প্রারম্ভিকতাঃ প্রাচীন ভারতবর্ষ ষোল জনপদে বিভক্ত ছিলো। এর একটি জনপদ ‘কোশল’। কোশল রাজ্যে তখন রাজত্ব করতেন মহারাজ বিম্বিসার। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক রাজা ছিলেন। ধার্মিক রাজা একদিন গভীর রাতে ষোলটি স্বপ্ন দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেন, ভিত হলেন, সন্ত্রস্ত হলেন। গভীর রাতে হঠাৎঘুম ভেঙ্গে চলৎশক্তি হারিয়ে জড়সড় হয়ে শয্যায় পড়ে আছেন।অতি প্রত্যুষে পুরোহিত, ব্রাহ্মণ ও দৈবজ্ঞ ডেকে স্বপ্ন বৃত্তান্ত ব্যক্ত করে কী ফল হবে তা জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তারা বললো, ‘মহারাজ, এ-তো ঘোরতর দু:স্বপ্ন’। রাজা জানতে চান কেমন ঘোরতর দু:স্বপ্ন? তখন তারা বললেন, হয় আপনার রাজ্যনাশ, নয়তো প্রাণনাশ, না হয় অর্থনাশ, তিনটির যে কোনো একটি নাশ হবেই। মহারাজ এর প্রতিবিধান কী জানতে চাইলে, মহাযজ্ঞের বিধান দিলো। সাথে সাথে রাজাজ্ঞায় হাজার হাজার চতুস্পদ প্রাণী, পাখী ইত্যাদি আনীত হচ্ছিলো। রাজমহিষী মল্লিকাদেবী ঘুম হতে জেগে যজ্ঞের ঘনঘটা দেখে মহারাজের কাছে যজ্ঞের কারণ জানতে চান। মহারাজ রেগে গিয়ে বললেন, আমার প্রাণ যায় যায়, আর তুমি বলছো কীসের যজ্ঞ? বললেন,আমি ভয়ানক দু:স্বপ্ন দেখেছি, তার প্রতিবিধান করছি। মল্লিকাদেবী বললেন, এ বিষয়ে আপনি জগতের আলো ভগবান তথাগতের কাছে জিজ্ঞেস করেছেন? তখন মহারাজের সম্ভিত আসলো, তিনি দ্রুত বুদ্ধ সমীপে গমন করেন। বুদ্ধের সাথে কুশলাদি বিনিময় শেষে স্বপ্ন দর্শনের কথা বুদ্ধকে জানালেন এভাবে,
বৃষ, বৃক্ষ, ধেনু, বৎস, তুরগ, কাংস্যের পাত্র,
একে একে করি দরশন;
শৃগাল, কলসি, পুন পুষ্করিণী শোভাময়ী,
তারপর তণ্ডুল, চন্দন;
অলাবু ডুবিল জলে, কিন্তু ভাসে শিলা তথা,
ভেকে করে কৃষ্ণসর্প গ্রাস;
সুবর্ণ-পালকে শোভে যত কাক-পরিজন’
ছাগ ভয়ে বৃক পায় ত্রাস।
ষোড়শ স্বপ্নের বৃত্তান্ত নিম্নরূপ
প্রথম স্বপ্নঃ মহারাজ বুদ্ধ ভগবানকে বললেন, ‘ভন্তে,আমার প্রথম স্বপ্ন এরকম, মনে হলো কুচকুচে কালো চারটি বৃষ লড়াই করতে চারদিক হতে রাজ অঙ্গনে প্রবেশ করলো, দেখে ভয় পাওয়ার অবস্থা। বৃষ লড়াই দেখতে প্রচুর লোক সমাগম হলো, বৃষগুলো লড়াইয়ের ভাব দেখালো, কিন্তু শুধু তর্জন-গর্জন করেই চলে গেলো’। এ স্বপ্নের ফল কী হবে?
