১৯৫৪ সালে দর্শনসাগর প্রিয়ানন্দ মহাস্থবির মহোদয় ঐতিহাসিক রাউজান গ্রামে অভিধর্ম পরিষদ গড়ে তুলেন।প্রায় দের দশকের ব্যবধানে এই পরিষদের মাধ্যমেই বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমাজে অঙ্কুরিত হয় একজন বোধিপাল শ্রামণ।
উক্ত পরিষদের অমিত শক্তিতে মনোরঞ্জন বড়ুয়া হয়ে উঠলেন মনোরঞ্জন সাধু।সেখান থেকে সন্ধিৎসু আত্মাহ্বানে ড.রাষ্ট্রপাল মহাস্থবিরের পরম স্নেহে সৃজিত হলো বোধিপাল শ্রামণ।
রাউজান গ্রামেই জনৈক মনোরঞ্জন বড়ুয়ার জন্ম।
বুদ্ধ বলেন -উত্তিট্ঠে নপ্প মজ্ঝেয়্যা[উঠো,জাগ্রত হও]।১৯৭৫ সালেই বুদ্ধগয়ার মহাবোধি চত্ত্বরে প্রিয়ানন্দ পরম্পরা যে আত্ম-জিজ্ঞাসা মনোরঞ্জনের চিত্তে লালিত হয়েছিল তার পূর্ণতা পেয়েছে।উঠে জাগ্রত হলেন মনোরঞ্জন সাধু।সেখানেই ড.রাষ্ট্রপাল মহাস্থবিরের মাধ্যমে বিদর্শন(বিপস্সানা) শিক্ষার হাতে কড়ি। এর পরে মৃত্যুাবধি থেমে থাকেননি উনি।১৯৭৬ সালে ভারত ছেড়ে চলে আসেন জন্মজনপদে ।সেবছর প্রিয়ানন্দ ভান্তের নেতৃত্বে সেন্ট প্লাসিড্স হলে মহামানব গৌতমবুদ্ধের ২৬শত তম জন্ম জয়ন্তী উদযাপন করা হয়েছিল আবার উনি জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত এশীয় বৌদ্ধ শান্তি সম্মেলনে যোগদান করায় খুব ব্যস্ত থাকার দরুন শ্রামণ বোধিপালের সাথে যোগাযোগ কমে যায়।
অন্তেবাসী হিসেবে শ্রামণ বোধিপাল অবস্থান করেন ঐতিহাসিক বিমলানন্দ বিহারে।সেখান থেকে কুমিল্লার বড়ইগাঁও পালি পরিবেণে বিশ্বনাগরিক জ্যোতিঃপাল মহাস্থবির মহোদয়ের সান্নিধ্যে একবছর আত্মদ্বীপ হবার আরও পাথেয় আত্মস্থ করেন।পরে মহাস্থবির গিরিমানন্দ মহোদয়ের কাছে বিদর্শন শিক্ষার আরও প্রায়োগিক শিক্ষা আত্মস্থ করে আব্দুল্লাহপুর শাক্যমুনি বিহারে ০৩ বছর,গহিরা অঙ্কুরীঘোনাস্থ জেতবন বিহারে অবস্থান করেন অন্তেবাসী হিসেবে।
১৯৭৮ সাল।কদলপুর ভিক্ষু ট্রেনিং সেন্টারে বাংলাদেশে প্রথম দশদিন ব্যাপি বিপস্সানা অনুশীলন শিবির অনুষ্ঠিত হয়।বলা দরকার সেবছর ২৫৩১ বুদ্ধ বর্ষকে বরণ করতেই গণ প্রবজ্যা সহ এই বিদর্শন অনুশীলন শিবির চালু হয়।এই শিবিরের ধ্যানাচার্য ছিলেন শ্রামণ বোধিপাল।
আরও ছিলেন জোবরা সুগত বিহারের ভিক্ষু সুগতপ্রিয়,চির ব্রহ্মাচারিনী চারু মিসট্রেসকে।
মূলত এটির স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন প্রজ্ঞাবংশ মহাস্থবির মহোদয়। নেপথ্যে কোলাহলশূণ্য কারিগর হয়ে প্রসারিত করেছেন বিদর্শনচর্চা।
১৯৮৮ সাল।শ্রামণ বোধিপাল তখন শ্রমণ বোধিপাল[শামণ ও শ্রমণের পার্থক্য প্রতীয়মান ]।সেবছর আবিস্কার করলেন আর্যমাতা রানুপ্রভাকে। উনাকে শ্রমণ বোধিপাল বুদ্ধকন্যা সম্বোধন করতেন।সেবছর উনারা চান্দগাঁও চলে আসেন।এর মধ্যে তাঁদের মহাপথের পথিক হলেন রানুপ্রভার ভাই তেমিয়ব্রত বড়ুয়া।
শুরু হলো তাঁদের ত্রয়ী নবযাত্রা।আত্মদ্বীপ হবার অমোঘ আহ্বান বিলাতে লাগলেন গ্রাম হতে গ্রামান্তরে।বিদর্শন ভাবনা চর্চার নবান্দোলন সূচিত হলো এই শ্রমণ বোধিপাল পরম্পরায়।
১৯৯৭ সালে বুদ্ধগয়াস্থ আন্তর্জাতিক সাধনা কেন্দ্রে পালিত হয় ৭৮ তম জন্মজয়ন্তী।
১৯৯৯ সাল।ড.রাষ্ট্রপাল মহাস্থবির মহোদয়ের মানসপুত্র শ্রমণ বোধিপালকে অনুরোধ করলেন বাংলা ভাষায় বিদর্শন চর্চার একটি বই লিখতে।
