ত্রিলোকপূজ্য তথাগত গৌতম বুদ্ধ ৩৫ বৎসর বয়সে (৬২৩-৩৫) খ্রীষ্টপূর্ব ৫৮৮ অব্দে গয়ার পবিত্র বোধিমূলে বহু কাঙ্ক্ষিত চারি অসংখ্য লক্ষ কল্প দান পারমী, দান উপপারমী ও দান পরমার্থ পারমী পূরণ করে মহাসাধনার পুণ্যফলে বুদ্ধত্ব লাভের মধ্য দিয়ে দুঃখ সত্য, দুঃখের কারণ সত্য, দুঃখ নিরোধ সত্য ও দুঃখ নিরোধের উপায় সত্য সংক্ষেপে চতুরার্য সত্য এবং আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ আবিষ্কার করেন। মহাকারুনিক তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ তাঁহার সুগভীর গবেষনালব্ধ প্রজ্ঞা আলোকে নব আবিষ্কৃত সত্যধর্ম দেবমানবসহ বিশ্বের সকল প্রাণীর কল্যানে প্রচার প্রসার করার জন্য মহান ভিক্ষুসংঘ সৃষ্টি করেছেন। সেই থেকে আজো ২৫৬৭ বুদ্ধাব্দকাল পর্যন্ত সর্বকালের আধুনিক দেবমানবের দুঃখমুক্তির জন্য ভিক্ষুসংঘের প্রতি তাঁহার উপদেশ “চরথ ভিকখবে চারিকং, বহুজনের হিতায় বহুজনের সুখায়, লোকানুকম্পায, অত্থায হিতায সুখায দেবমনুস্সানং। অর্থাৎ হে ভিক্ষুগণ, তোমরা দিকে দিকে বিচরণ কর, বহুজনের হিতকর, বহুজনের সুখকর , জগতের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন এবং দেব মানবের হিতকর ও সুখের জন্য ধর্মদান কর। মহান মাননীয় ভিক্ষুসংঘ সেই আলোকে আজ অবধি সমাজ, সম্প্রদায়, জাতি ও আন্তর্জাতিকভাবে বুদ্ধের অমৃতময় সদ্ধর্মের বাণী প্রচার ও প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা প্রতিপালন করে চলেছেন। মহাকারুনিক তথাগত বুদ্ধ প্রথম দেবমানবের কল্যানে ঋষিপতন মৃগধাবে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের উদ্দেশ্যে “ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র” দেশনার মধ্য দিয়ে এই সত্যধর্মের প্রচার শুরু করেছিলেন। তিনি ও তাঁহার প্রজ্ঞাবান পঞ্চবর্গীয় শিষ্য কৌন্ডিন্য, বপ্প, ভদ্রিয়, মহানাম ও অশ্বজিতসহ মোট এই পৃথিবীতে ছয়জন অর্হত বিদ্যমান ছিলেন। পরবর্তীতে যুক্ত হয়েছিলেন শাক্যবংশীয় অগনিত শ্রেষ্ঠী মহাশ্রেষ্ঠীর আদরের অতিজাত পুত্রগণ ও তাঁহাদের ভক্ত অনুরাগী বন্ধুবান্ধব সেবকগনও। তাঁহাদের মধ্যে অন্যতম মহাজ্ঞানী সাধক পুণ্যপুরুষ পারমীবান মহাকাশ্যপ, সারিপুত্র, মহামোগ্গল্লান, আনন্দ, সীবলী, উপালী, অনুরুদ্ধ, নন্দ ও রাহুলসহ হাজারো কূল গৌরব ভিক্ষুসংঘ। এই মহান ভিক্ষুসংঘ শুধুমাত্র ধর্মজ্ঞান বা আধ্যাত্মিক সাধনায় উন্নত ছিলেন না, জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় তাঁহাদের পাণ্ডিত্য বিরাজমান ছিল। তাইতো জ্ঞান বিজ্ঞানে, গবেষনায়, শিক্ষা- দীক্ষায় ইউরোপ আমেরিকার সেরা বিদ্যাপীঠ অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ সৃষ্টির চিন্তাও আসেনি আর সেই প্রাচীনকালে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রথম বিদ্যাপীঠ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় যা ইতিহাস বিখ্যাত। আর সেই শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে পাঠদান করতেন প্রাজ্ঞ, বিদগ্ধ পণ্ডিতপ্রবর মহান বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘ। শাস্ত্রে উল্লেখ আছে, মহাপণ্ডিতপ্রবর শীলভদ্র, নার্গাজুন, ধর্মপাল, শান্তরক্ষিত, অতীশ দীপঙ্কর, চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ও আরো অনেক বিদগ্ধ জ্ঞানীগুণী মহাপুরুষগণ তাঁহাদের সর্বোচ্চ বিদ্যার্জন সমাপ্ত করে এই ঐতিহাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার মাধ্যমে পাঠদান করতেন। এমন বিচক্ষণ মহাপণ্ডিতপ্রবর গুণীজনদের প্রাণবন্ত অতি আধুনিক অধ্যাপনা ও সুগভীর গবেষণা কর্মে প্রায় দুই হাজার সুশিক্ষক ও দশ হাজার আবাসিক শিক্ষার্থী বিদ্যমান ছিলেন। বিশেষ করে কোরিয়া, জাপান, চীন, তিব্বত, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য ও তুরস্কের শিক্ষার্থীরা অধীর আগ্রহে শিক্ষা গ্রহণের জন্য দূর দূরান্ত থেকে বহু কষ্ট স্বীকার করে ছুটে আসতেন। এছাড়াও প্রাচীন ভারতে শিক্ষার উৎকর্ষতায়, শিল্প সংস্কৃতি বিকাশে ও কৃষ্টি সভ্যতা প্রকাশে তক্ষশীলা, বিক্রমপুর, মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, শালবন মহাবিহার ও পণ্ডিত বিহারের গুরুত্ব অপরীসীম।