বুদ্ধ বললেন, ‘মহারাজ, এ স্বপ্নের ফল বহুকাল পরে ফলবে, তখন রাজাগণ অধার্মিক ও কৃপন হবে, মানুষ অসৎপথে চলবে, জগত অধোগতি প্রাপ্ত হবে, কুশলের ক্ষয় ও অকুশলের জয় হবে। ঠিক সেসময় পরিমাণমতো বর্ষা হবে না, শষ্য ফলবে কম, দুর্ভিক্ষের মতো হাহাকার হবে। মেঘ উঠবে, বিদ্যুৎ চমকাবে, বৃষ্টির আশায় থাকা মানুষগুলো খুশি হবে, অথচ ঐ বৃষগুলো যেমন লাড়াই না করে ফিরে গেলো ঠিক মেঘও বৃষ্টি বর্ষণ না করে অর্ন্তহিত হবে’।
দ্বিতীয় স্বপ্নঃ মহারাজ বুদ্ধ ভগবানকে বললেন, ‘ভন্তে, আমার দ্বিতীয় স্বপ্ন এরকম, মনে হলো, মাটি ভেদ করে প্রচুর বৃক্ষ ও গুল্ম জন্মাচ্ছে, এদের কোনো কোনোটি প্রকাণ্ড, আবার কোনো কোনোটি হস্ত প্রমাণ অবস্থায় পুষ্প ও ফল প্রদান করছে’। এ স্বপ্নের ফল কী হবে?
বুদ্ধ বললেন, ‘মহারাজ, এ স্বপ্নের ফলও বহুকাল পরে মানুষের আয়ু যখন খুব কম হবে তখন ফলবে। সে অনাগত সময় প্রাণীকুল তীব্র কাম আকাঙ্খা পরায়ন হবে। অল্প বয়স্ক কন্যা বিয়ে করবে, সে অল্পবয়স্ক মেয়েরা স্বপ্নদৃষ্ট হস্ত প্রমাণ বৃক্ষের ফল-ফুল সদৃশ সন্তানসম্ভবা হয়ে সন্তান প্রসব করবে’।
তৃতীয় স্বপ্নঃ মহারাজ বুদ্ধ ভগবানকে বললেন, ‘ভন্তে, আমি তৃতীয় স্বপ্নে দেখলাম, গাভীরা সবেমাত্র জন্ম নেয়া বাছুর হতে দুধ পান করছে’। এ স্বপ্নের ফল কী হবে?
বুদ্ধ বললেন, ‘মহারাজ, এ স্বপ্নের ফলও বহুকাল পরে ফলবে, সে সময় মানুষ বয়োবৃদ্ধকে সম্মান করবে না, মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়িকে উপেক্ষা করে নিজেরা সংসারে কর্তৃত্ব করবে, স্বীয় ইচ্ছায়বৃদ্ধদের খাওয়াবে, ইচ্ছা না হলে খাওয়াবে না। তখন অসহায় মা-বাবা ও বয়োজ্যেষ্ঠরা সদ্যোজাত বাছুরের দুগ্ধপানের ন্যায় স্বীয় সন্তানের অনুগ্রহে অন্নভোজীর মতো হবে’।
চতুর্থ স্বপ্নঃ মহারাজ বুদ্ধ ভগবানকে বললেন, ‘ভন্তে, স্বপ্নে দেখলাম, লোকে ভার বহনোপযোগী বলিষ্ঠ বৃষগুলো খুলে দিয়ে তরুন বৃষদের যুগবদ্ধ করলো, কিন্তু এরা ভার বহন করতে না পেরে যেখানে দাড়িয়ে ছিলো সেখানেই স্থিত আছে’। এ স্বপ্নের ফল কী হবে?