২০০১ সালে শ্রমণ বোধিপালের বাস্তবমুখী অর্জন,প্রজ্ঞা,অভিধার্মিক দর্শন দিয়ে একখানা পাণ্ডুলিপি তৈরী করে তুলে দিলেন গুরুর হাতে।
গুরু ভান্তে পাণ্ডুলিপি পড়ে বুঝতে পারলেন উনার ভারত যাত্রার পর বাংলাদেশে উনার শূন্যস্থান শ্রমণ বোধিপালই পূরণ করেছেন। বোধিপাল স্মরক গ্রন্থে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ড.রাষ্ট্রপাল ভান্তে শ্রমণ বোধিপালকে উনার অতীব প্রাণের ধন,সাত রাজার মানিক স্বরূপ বর্ণনা করেছেন।
২০০৩ সালের ২৭ই মার্চ, বৃহস্পতিবার। পৃথিবীর নিষ্টুরতম শয্যায় শায়িত শ্রমণ বোধিপাল। এইতো জীবন!দীর্ঘ ৮৪টি বছর কাটিয়েছেন এই সংসারে।নানা যোগ,বিয়োগ,সার,অসার গ্রহণ-বর্জনে ক্লান্ত দেহ।গুরুদেবকে খবর দেওয়া হলো।তাঁর সাতরাজার মানিক বোধিপালের স্পন্দন স্তব্ধ প্রায়।বার্ধক্যে অসহায় দেহ।রাত নয়টা পর্যন্ত ছিলেন পুত্রপ্রতিম শিষ্যের অন্তিমদশায়।সুত্রপাঠ এবং অন্যশিষ্যদের ভাবনা অনুশীলন করান।যে বোধিপাল দীর্ঘ ২৮টি বছর বিদর্শন ভাবনা অনুশীলনে সর্বাধিক উৎসাহী ছিলেন তিনি আজ গুরুকে কাছে পেয়েও ভাবনায় নিমঘ্ন হবার অভিপ্রায় প্রদর্শন করছেন না!মহাযাত্রার প্রস্তুতিতেই ব্যস্ত।
দীর্ঘক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে গুরুদেব বলে গেলেন আমাদের বোধিপাল আর ঘন্টা তিনেক থাকতে পারেন।খবর পেয়ে ছুটে গেলেন অধ্যাপক বনশ্রী মহাস্থবির মহোদয়। উনি সুত্রপাঠ করতঃতদীয় শিষ্য আর্যশ্রী ভিক্ষুকে ওখানে রেখে চলে এলেন বিহারে।
রাত ১১টা।আর্যশ্রী ভিক্ষু সুত্রপাঠ করছেন।কয়েক পলক ফেলতেই কেটে গেলো আরও একটি মিনিট।দৃষ্টির অদূরেই হারিয়ে গেলো শ্রমণ বোধিপালের স্পন্দন।আমাদের মানবীয় বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে ঘোষণা করা হলো বোধিপালের মৃত্যু সংবাদ।ভারী হয়ে উঠলো তেমিয়ব্রত সহ অন্যান বিদর্শন সাধকদের কণ্ঠস্বর। এখানেই কী শেষ?
প্রকৃতির নিয়মে একে একে চলে গেলেন রানুপ্রভা,বোধিপাল,রাষ্ট্রপাল,আমার আপনার কত আপনজনেরা!
আমরাও কী থেকে যেতে পারবো?
কিন্তু উনাদের যে বিশুদ্ধ যাপিত জীবন,আত্মদমনের যে অব্যর্থ অভ্যর্থনা, অনাড়ম্বর জীবনশৃঙ্খল তা ঠিকে থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
জয়তু বোধিপাল।
- তথ্যটীকা:
- ১.বোধিপাল স্মারক।
- ২.সম্যক(বুদ্ধপূর্ণিমা সংখ্যা,৮ম বর্ষ)-রিজয় চৌধুরী।
- ৩.১০ম সংঘরাজ সম্বর্ধনা স্মারক-০১,বিমলানন্দ বিহার।
- ৪.প্রিয়ানন্দ -মহাজীবন-ড.বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া।
- ৫.আলোকিত জীবন।
- ৬.ven.Rastrapal Mahathera- International Meditation Centre Buddha Gaya.
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি বিভাগের অধ্যায়নরত জনি বড়ুয়ার জন্ম চট্টগ্রাম রাউজান থানার পূর্ব আধারমানিক গ্রামে। স্কুল জীবনেই তাঁর লেখালিখির হাতেখড়ি। ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় যৌথ কাব্যগ্রস্থ ‘দ্যুতির বিচ্ছুরণ’। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও পত্র-পত্রিকায় জনি বড়ুয়ার বহু কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।