বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার চারটি মূল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে। যদিও বাংলাদেশ সমাজতন্ত্রকে অনেক আগেই ত্যাগ করেছে, জাতীয়তাবাদ এবং গণতন্ত্রের বাস্তবায়ন নিয়েও বড় ধরনের প্রশ্ন রয়ে গেছে। তবে সবচেয়ে স্পষ্ট সংকট দেখা দিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে, যার অর্থ এবং প্রয়োগ সম্পর্কে বাংলাদেশ এখনও দ্বিধাগ্রস্ত। যদিও সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে, কিন্তু এর বাস্তবায়ন এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রয়োগ নিয়ে রাষ্ট্রের প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার মূল চেতনা—যেটা প্রত্যেককে তার ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দেয়—বাংলাদেশে সঠিকভাবে স্থাপিত হয়নি, বরং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো বারবার সহিংসতার শিকার হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রদায়িকতা ইতিহাস পুরোনো। ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যার কারণে দেশভাগ ঘটে। পাকিস্তান সাম্প্রদায়িক সমস্যা মোকাবিলায় ব্যর্থ হলেও, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কারণ। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশেও এই সম্প্রীতি সংকটে পড়েছে। স্বাধীনতার পর দেশের মূলনীতিগুলো থেকে বিচ্যুত হয়ে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থা ক্রমাগত অবনতির দিকে গেছে।
ধর্মীয় সহনশীলতা আধুনিক সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ, যা বাংলাদেশে আজ খুবই সংকটে। একদিকে যেমন সংবিধান সবাইকে তার ধর্ম পালনের স্বাধীনতা কথা বলে, অন্যদিকে ধর্মীয় সহিংসতার শিকার হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এসব সহিংসতার মধ্যে ঘন ঘন দেখা যায়, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগের মাধ্যমে সংঘবদ্ধভাবে হামলা চালানো হচ্ছে। নড়াইল, কুমিল্লা, রামু, উখিয়া, টেকনাফ, ভোলা, নাসিরনগর, সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এমন ঘটনা ঘটেছে।
২০১২ সালে কক্সবাজার জেলার রামুতে ১৯টি বৌদ্ধ মন্দির এবং অসংখ্য বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়। ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে এবং ২০২১ সালে কুমিল্লায় হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হয়। প্রতিটি ঘটনার প্রাথমিক প্রেক্ষাপট ছিল একই: একটি ভুয়া ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ ইসলাম ধর্ম অবমাননা করেছে। এর পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি ভাইরাল করা হয়, এবং কিছু সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের মানুষ ধর্মীয় উন্মাদনায় আক্রমণ চালায়।
এই ঘটনাগুলোর মধ্যে যে সাদৃশ্য রয়েছে তা খুবই উদ্বেগজনক। প্রথমত, প্রতিটি ঘটনায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাউকে ভুয়া অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। তারপর জনমত তৈরি করে সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত, পুলিশের ভূমিকা এই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে বেশ রহস্যময়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, পুলিশ দেরিতে উপস্থিত হয় অথবা সহিংসতা প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে না, যার ফলে সহিংসতার মাত্রা বাড়তে থাকে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্যমতে, ২০১৩ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে দেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ৩৬৭৯টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে আগুন দেওয়া, ভাঙচুর এবং ক্ষেত্রবিশেষে মৃত্যুর ঘটনাও রয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, কোনো একটি ঘটনাতেও পুরো আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি এবং দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হয়নি। এই আইনি ব্যর্থতা শুধুমাত্র বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরিই করেনি, বরং সহিংসতাকারীদের আরও বেশি সাহস যুগিয়েছে।
এই সহিংসতাগুলোর মূলে রয়েছে সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক স্বার্থের ব্যবহার। অনেক ক্ষেত্রে, ধর্মকে ব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছে, যা সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সমাজ গঠনের পথে বড় বাধা। কুমিল্লার সাম্প্রতিক ঘটনা এই সংকটকে আরও প্রকট করেছে, যেখানে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বারবার তাদের অস্তিত্ব এবং সম্মান রক্ষার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হচ্ছে, যা একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে অগ্রহণযোগ্য। একটি সুষ্ঠু এবং সমতাভিত্তিক সমাজ গড়তে হলে সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা প্রয়োজন। সংখ্যালঘুদের ওপর এ ধরনের সহিংসতা বন্ধ করতে হলে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং মানবাধিকার সংরক্ষণে সরকারকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ছাড়া, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও সতর্ক হতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের সহিংসতা রোধ করা যায়। ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহাবস্থান নিশ্চিত করা না গেলে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষতার স্বপ্ন পূরণ অসম্ভব হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা এবং তাদের মানবাধিকার সংরক্ষণের জন্য ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের চেতনার প্রতি কঠোর অবস্থান নিতে হবে। সংবিধানের আদর্শ পুনর্বিবেচনা এবং এর সঠিক প্রয়োগের মধ্য দিয়েই দেশের সকল সম্প্রদায়ের জন্য একটি ন্যায়সংগত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
স্বপ্ন এবং দায়িত্ববোধ থেকে ধম্মইনফো-ডট-কম এর সূচনা। ২০১১ সালে বাংলায় প্রথম অনলাইন বৌদ্ধ সংবাদ পোর্টাল হিসেবে ধম্মইনফো যাত্রা শুরু করে, যা বৌদ্ধধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং নীতিমালা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রচারে পাঠকের ব্যাপক গ্রহণ যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। ২০১২ সালে রামুতে মৌলবাদী হামলার পর এটি একটি শক্তিশালী সংবাদ মাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তর বাংলা ভাষী বৌদ্ধদের কাছে পরিচিতি লাভ করে। যদিও নিরাপত্তাজনিত কারণে ২০১৮ সালে সাইটটি প্রকাশনা বন্ধ করা হয়, ২০২৪ সালে ধম্মবিরীয় ভিক্ষুর নেতৃত্বে এটি আবার চালু হলে ধম্মইনফো বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার, বাংলাদেশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে সংবাদ, ঐতিহাসিক নিদর্শন, মণিষীদের জীবনী প্রকাশ, এবং ধর্মীয় উন্নয়নে কাজ করছে
ভালো গবেষণা, যদিও কষ্টের বিষয়