তারই ধারাবাহিকতায় বহু জ্ঞানী, গুণী, প্রাজ্ঞ, পণ্ডিত, ধর্মদূত, গ্রন্থদূত, সাহিত্যিক, গবেষক, সুদেশক, সুবক্তা, নেতৃত্ববান, কর্মবীর, সুসংগঠক, মানবতাবাদী, আধ্যাত্মিক সাধক, পুণ্যপুরুষ, বিদর্শনাচার্য ও বহুগুণে গুণান্বিত ভিক্ষুকূল গৌরব, সংঘ সমাজ আমাদের প্রাতঃস্মরণীয়, বরণীয়, পূজনীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত আছেন। তাঁহাদের মধ্যে কেউ ধর্ম বিনয়ে আদর্শিক, কেউ মানবসেবায় আত্মোৎসর্গিত, কেউ গভীর ধ্যানচর্চায় আত্মবিমুক্তিতে সাধনামার্গে উন্নত , কেউ জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্বস্থানীয় আবার কেউ জাতি সম্প্রদায়কে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য আজীবন নীরবে নিভৃতে আইনি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। এমনই একজন আজীবন শিক্ষানুরাগী, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সভ্যতা, সাহিত্য, সংস্কৃতি বিকাশে অনন্য অবদান রেখে চলেছেন, মানবতাবাদী ভিক্ষু হিসাবে সর্বাধিক সুপরিচিত, সুসাহিত্যিক, সুগবেষক, কবি, লেখক, বহু ভাষাবিদ, জ্ঞানতাপস, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমাজ, সম্প্রদায় ও জাতিকে রক্ষা করার জন্য নিঃস্বার্থভাবে সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত কল্যাণকামী, তিনি বাংলা আমেরিকা বুড্ডিষ্ট ফেলোশিপ এর সুযোগ্য কর্ণধার ও প্রতিষ্ঠাতা , ক্যালিফোর্নিয়া সম্বোধি বিহারের সম্মানিত প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মানবতাবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষু পণ্ডিতপ্রবর পূজ্য ভদন্ত ডক্টর লোকানন্দ সি ভিক্ষু মহোদয়। যিনি সুদীর্ঘকাল আমেরিকায় অবস্থান করে সমগ্র বিশ্বব্যাপী বুদ্ধের অমৃত সুধা বিতরণ করেছেন মানব জাতির মহাকল্যাণে।
সুজলা সুফলা শষ্য শ্যামলা নদীমাতৃক লাল সবুজের প্রিয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহতম বাণিজ্যিক রাজধানী বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। সবুজে ঘেরা পাহাড়, নদী ও সমুদ্রবেষ্টিত অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি প্রাচ্যের রাণী খ্যাত চট্টগ্রাম জেলা। লুসাই পাহাড় থেকে নেমে আসা কর্ণফুলী নদী ও তার শাখা হালদা নদীর নৈসর্গিক নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে ভরপুর উত্তর চট্টগ্রাম তথা ফটিকছড়ি, রাঙ্গামাটি, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী ও চট্রগ্রাম শহর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। ১৬৬৬ খৃষ্টাব্দে মোগল সম্রাট সুবেদার শায়েস্তা খান কর্তৃক চট্রগ্রাম বিজয়ের ১০০০ বছর পূর্ব থেকে পুরো চট্টগ্রামে বৌদ্ধদের বসবাস ছিল। বিশেষ করে রাউজান উপজেলায় প্রাচীনকালের বৌদ্ধদের স্থাপনাসমূহ আবার বিনাজুরীতে চারশত বছরের পুরানো বৌদ্ধ বিহারের স্থাপত্যশৈলী থেকে অনুমান করা যায় এ অঞ্চল বৌদ্ধপ্রধান ছিল। অনেক গবেষণা থেকে জানা যায, বৌদ্ধধর্মের ভিক্ষুসংঘ বা পুরোহিত “রাউলি” খেকে রাউজান নামের উৎপত্তি। আবার অনেকে বলেন, যেহেতু অত্র অঞ্চল আরাকানী রাজ্যের অন্তর্ভূত ছিল তাই রাজ পরিবারের ভূমি হিসাবে ” রজোওয়াং” বলা হতো। সেই রজোওয়াং থেকে কালের বিবর্তনে রাউজান নামের উৎপত্তি। এভাবে রাউজান অঞ্চলের আদি বাসিন্দা হিসাবে বৌদ্ধদের প্রভাব বেশী। হালদা নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা শিক্ষা, সাহিত্য, ইতিহাস, ঐতিহ্যে, সংস্কৃতিতে, জ্ঞানে বিজ্ঞানে, ব্যবসা বাণিজ্যে, রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকাসহ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে মূখ্য অবদানের জন্য রাউজান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ বিপ্লবী অধিনায়ক মাষ্টারদা সূর্য্যসেন রাউজানের নোয়াপাড়া গ্রামে জন্মজাত, এশিয়ার সর্বপ্রথম ডি.