বুদ্ধ বললেন, ‘মহারাজ, এ স্বপ্নের ফলও বহুকাল পরে ফলবে, একসময় মানুষ অধর্মপরায়ন হয়ে বয়োবৃদ্ধ, সুপণ্ডিত, কর্মকুশল ও রাজ্য পরিচালনায় দক্ষ মন্ত্রীদের যথার্থ মুল্যায়ন করবে না বরং অদক্ষ তরুনদের মুল্যায়ন হবে। এ যেনো, ভার বহনোপযোগী বলিষ্ঠ বৃষগুলো খুলে দিয়ে তরুন বৃষদের যুগবদ্ধ করার মতো’।
পঞ্চম স্বপ্নঃ মহারাজ বুদ্ধ ভগবানকে বললেন, ‘ভন্তে, আমি পঞ্চম স্বপ্নে দেখলাম, একটি ঘোড়ার দু’দিকে মুখ, উভয় মুখে খাবার দিচ্ছে ও উভয় মুখে খাচ্ছে’। এ স্বপ্নের ফল কী হবে?
বুদ্ধ বললেন, ‘মহারাজ, এ স্বপ্নের ফলও বহুকাল পরে ফলবে, যখন রাজা অধার্মিক হবে তখন এ স্বপ্ন ফলবে। তখন অবোধ ও অধার্মিক রাজা, অধার্মিক ও লোভী লোকদের বিচারক নিয়োগ করবেন। স্বপ্নদৃষ্ট ঘোড়ার মতো বিচারক দোষী-নির্দোষ উভয়ের কাছ হতে ঘুষ গ্রহণ করবে, ফলত যথার্থ বিচার হবে না’।
ষষ্ট স্বপ্নঃ মহারাজ বুদ্ধ ভগবানকে বললেন, ‘ভন্তে, আমি ষষ্ট স্বপ্নে দেখলাম, একজন মানুষ বহুমূল্য, সুদৃশ্য এক স্বর্ণপাত্র নিয়ে বয়স্ক এক শৃগালকে তাতে মূত্রত্যাগ করতে বলছে, শৃগালও তাই করলো’। এ স্বপ্নের ফল কী হবে?
বুদ্ধ বললেন, ‘মহারাজ, এ স্বপ্নের ফলওবহুকাল পরে ফলবে, তখন রাজারা অভিজাতদের অবিশ্বাস করবে, অসম্মান করবে ও নীচ বংশজাতদের উচ্চ পদ দেবেন, এভাবে অভিজাতদের দুর্গতি ও নীচবংশজাতদের উন্নতি হবে। এমন কী, বয়স্ক শৃগালের স্বর্ণপাত্রে মূত্রত্যাগের মতো উচ্চবংশীয় কন্যা নীচবংশীয়কে সমর্পন করতে হবে’।
সপ্তম স্বপ্নঃ মহারাজ বুদ্ধ ভগবানকে বললেন, ‘ভন্তে, আমি সপ্তম স্বপ্নে দেখলাম, এক লোক চৌকিতে বসে রশি তৈরী করছে, যা তৈরী করা হচ্ছে তা চৌকির নীচে সংরক্ষন করছে, লোকটির অজান্তে চৌকির নীচে থাকা এক শৃগালী রশিটি যতোটুকু বানানো হচ্ছে সবটুকু খেয়ে ফেলছে’। এ স্বপ্নের ফল কী হবে?
