্ম, ত্যাগ, এবং নেতৃত্ব আজও বৌদ্ধ সমাজকে অনুপ্রাণিত করে। একাধারে ধর্মপ্রচারক, নির্মাতা, এবং সমাজসংস্কারক হিসেবে তিনি ইতিহাসের পাতায় চিরকাল উজ্জ্বল থাকবেন। তাঁর জীবনের আদর্শ এবং কর্মধারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে।
প্রকাশক ও সম্পাদক, ধম্মইনফো-ডট-কম