লিট ডিগ্রী লাভ করেছেন বঙ্গীয় বৌদ্ধদের আলোকিত সূর্যসন্তান ড. বেনী মাদব বড়ুয়া রাউজানের সুপ্রসিদ্ধ বৌদ্ধপল্লী মহামুনি পাহাড়তলীতে জন্মজাত। এমনই সমাজ, সম্প্রদায়, জাতি ও রাষ্ট্রের বহু গুণী পণ্ডিতজনের জন্মধন্য এই পবিত্র জনপদ। তাঁদের মধ্যে অন্যতম একুশে পদকপ্রাপ্ত গবেষক আব্দুল হক চৌধুরী, শিক্ষাবিদ তোফায়েল আহমদ, কবি হামিদ আলী, কবি দৌলত কাজী, সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী, ভাষা সৈনিক আবদুল্লাহ আল হারুন, রাজনীতিবিদ ফজলুল কাদের চৌধুরী, মেয়র মহিউদ্দীন চৌধুরী, ব্যারিস্টার আনিসুল হক, নবীন চন্দ্র সেন, কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহ, একুশে পদক প্রাপ্ত মহাসংঘনায়ক শ্রীসদ্ধর্মভানক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের, একুশে পদকপ্রাপ্ত ছড়াসম্রাট সুকুমার বড়ুয়া, একুশে পদক প্রাপ্ত ডক্টর প্রনব কুমার বড়ুয়া, একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রফেসর বিকিরন প্রসাদ বড়ুয়া, রাজনীতিবিদ এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীসহ বহু গুণগ্রাহী গর্বিত পুণ্যপুরুষের স্মৃতিধন্য এই বিখ্যাত জনপথ।
তারই ধারাবাহিকতায় রাউজান উপজেলার বধিষ্ণু বৌদ্ধ গ্রাম পূর্ব আঁধার মানিক ঐতিহ্যবাহী চৌধুরী পরিবারে ১৯৫১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ধার্মিক পিতা প্রফুল্ল রঞ্জন বড়ুয়া ও পুন্যশীলা মাতা ধীরাবালা বড়ুয়া’র কোল আলোকিত করে এক পবিত্র দেবশিশু জন্মগ্রহণ করেন। পুত্র শিশু লাভে মাতাপিতা আনন্দে আত্মহারা। মাতাপিতার সেবাযত্নে ধীরে ধীরে অতি আদরের পুত্র বড় হতে লাগলেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। মা-বাবার হাত ধরে ছোটবেলা থেকে বাংলার প্রাচীনতম বৌদ্ধবিহার যা প্রতিষ্টিত হয়েছিল ১৬৬৪ খ্রীষ্টাব্দে আঁধারমানিক কল্যান বিহারে বিভিন্ন আচার অনুষ্টান ও উপোসথ দিন অষ্টমি, অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে যাওয়াআসা করতেন। অতীত অতীত জন্ম পারমীতে বুদ্ধের অমৃতময় বাণী ও দুঃখ মুক্তির একমাত্র উপায় অন্তর্জগতে রেখাপাত করতে শুরু করলো শিশুমনে। শিশুকাল থেকে পরিমিত জীবনবোধ, মিতভাষী, বন্ধুবৎসল ও বিদ্যাশিক্ষার প্রতি বিশেষ ঝোঁক পরিলক্ষিত হতো। শিশুকালে বাড়ির পাশে প্রাইমারি স্কুলে প্রথম শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি হলেও বেশিদূর পাড়ি দেওয়া সম্ভব হলো না। শৈশবে বাল্যবন্ধুদের সাথে গ্রামের মেটোপথে ঘুরে বেড়ানো, পাখির কলকাকলি, পুকুরের সাঁতার কাটা, গাছে গাছে ফল ফলাদি সংগ্রহ করা, গ্রামের সবুজ প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে বেড়ে ওঠা, নানারকম গ্রামীন খেলাধুলাতে বন্ধুদের সাথে আনন্দে মেতে থাকাসহ প্রাণময় উচ্ছ্বাসে দুরন্ত শৈশব পার করতে লাগলেন। হঠাৎ সহজসরল শৈশবে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। অসময়ে প্রাণপ্রিয় মাথার উপর ছায়াসদৃশ্য ব্রহ্মতুল্য পিতা প্রফুল্ল রঞ্জন বড়ুয়ার প্রয়ানে পুরো পরিবারে দেখা দেয় অশনিসংকেত। গর্ভধারিণী মা তাঁর অবুঝ পাঁচ সন্তানকে নিয়ে চরম অসহায়ত্বে দিনাতিপাত করছেন। তারপরও মমতাময়ী মা প্রাণপ্রিয় পুত্রদের বুকে নিয়ে শতকষ্টের মধ্যে কোনভাবে সংসারের দায়িত্ব প্রতিপালন করছেন। তাঁর তৃতীয় পুত্র শৈশব থেকে বিদ্যার্জনের জন্য ব্যাকুল।
তাই পিতৃহারা অবুঝ অসহায় প্রাণপ্রিয় পুত্রধন বিদ্যাশিক্ষার প্রবল ইচ্ছাশক্তি নিয়ে শিক্ষানুরাগী পরম মমতাময়ী মাতৃদেবীর ও পরম কল্যানমিত্র মামা ডা: সীতাংশু বিকাশ বড়ুয়ার উপদেশ ও অনুমতিক্রমে পুণ্যপুরুষ বিশ্ববরেণ্য মহাসংঘনায়ক শ্রীসদ্ধর্মভানক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের মহোদয়ের সাথে কমলাপুর ধর্মরাজিক মহাবিহারে সাক্ষাত করে শ্রদ্ধা বন্দনা নিবেদনে বিনয়ের সহিত জীবনের ইতিবৃত্ত বণর্না করেন। এখানে উল্লেখ যে, তৎকালে প্রজন্মের জাগরনে, শিক্ষা প্রসারে ও নারী শিক্ষার প্রভূত উন্নয়নে আবাসিক অনাবাসিক বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন বাংলার একজন মহীরুহ দিকপাল মানবতাবাদী বৌদ্ধভিক্ষু বিশ্ববরেণ্য শ্রীসদ্ধর্মভানক মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের মহোদয়। এমন একজন উদার হৃদয়ের মানবিক মহান পুণ্যপুরুষ যিনি অনাথের পিতা হিসাবে সর্বজনস্বীকৃত। তিনি পিতৃ-মাতৃহারা অবুঝ শিশুদের পিতৃ স্নেহ-মায়া- মমতা-আদর-সোহাগে প্রতিটি শিশুর অন্নদাতা, শিক্ষাদাতা ও আশ্রয় দাতা ছিলেন। অকপটে বিশ্বসভায় নিজের প্রাণপ্রিয় সন্তান বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তাঁহার