বুদ্ধ বললেন, ‘মহারাজ, এ স্বপ্নের ফলও বহুকাল পরে ফলবে, তখন মাতৃজাতি ঘোর অনৈতিকতায় লিপ্ত থাকবে, পর পুরুষ গমন, সুরাপান, অলঙ্কার লোলুপতা, ভ্রমণলোলুপতাসহ হেন কোনো কুকর্ম থাকবে না যা তারা করবে না। উপরোক্ত অনৈতিকতার কারণে স্বপ্নদৃষ্ট শৃগাল যেমন বানানো রশি খেয়ে ফেলছে তদ্রুপ অতি কষ্টে স্বামীর অর্জিত অর্থ-সম্পদও স্ত্রীরা নষ্ট করে ফেলবে’।
অষ্টম স্বপ্নঃ মহারাজ বুদ্ধ ভগবানকে বললেন, ‘ভন্তে, আমি অষ্টম স্বপ্নে দেখলাম, রাজ্যের মূল দরজায় একটি বড় পূর্ণ কলসির চার দিকে অজস্্র খালি কলসি, চারদিক ও চার অনুদিক হতে আগত জনস্্েরাত সকলে জল এনে পূর্ণ কলসিতে ঢালছে, উপচে পড়া জল স্্েরাতধারায় প্রবাহিত হচ্ছে, তথাপি অন্য খালি কলসিতে কেউ জল ঢালছে না’। এ স্বপ্নের ফল কী হবে?
বুদ্ধ বললেন, ‘মহারাজ, এ স্বপ্নের ফলও বহুকাল পরে ফলবে, তখন পৃথিবীর বিনাশকাল আসন্ন হবে, রাজাগণ দুর্গত ও কৃপণ হবে, সর্বাপেক্ষা ঐশ্বর্যশালী রাজার ধনভাণ্ডারেও লক্ষমুদ্রা সঞ্চিত থাকবে না। অভাবগ্রস্থ রাজারা প্রজাদের বপন কাজে নিয়োজিত করবে, প্রজারা স্বীয় কাজের ক্ষতি সাধন করে রাজার ধনভাণ্ডার পূর্ণ করবে, কিন্তু নিজেদের ধনভাণ্ডার রাজাঙ্গনের শূণ্য কলসির মতো অপূর্ণই থেকে যাবে’।
নবম স্বপ্নঃ মহারাজ বুদ্ধ ভগবানকে বললেন, ‘ভন্তে, আমি নবম স্বপ্নে দেখলাম, পাঁচ প্রকারের পদ্ম ফোটে এ রকম গভীর ও বড় পুকুরের চারদিকে স্নানঘাট, এতে জলপান করতে চারদিক হতে দ্বিপদ ও চতুষ্পদ প্রাণী নামছে, কিন্তু পুকুরের মাঝখানের চাইতেও তীরসংলগ্ন জল স্বচ্ছ ও পরিষ্কার’। এ স্বপ্নের ফল কী হবে?
বুদ্ধ বললেন, ‘মহারাজ, এ স্বপ্নের ফলও বহুকাল পরে ফলবে, তখন রাজাগণ অধার্মিক হবেন, খারাপ মানুষ রাজার অনুগ্রহে প্রভুত্ব করবে ও ভালো মানুষ অবজ্ঞা ও দুর্দশার পাত্র হবেন। রাজার প্রিয়পাত্ররা শাসনকার্যে প্রাধান্য পেয়ে পুরানো ভালো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দখল করবে, প্রতিবাদ করলে নির্যাতন করে বিতাড়িত করবে। তখন ভালো ও নিরীহ মানুষগুলো নগর পরিত্যাগ করে প্রত্যন্ত প্রদেশে আশ্রয় নেবে। এতে পুকুরের মধ্যভাগের ময়লাযুক্ত জল ও তীরসংলগ্ন পরিষ্কার জলের মতো রাজ্যের মধ্যভাগ ভালো মানুষশূণ্য ও অরক্ষিত হবে’।
দশম স্বপ্নঃ মহারাজ বুদ্ধ ভগবানকে বললেন, ‘ভন্তে, আমি দশম স্বপ্নে দেখলাম, এক পাত্রে ভাত রান্না করা হচ্ছিলো, কিন্তু তা সুসিদ্ধ হচ্ছে না, কিছু রান্না হয়ে গলে গেলো, কিছু রান্না হয়েছে, আর কিছু চাউল রয়ে গেছে। এ স্বপ্নের ফল কী হবে?