অকাতরে সমাজকর্ম কোন লেখা, ভাষা, ও শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যাবে না শুধু হৃদয়ের স্পন্দন দিয়ে অনুভব করা সম্ভব। আজকের বাংলা বৌদ্ধসমাজের যে আশানুরূপ উন্নতি সমৃদ্ধি শ্রীবৃদ্ধি তারই অন্তরালে সমাজ সম্প্রদায়কে বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার প্রথম ও প্রধান কারিগর ছিলেন মহাসংঘনায়ক বড়ভান্তে। বংশ, গোষ্ঠী, বর্ণ, গোত্র, অবস্থান ও নিকায়ের ঊর্ধ্বে ওঠে নিরপেক্ষ বা ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে সবসময় স্বজাতির প্রতি গভীর মমত্ববোধে উজ্জীবিত ছিলেন। এককথায়, তিনি ছিলেন বাংলা মায়ের অহংকারের ধন, জাতির গর্বিত সন্তান। আজীবন সমাজের নিপীড়িত অসহায় দরিদ্র সন্তানদের দায়িত্ব নিয়ে তাঁদের প্রায় প্রত্যেককে যথোপযুক্ত পদে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন, আত্মোৎসর্গ করেছেন সমাজ, সদ্ধর্ম ও মানবতার কল্যানে। প্রতিষ্ঠা করেছেন রাউজানের অন্তর্গত হোয়ারাপাড়া প্রসিদ্ধ বৌদ্ধপল্লী, তাঁহার জন্মজনপদে অগ্রসার উচ্চ বিদ্যালয়, অগ্রসার মহিলা কলেজ এবং ঢাকা কমলাপুর ধর্মরাজিক উচ্চ বিদ্যালয়। বুদ্ধ দর্শনে বলা হয়, ” ন জচ্চা বসলো হোতি, ন জচ্চা হোতি ব্রাহ্মণো, কম্মুনা বসলো হোতি, কম্মুনা হোতি ব্রাহ্মণো। অর্থাৎ জন্মের কারনে কেউ চণ্ডাল বা ব্রাহ্মণ হয়না, কর্মের কারনে চন্ডাল বা ব্রাহ্মণ হয়”। তদ্রূপ পিতৃহারা অবুঝ শিশু মাত্র নয় বছর বয়সে কর্মযোগে সন্ধান পেলেন মহৎপ্রাণ মানবদরদী মহাজীবনের।
ষাটের দশকে তাঁহার সান্নিধ্যে অপরীসীম স্নেহধন্য ও আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে তাঁহারই প্রাণপ্রিয় শিষ্য সুপুরুষ, ধর্মাধিরাজ, অনাথপিতা ভদন্ত সুগতানন্দ মহাথের মহোদয়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তথাগত বুদ্ধের অপ্রেমেয় সত্য ধর্ম যাপিত জীবনে ধারন, প্রতিপালন ও আচরনের সুন্দর চিন্তনে বুদ্ধ প্রশংসিত প্রব্রজ্যা ধর্ম গ্রহন করলেন আর তাঁহার প্রব্রজিত নাম হলো লোকানন্দ সি শ্রামন। প্রায় দুই বছর ধর্মরাজিক মহাবিহারে অবস্থান করে গুরুদেবের সাথে ধর্ম বিনয় শিক্ষারত অবস্থায় দাদু ভান্তে মহাসংঘনায়কের আদেশক্রমে বৃহত্তর হোয়ারাপাড়া প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী সুদর্শন মহাবিহারে চলে আসেন। শিশু শ্রামন অত্যন্ত মেধাবী ও পরিশ্রমী ছিলেন। খুব অল্প সময়ে বৌদ্ধ ধর্মীয় দর্শন ও শাস্ত্রীয় বিষয়ের উপর ডিগ্রী অর্জন করে সকলকে মুগ্ধ করলেন। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়ে ধর্ম বিনয় শিক্ষার প্রতি গভীর মনোযোগী হয়ে পাকিস্তান পালি ও সংস্কৃত বোর্ডের অধীনে কৃতিত্বের সাথে সুত্র পিটক ও বিনয় পিটক বিশারদ উপাধি লাভ করেন। ১৯৬৯ সাল জীবনের আরেক মাহেন্দ্রক্ষণ, অপ্রেমেয় ত্রিলোকপূজ্য তথাগত বুদ্ধের আদর্শ দিকে দিকে প্রচার প্রসারে এবং নিজের ব্রহ্মচয্য জীবনকে সার্থক করার মানসে সংঘনায়ক শ্রীমৎ শুদ্ধানন্দ মহাথের মহোদয়ের উপাধ্যায়ত্বে এবং শ্রদ্ধেয় গুরুদেব ধর্মাধিরাজ অনাথপিতা ভদন্ত সুগতানন্দ মহাথের মহোদয়ের আচারিয়ত্বে পবিত্র ভিক্ষু উপসম্পদা লাভ করেন। পবিত্র ভিক্ষু নামও রাখা হয় পূর্ববর্তী শ্রামন্য জীবনের নামের সাথে মিল রেখে লোকানন্দ সি ভিক্ষু।
বিহারের যাবতীয় ধর্মীয় কার্যাদি যথাযথভাবে প্রতিপালনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যথাযথভাবে সময়ের সাথে সংগতি রেখে সুসম্পন্ন করতে পারেননি। তারপরও অদম্য ইচ্ছাশক্তি বিদ্যার্জনে প্রবল বাসনা থাকলে কাউকে দমিত করা সম্ভব নয়। এমন একজন প্রত্যুৎপন্নমতি ব্যক্তিত্ব সেই কিশোর বেলায় নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়েও রাঙ্গুনিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রাইভেটে পাকিস্তান আমলে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করার মহান গৌরব অর্জন করেন। মেট্রিকুলেশন পাশ করার পর ভদন্ত লোকানন্দ সি ভিক্ষুর হৃদয় আকাশে পুঞ্জিভূত উচ্চশিক্ষার উদ্দীপনা, উৎসাহ ও উচ্ছ্বাসে অজানাকে জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠলেন। খুঁজতে লাগলেন আন্তর্জাতিক বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহন করার অনন্য কোন সুযোগ। কিন্তু ভাগ্য সবসময় সুপ্রসন্ন হয়ে ওঠে না। হঠাৎ দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিরতা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লো, মুক্তিকামী মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করলো। শুরু হলো ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চে গভীররাতে নিরীহ বাঙ্গালী জাতির ওপর বর্বরোচিত পাকিস্তানি বাহিনীর নাটকীয় হত্যাযজ্ঞ। নয়মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে আমরা অর্জন করলাম স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড, লাল সবুজের জাতীয় পতাকা। বিশ্বের মানচিত্রে যুক্ত হলো নতুন একটি রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। এই মহান মুক্তিযুদ্ধে সকল বাঙ্গালি জাতি-ধর্ম-বর্ন নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করেছেন। বিশেষ করে মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের মহোদয় সর্বস্তরের মানুষের প্রাণ রক্ষা করেছেন আর অন্যদিকে দশম সংঘরাজ মহামান্য জ্যোতিঃপাল মহাথের মহোদয় আন্তর্জাতিকভাবে জনমত গঠনে অনন্য অবদান রেখেছেন। তাইতো এই দুই মহান বৌদ্ধভিক্ষু ব্যক্তিত্ব তাঁহাদের অসামান্য সমাজকর্মের স্বীকৃতস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদক লাভ করার মহাগৌরব লাভ করেন একমাত্র বিশ্ববরেণ্য, মহাপন্ডিত, মহামান্য দশম সংঘরাজ জ্যোতিঃপাল মহাথের মহোদয় এবং একুশে পদক অর্জন করেন মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের মহোদয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁহাদের অসামান্য গৌরবগাঁথা কীর্তি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম, শতাব্দী থেকে শতাব্দী এবং বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সাথে অমর স্মৃতি হয়ে আছেন এবং থাকবেন।
কিশোরবেলা থেকে জ্ঞানসাধক ভদন্ত লোকানন্দ সি ভিক্ষু মহোদয়ের বই পড়ার তীব্র আগ্রহ, হোয়ারাপাড়া সুদর্শন বিহারের বিশাল লাইব্রেরিতে নতুন নতুন বই সংযুক্ত হলে এমনকি ভারত বিচিত্রাসহ সাপ্তাহিক বা মাসিক সাময়িকী যা পেতেন সবটাতে চোখ রাখতেন বিশেষ আগ্রহে। ধ্যানে জ্ঞানে বিদ্যার্জনের মাধ্যমে মনোজগতকে উন্নত করার তীব্র প্রচেষ্টায় সদাজাগ্রত ছিলেন। কথাবার্তা আলাপ নেই বললেই চলে, খাওয়া দাওয়া খুবই পরিমিত কিন্তু বইপড়ার চরম আগ্রহ দিনদিন বেড়েই চলেছে। এভাবে বই পড়ার প্রতি তাঁহার এক অসাধারণ সাধনা জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এখনো পর্যন্ত। তিনি নিজেই গড়ে তোলেন এক বিশাল লাইব্রেরি। আর সেই লাইব্রেরির যথাযথ যত্ন নেওয়া, পরিপাটি করে বই সাজিয়ে রাখাসহ কেউ কোনসময় বই ধার নিলে দ্রুত বই ফেরত দেওয়ার জন্য বারবার তাগাদা দিয়ে বইটা সংগ্রহ করে নিদিষ্ট স্থানে রাখতে পারলেই যেন স্বস্তি বোধ করেন। ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দে মেট্রিক পাশ করার পর দেশ মাতৃকার লড়াইরের সময় দীর্ঘ নয়মাস বইপড়ার সাধনায় নিজেকে নিমগ্ন করলেন আর ধর্মবিনয় আয়ত্ব করতে লাগলেন। ত্রিশ লক্ষ শহীদের তাজা রক্ত ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের ত্যাগে অর্জিত সদ্য স্বাধীনতা লাভ করা বাংলাদেশ যুদ্ধ বিধ্বস্ততা থেকে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য জাতির পিতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিচক্ষণতার সাথে বিশ্বনেতাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার আহবান করলেন তাঁহার বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তির উপর। তা ছিল “সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি শক্রতা নয়” এবং তিনি বিশ্বাস করতেন “বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড”। এভাবে ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিসহ বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় হতে শুরু করে। এ অবস্থায় তরুন মেধাবী শিক্ষার্থী ভদন্ত লোকানন্দ সি ভিক্ষু মহোদয় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিভিন্ন দেশে শিক্ষা বৃত্তির অনুসন্ধানে ব্যতিব্যস্ত সময় পার করতে লাগলেন। সাধারণত আমরা সকলেই জানি সততা, একাগ্রতা ও শ্রম দিয়ে আত্মপ্রচেষ্টায় সাধনা করলে যে কোন ব্যক্তি তাঁহার অভীষ্ট লক্ষ্যে সফলতা পাবেই এতে কোন সন্দেহ নেই । ঠিক সেরূপ ভদন্ত লোকানন্দ পি ভিক্ষুর জীবনে বিশ্ব বৌদ্ধ সম্মেলন উপলক্ষ্যে বৌদ্ধ প্রধান দেশ শ্রীলংকা ভ্রমন করার এক অনিন্দ্য সুন্দর সুযোগ হাতছানি দিয়ে ডাকলো। যেই কথা সেই কাজ।