বুদ্ধ বললেন, ‘মহারাজ, এ স্বপ্নের ফলও বহুকাল পরে ফলবে, এক সময় রাজারা অধার্মিক হবেন, সাথে সাথে ব্রাহ্মণ, গৃহপতি, জনগণ সকলে অধার্মিক হবে। ফলশ্রুতিতে বৃক্ষদেবতা, আকাশবাসী দেবতা, এমনকী উপাস্য দেব-দেবী পর্যন্ত অধর্মপথে চলবে। সামগ্রিক অধার্মিকতার কারণে অনাবৃষ্টি দেখা দেবে, শস্যাদি তেমন ফলবে না, তাই দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। হয়তো নগরে বৃষ্টি হবে, গ্রামে অনাবৃষ্টি, পাহাড়ি এলাকায় বৃষ্টি হবে, সমতলে অনাবৃষ্টি। রাজ্যের যেখানে যে পরিমাণ বৃষ্টি হবে সেখানে সেপরিমাণ শস্য ফলবে, ঠিক একেই পাত্রের ভাতের ভিন্ন ভিন্ন পক্কতার মতো ফসল ফলবে’।
একাদশ স্বপ্নঃ মহারাজ বুদ্ধ ভগবানকে বললেন, ‘ভন্তে, আমি একাদশ স্বপ্নে দেখলাম, লক্ষ মুদ্রার চন্দন বিক্রি হচ্ছে পুতি-তক্রের (দই দিয়ে তৈরী মাঠা) মূল্যে।
বুদ্ধ বললেন, ‘মহারাজ, এ স্বপ্নের ফলও বহুকাল পরে ফলবে, তখন আমার প্রতিষ্ঠিত শাসনের অবনতি হবে, এসময় ভিক্ষুরা নির্লজ্জ ও লোভপরায়ণ হবে, আমি যে সকল কর্ম করতে নিষেধ করেছি ভিক্ষুগণ লাভ-সৎকারের আশায় সেকর্ম করবে। যে ধর্মের মূল্য নির্বাণরূপ মহারত্ন তা সামান্য চীবর, অর্থ ও লাভ-সৎকারের কাছে বিক্রি হবে, ঠিক যেমনভাবে লক্ষ মুদ্রার চন্দন বিক্রি হচ্ছে পুতি-তক্রের (দই দিয়ে তৈরী মাঠা) মূল্যে’।
দ্বাদশ স্বপ্নঃ মহারাজ বুদ্ধ ভগবানকে বললেন, ‘ভন্তে, আমি দ্বাদশ স্বপ্নে দেখলাম, যেনো খালি এক অলাবুপাত্র (লাউ দিয়ে নির্মিত হালকাপাত্র) জলে ডুবে গেলো।
বুদ্ধ বললেন, ‘মহারাজ, এ স্বপ্নের ফলও বহুকাল পরে ফলবে, তখন রাজা হবেন অধার্মিক, সব কিছু চলবে বিপথে। রাজারা সদ্বংশীয়দের অবজ্ঞা করবে ও অসদ্বংশীয়দের সম্মান করবেন। খারাপ মানুষ প্রভূত্ব পাবে, ভালো মানুষ দরিদ্র হবেন। রাজার সামনে, রাজাঙ্গনে, মন্ত্রভবনে ও বিচারালয়ে অলাবু-পাত্রের মতো খারাপ লোকের কথা প্রবল হবে। ভিক্ষু-সংঘের মধ্যেও পাত্র-চীবর, বাসস্থান বিষয়ে সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হলে দু:শীল ও পাপাচারী ভিক্ষুদের ভুল সিদ্ধান্ত সকলকে মানতে হবে, সুশীল ও বিনয়ী ভিক্ষুদের সঠিক সিদ্ধান্ত কেউ মানবে না। ফলশ্রুতিতে, সকল বিষয়ে অলাবু-পাত্রের মতো অন্ত:সারহীন ব্যক্তিদের জয় সর্বত্র বিরাজ করবে’।