কাল বিলম্ব না করে ১৯৭৩ খ্রীষ্টাব্দে যথাসময়ে মহানন্দে জীবনের ইচ্ছাপূরণের স্বপ্ন বুননে মমতাময়ী মাতৃদেবীর মায়ামমতাকে তুচ্ছ করে দেশমাতৃকার প্রেমকে ভুলে কঠিন বাস্তব সত্যকে পাষাণ হৃদয়ে ধারণ করে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে শত প্রতিকূলতাকে ডিঙ্গিয়ে নবীন বয়সে দেশত্যাগ করে শ্রীলংকায় বিশ্ব সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে শুভযাত্রা করলেন। শুরু হলো দেশমাতৃকার বাইরের জগতে ভিন্ন দেশ ও ভিন্ন ভাষায় একা পথ চলার মহাযুদ্ধ, তিনি থেমে থাকার ব্যক্তি নন। শ্রীলংকায় সম্মেলনের পাশাপাশি খুঁজতে লাগলেন পড়াশোনার সুযোগ। কথায় আছে, মানুষ মনেপ্রাণে যা চায় তা পায়। ভদন্ত লোকানন্দ সি ভিক্ষুর জীবনের শুরুতে মনের সুপ্ত বাসনা পূরণের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক বৃত্তি পাওয়ার অসাধারণ গৌরব অর্জন করেন। তা ছিল “শ্রীলংকা জাতিকা সর্বোদায়া শ্রমদানা সঙ্গমায়া” হতে প্রাপ্ত। এ বৃত্তির অধীনে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হলো সুবিখ্যাত “বিদ্যালংকার বিশ্ববিদ্যালয়” যার বর্তমান নামকরণ হয় “ক্যালোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়”। দুই বছর মেয়াদী থেরবাদা ও মহায়ানার উপর “Diploma in Buddhist Studies” কোর্স দক্ষতার সাথে সমাপ্ত করেন। এরপর আর পিছনে ফিরে থাকাতে হয়নি ভদন্ত লোকানন্দ সি ভিক্ষু মহোদয়কে। তাঁহার আত্মমনোবল ও জ্ঞানের উৎকর্ষতায় বিদ্যার্জনের প্রবল আগ্রহে উচ্চশিক্ষায় মনোনিবেশ করলেন। ১৯৭৮ খ্রীষ্টাব্দে তিনি একই বিদ্যালংকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “Indoligy (The Study of Indian Histoty, Literature, Philosophy and Culture)” বিষয়ের উপর কৃতিত্বপূর্ণ সম্মান “স্নাতক ডিগ্রী” অর্জন করেন। স্নাতক ডিগ্রী লাভ করে তিনি নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সার্থকতা , মাতৃদেবীর আশাপূরণ, প্রিয় গ্রামবাসী ও মহান পূজ্য গুরুদেবের চাওয়াকে পাওয়ায় পরিণত করার মহাগৌরব অর্জন করে সবাইকে গৌরবান্বিত করেছেন। তিনি সদ্য স্বাধীন সার্বভৌম লালসবুজের প্রিয় বাংলাদেশসহ বাঙ্গালী জাতিকে সম্মানিত করেছেন।
প্রাতিষ্ঠানিক স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের পর মনোনিবেশ করলেন ধর্মবিনয়ের আদর্শিকতায়। সেই ধারাবাহিকতায় পণ্ডিত কোসগুডা ধর্মবংশ মহানায়ক স্থবির ও প্রধান অধ্যক্ষ মহাপণ্ডিত থালাল্লে শ্রী ধর্মানন্দ মহানায়ক মহোদয়ের স্নেহধন্য হয়ে শ্রীলংকা অমরাপুরা নিকায়ের হেড কোয়াটার ” জয়সেকরা আরামে” ধ্যান অনুশীলনসহ উচ্চতর পালি শিক্ষা সুসম্পন্ন করেন। বৌদ্ধ বিদ্যা চর্চার গভীর গবেষনা, পালি ও সংস্কৃত ভাষায় অধ্যায়নসহ মানসিক শক্তি আনয়নে ধ্যান অনুশীলনে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন। ইতিমধ্যে নিজেকে আরো উন্নত ও সমৃদ্ধ করার দৃঢ় প্রত্যয়ে পশ্চিমাবিশ্বে স্বনামধন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। যেহেতু ব্যয়বহুল শিক্ষা ব্যবস্থা তাই ফুল ফ্রী স্কলারশিপ (বৃত্তি) ও স্টুডেন্ট স্টাইপেন (উপবৃত্তি) সুবিধা বিবেচনা করে ভর্তির জন্য উপযুক্ততা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ কথোপকথনের মধ্য দিয়ে সুসম্পর্ক সৃষ্টির চেষ্টা শুরু করেছেন। ভদন্ত লোকানন্দ সি ভিক্ষু ততদিনে ভাষাগত দক্ষতা অর্জনে বেশ পারদর্শী ও বুদ্ধপুত্র হিসাবে সর্বজনীন হয়ে ওঠেছেন। শ্রীলংকার প্রায় ৯ বৎসর (১৯৭৩-১৯৮২) অবস্থান করে পালি, সংস্কৃত, সিংহলীজ ও ইংরেজি ভাষায় কথনে, বলনে ও লেখনে বেশ অভিজ্ঞ ও পাণ্ডিত্যতা লাভ করেন। সেই সুবাদে ওরিয়েন্টাল বুড্ডিষ্ট ষ্টাডিজের সম্মানিত প্রধান অধ্যাপক ড: লিউ এম প্রুডেন ( dr. Leo M Pruden) মহোদয়ের সাথে যোগাযোগ করার অনন্য সুযোগ আসে।জ্ঞানঅর্জনে অদম্য স্পীহা, নিজেকে জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার সাধনা এবং উচ্চতর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের স্বপ্নপূরণের জন্য এক দেবকায়ামনুষ্যের সন্ধান যেন পুণ্যশক্তিতে ধরা দিলো। ডক্টর প্রফেসর একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব উদার, আন্তরিক, মানবিক ও পরকল্যানকামী। তিনি মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করার সমস্ত বুদ্ধি পরামর্শ, সুযোগসুবিধা ও স্টুডেন্ট ভিসার বিষয়াদি ভদন্ত লোকানন্দ সি ভিক্ষু মহোদয়কে ওয়াকিবহাল করলেন । বলা চলে, তিনি শ্রীলংকায় ৯ বৎসর অবস্থান করে ধর্ম বিনয়, পালি ভাষা, সংস্কৃত ভাষা, ইংরেজী ভাষাসহ বুড্ডিষ্ট ষ্টাডিজে ডিপ্লোমা ও স্নাতক ডিগ্রী শেষ করে ১৯৮২ সালের ১৬ই এপ্রিল ডক্টর প্রফেসরের একান্ত আহবানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে লস এন্জেলেসে শহরে আগমন করেন। আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রে তেমন কোন বাংলা ভাষাভাষী লোক থাকতো না বললই চলে , দুরে দুরে মাত্র কয়েকজনের বাস ছিল। তখন বাঙ্গালি বিহার আমেরিকার কোথাও প্রতিষ্টিত হয়নি। নিরুপায় হয়ে লস এন্জেলেসে প্রতিষ্টিত হলিউড শ্রীলংকান বুড্ডিষ্ট টেম্পলে অবস্থান করার উত্তম সুযোগ লাভ করেন। ভদন্ত লোকানন্দ সি ভিক্ষু সৌহার্দপূর্ণ সহৃদতার সাথে প্রায় বছর খানেক উক্ত বিহারে অবস্থান করেন। তারপর একই শহরে এক স্বনামধন্য কোরিয়ান টেম্পলের আহবানে তিনি সেই টেম্পলে অবস্থান করতে শুরু করলেন।
কোরিয়ান টেম্পলের নিয়মিত জেন মেডিটেশন, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ইয়োগা, ভোরে ও সান্ধ্যকালীন সমবেত প্রার্থনা এবং সুত্র আবৃত্তি নিজের মধ্যে আয়ত্ব করতে শুরু করলেন।। সেই টেম্পলে অবস্থান করে উচ্চতর ডিগ্রী ও গবেষনা করার চেষ্টার অংশ হিসাবে লস এঞ্জেলেসের অন্যতম বিদ্যাপীঠ UCLA ( UNIVERSITY OF CALIFORNIA, LOS ANGELES) পড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাহেন্দ্রক্ষণ হাতের মুঠোয় ধরা দেয়। ঠিক যেন জন্মজন্মান্তরের পারমী ও পুন্যের মহাফলের প্রাপ্তিতা। আরেক কল্যানমিত্র অধ্যাপক কিস ডব্লিউ বোলে ( Prof. Kiss W. Bolle) এর তত্ত্বাবধানে ” History of Religion” এ অধ্যায়নের অনুপম সুযোগ লাভ করে শুধু সমাজ সদ্ধর্মকে নয় পুরো বাঙালি জাতিকে গৌরবান্বিত করেছেন। পড়ালেখার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার প্রবল আগ্রহে “Department of Political Science” এ “Research Assistance” পদে খন্ডকালীন কাজ পেয়ে ভীষন আনন্দে নবউদ্যমে মার্কিনমুলুকে পিতৃহারা নয় বছরের যে শিশুটি গৃহত্যাগ করেছিলেন, সেই শিশুটি তারুণ্যের শক্তিতে একাকী পদচারণে আজ যেন বিশ্বজয়ের পথে দেদীপ্যমান।
History of Religious সসম্মানে সফলভাবে উর্ত্তীণ হওয়ার গৌরব অর্জন করলেও জ্ঞান অন্বেষণে তিনি ধাবমান। অজানাকে জানার আগ্রহে বারবার যেন উজ্জীবিত হয়েছেন। ক্লান্তিবিহীন অধ্যবসায়ের পদচারনাতে এবার ১৯৮৭ খ্রীষ্টাব্দে লংবীচ শহরে Calstate (California state University) তে ” Asian Stadies” বিষয়ে পড়ার সুযোগ লাভ করেন । বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে Work Study আওতায় লংবীচ পাবলিক লাইব্রেরিতে “Librarian Assistant” পদে প্রায় সাড়ে তিনবছর কর্মরত ছিলেন। Librarian Assistant পদ থেকে উন্নীত হয়ে “Longbeach public Library staff” পদে আরো ছয় মাস দক্ষতার সাথে কাজ করেন। নিজের মননচর্চার উৎকর্ষসাধনে এবং কর্মময় জীবনকে সার্থক ও সফল করার স্বপ্নপূরণের মহান ব্রত নিয়ে California State Library থেকে স্কলারশিপ গ্রহনে আবারও নতুন এক বিদ্যাপীঠে San Jose University তে “Master of Library and Information Science” বিষয়ের উপর মাস্টার্স ডিগ্রি কৃতিত্বের সাথে সমাপ্ত করার মহাগৌরব অর্জন করেন। কর্মজীবনে পদার্পণের পরও সর্বোচ্চ সম্মান অর্জনে অপরিসীম কষ্ট স্বীকার করে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে ২০০৮ খ্রীষ্টাব্দে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করার অসামান্য গৌরব ও কৃতিত্বে মাতাপিতা, গুরুদেব ও মাতৃভূমিকে সম্মানিত