ত্রয়োদশ স্বপ্নঃ মহারাজ বুদ্ধ ভগবানকে বললেন, ‘ভন্তে, আমি ত্রয়োদশ স্বপ্নে দেখলাম, গৃহসমান বড় বড় পাথর খণ্ড পানিতে নৌকার ন্যায় ভেসে যাচ্ছে’।
বুদ্ধ বললেন, ‘মহারাজ, এ স্বপ্নের ফলও বহুকাল পরে ফলবে, তখন অধার্মিক রাজারা খারাপ লোককে সম্মান করবে, খারাপ লোক উচ্চাসনে আসীন হবে, ভালো লোকের দুর্দশার সীমা থাকবে না। তখন লোকজনও ভালো মানুষকে তুচ্ছ করবে, খারাপ লোককে সম্মান করবে। রাজার সম্মুখে, মন্ত্রভবনে, বিচারালয়ে বিচারকুশল লোকের কথা ভাসমান শিলাখণ্ডের ন্যায় কারো হৃদয় স্পর্শ করবে না, তাদের কথা বৃথা ভেসে যাবে। ভিক্ষু-সংঘেও প্রকৃত ভিক্ষুর কদর থাকবে না, কারো হৃদয় স্পর্শ করবে না, আবর্জনার ন্যায় ভেসে যাবে’।
চর্তুদশ স্বপ্নঃ মহারাজ বুদ্ধ ভগবানকে বললেন, ‘ভন্তে, আমি চর্তুদশ স্বপ্নে দেখলাম, ছোট ছোট কিছু ব্যাঙ ধাবমান কালো ও বিষাক্ত এক সাপকে টুকরো টুকরো করে খাচ্ছে’।
বুদ্ধ বললেন, ‘মহারাজ, এ স্বপ্নের ফলও বহুকাল পরে ফলবে, তখন মানুষ রিপুর তাড়নায় তরুনী স্ত্রীর বশবর্তী হবে, গৃহের কর্মচারী, গৃহপালিত প্রাণী, স্বর্ণ-রৌপ্য, ধন সবই স্ত্রীর আয়ত্বে থাকবে। স্বামী যখন জিজ্ঞেস করবে, স্বর্ণ, রৌপ্য বা অমুক অমুক জিনিস কোথায়? তখন উত্তর হবে, তা তোমার জানার দরকার কী? তোমার কাজে তুমি ব্যস্ত থাকো, -এভাবে স্ত্রী স্বামীকে অবজ্ঞা করবে, স্বামী হবে ক্রীতদাস। তা যেনো ব্যাঙ কর্তৃক বিষাক্ত কালো সাপ খেয়ে ফেলার মতো’।
পঞ্চদশ স্বপ্নঃ মহারাজ বুদ্ধ ভগবানকে বললেন, ‘ভন্তে, আমি পঞ্চদশ স্বপ্নে দেখলাম, এক গ্রাম্য কাক সুবর্ণ রাজহংস পরিবৃত হয়ে বিচরণ করছে’।
বুদ্ধ বললেন, ‘মহারাজ, এ স্বপ্নের ফলও বহুকাল পরে ফলবে, তখন রাজাগণ দুর্বল হবেন, গজশাস্ত্র ও যুদ্ধবিদ্যায় অনভিজ্ঞ হবেন। রাজ্যভ্রষ্ট হবার ভয়ে স্বজাতীয় উপযুক্ত ব্যক্তিদের হাতে কোনো দায়িত্ব না রেখে নিম্নবংশীয় ব্যক্তির হাতে গুরুদায়িত্ব দেবেন। এরূপে উচ্চবংশীয় স্বজাতীয়রা রাজপ্রসাদ বঞ্চিত হয়ে জীবিকা নির্বাহের নিমিত্তে জাতিগোত্রহীন নিম্নস্তরের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করে কোনো রকমে বেঁচে থাকবে, এ যেনো কাকের প্রভূত্বে সুবর্ণ রাজহংসের বিচরণ সদৃশ’।
ষোড়শ স্বপ্নঃ মহারাজ বললেন, ‘এতোদিন বৃকরা (নেকড়ে বাঘ, শৃগাল, কাক) ছাগল বধ করে আহার করতো। কিন্তু, ‘ভন্তে, আমি সর্বশেষ স্বপ্নে দেখলাম, ছাগল বৃকদের দৌড়ে ধরে মুর্মূর করে খাচ্ছে। বৃকরা দুর হতে ছাগল দেখামাত্র খুব ভয় পেয়ে পলায়ন করছে ও ঝোপ-ঝাড়ে লুকিয়ে থাকছে’।
বুদ্ধ বললেন, ‘মহারাজ, এ স্বপ্নের ফলও বহুকাল পরে ফলবে, তখন নিম্নবংশীয়রা রাজার অনুগ্রহে প্রভূত্ব ভোগ করবে, উচ্চ বংশীয়রা দুর্দশাগ্রস্ত হবেন। রাজার প্রিয়পাত্র নিম্নবংশীয়রা ক্ষমতাশালী হবে, প্রাচীন উচ্চ বংশীয়দের ভূমিসহ সকল সম্পত্তি তারা গ্রাস করবে। প্রতিবাদ করলে নির্যাতনের শিকার হবেন, এমকি রাজাকে দিয়ে পর্যন্ত অত্যাচার করাতে কুণ্ঠিত হবে না। তাই উচ্চবংশীয়রা প্রাণভয়ে আত্মগোপন করে থাকতে বাধ্য হবেন। ভিক্ষু-সংঘেও একই অবস্থা বিরাজ করবে, পাপাচারী ভিক্ষুদের কাছে ধর্মধারী, সুশীল ভিক্ষুরা সর্বদা অত্যাচারিত হবেন’।
বর্তমান সময় প্রেক্ষাপটে কোশল রাজের ষোড়শস্বপ্ন
বর্তমান বিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা ও নানা দিক হতে উন্নতর অবস্থানে মনে করা হয়। কিন্তু এ বিশ্ব চরাচরে যুগে-যুগে, কালে-কালে যে সকল মহান ব্যক্তিগণ জন্ম নিয়ে বর্তমানে প্রয়াত হয়েছেন তাঁরা সকলে ও যাঁরা জীবিত আছেন প্রত্যেকে বলে গেছেন, এমন কী আমাদের দেখা সমাজ, রাষ্ট্র তথা পৃথিবী দিন দিন যেনো নীতি, নৈতিকতা, মানবতা ও আদর্শের দিক হতে নিম্নগতি প্রাপ্ত হচ্ছে। ঠিক এ কথাটি কোশল রাজের যোড়শ স্বপ্নে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভবতু সব্ব মঙ্গলং
ঋণ স্বীকারঃ উক্ত লেখাটি ঈশানচন্দ্র ঘোষ অনুদিত জাতক সাহিত্যের ‘মহাস্বপ্ন জাতক’ এর বর্তমান অংশ হতে সংকলিত। – সুমেধানন্দ মহাথেরো
প্রজ্ঞাবারিধি অধ্যাপক সুমেধানন্দ মহাথেরো, অগ্রসার বালিকা মহাবিদ্যালয়, অধ্যক্ষ, সার্বজনীন বুদ্ধরশ্মি বৌদ্ধ বিহার কমপ্লেক্স, মহাসচিচ (ভারপ্রাপ্ত), বাংলাদেশ বৌদ্ধ ভিক্ষু মহাসভা, ধর্মীয় সম্পাদক, অগ্রসার মেমোরিয়াল সোসাইটি অব বাংলাদেশ, সিনিয়র সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ-যুব, পিএইচডি গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি সুদেশক ও সংগঠক।