করেছেন। তিনি “University of the West” Rosemead, California থেকে “Origin and Formation of Seats and Sectarianism in Early Buddhism – A critical Study of the Schism Samghabheda and Nikayabheda” বিষয়ের উপর ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জনের মধ্য দিয়ে আত্মসাধনার পূর্ণতা লাভ করেন। এখানে উল্লেখ করতে চাই, ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত আবার ২০০৮ সাল প্রায় সুদীর্ঘ ২০ বছর প্রবাসজীবনে জ্ঞান আহরনের প্রচেষ্টায় চারটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ ধর্ম বিনয়, ভাষাগত শিক্ষা, লাইব্রেরিয়ান হিসাবে শিক্ষা গ্রহনের কোথাও বিন্দুমাত্র আর্থিক খরচ তেমন করতে হয়নি। তাঁহার নিরলস মেধা, শ্রম, নিয়মানুবর্তিতা, সুচিন্তন, সুবচন, সুকর্মের ফলে “full free stipend and scholarship” নিয়ে নিজেকে একজন ঋদ্ধ, পরিপক্ব, সুগবেষক, জ্ঞানবৃক্ষ ও জ্ঞানতাপস রূপে সমাজ, সদ্ধর্ম ও জাতির কাছে সুনাম, সুখ্যাতি ও সুপরিচিতি লাভ করেছেন যা আমাদের বাঙ্গালীর জন্য মহাগৌরবের, গর্বের ও অহংকারের প্রতীক।
একজন আদর্শিক ব্রহ্মচর্য্য জীবন প্রতিপালনে তিনি সর্বোত্তম পেশা একজন গ্রন্থদূত লাইব্রেরিয়ান হিসাবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেছেন। কি অসাধারণ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি হলে এমন অনিন্দ্য সুন্দর মেধাবিকাশের অন্যতম বন্ধু বইয়ের সাথে সখ্যতা ও বসবাস শুরু করতে পেরেছেন। যা ভাবলেই আমি ও আমার মতো সকলে আবেগতাড়িত হবে বারংবার। যে ছোট্ট শিশুটা পিতৃ-মাতৃ স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে হাজারো সীমাবদ্ধতা মধ্য দিয়ে মহৎপ্রাণ সহৃদয়বান বুদ্ধপুত্রগনের স্নেহধন্য হলেও জীবনের স্বাদ আহ্লাদের ছোঁয়া না পাওয়া অবুঝ নিস্পাপ পবিত্র শিশুটি কিভাবে এতোদূর চড়াই উৎরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উন্নত সমৃদ্ধশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শতসহস্র প্রতিযোগিতার মধ্যেও নিজেকে একজন সফল ব্যক্তিত্ব ও সুপ্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরিয়ান হিসাবে গড়ে তুলেছেন তা সত্যি বিস্ময়কর অভিযান। সুমহান সম্মানজনক পেশায় সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর নিষ্টার সাথে যথাযথ কর্তব্য পালন শেষে বর্তমানে অবসর জীবনও লেখালেখি চর্চায় সুন্দরতম দিন যাপন করছেন। পণ্ডিতপ্রবর জ্ঞানবৃক্ষ ভদন্ত ড: লোকানন্দ সি ভিক্ষু মহোদয়ের প্রত্যুৎপন্ন বিদ্যুৎসাহী তেজোদৃপ্ত আলো থেকে আলোকিত জীবনের দুঃসাধ্য স্বপ্নপূরণের বাস্তব জীবনচরিতকে কুর্নিশ ও অভিবাদন জানাই।
পুজ্য পণ্ডিত ডক্টর লোকানন্দ সি ভিক্ষু মহোদয় সময়ের প্রতি যথেষ্ট সচেতন, তাই তিনি জীবনের শুরু থেকে সময়ের যথার্থ ব্যবহার করেছেন। জ্ঞানঅর্জনে অংশ হিসাবে আজীবন বই পড়ার অভ্যাস যেমন গড়ে তুলেছেন তেমনি নতুন নতুন ভাষাকে আয়ত্ব করেছেন। তাঁহার একাধারে বাংলা, ইংরেজী, পালি, সংস্কৃত, জাপানিজ, সিংহলিজ, হিন্দী, ফ্রান্স, জার্মান, স্পেনীশ, কোরিয়ান, ভিয়েতনামিজ ভাষাসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা রপ্ত করার পাণ্ডিত্য রয়েছে। তিনি একজন সুঅভিজ্ঞ ভাষাবিদ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সম্মেলন, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে অংশ গ্রহন করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন এবং অনেক যুগোপযোগী মূল্যবান গবেষনাধর্মী প্রবন্ধ উপস্থাপন করে স্বদেশের সম্মান অক্ষুণ্ণ রেখেছেন একজন বাঙ্গালীর গর্বিত সন্তান হিসাবে। তিনি বাংলায় তেমন বেশী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ না করলেও বাংলার প্রতি তাঁহার মমত্ববোধ অপরিসীম। তিনি বাংলাকে দেখেন ছোট্ট শিশু কিশোরের মন দিয়ে। তাই তিনি ব্যস্ততম জীবনের মধ্যেও ছোটদের জন্য নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন শিশুতোষ ছড়া, কবিতা ও গল্প। ছোটকাল থেকে লেখালেখির চর্চা ছিল তা বর্তমানে আরো বিকশিত হয়েছে। তাঁহার প্রকাশিত ছোটদের উপযোগী বইসহ অন্যান্য প্রকাশনা যথাক্রমে ১. ছড়া কবিতার ছড়াছড়ি, ২. ছড়ার ঝিলিমিলি, ৩. কবিতার প্রথম খসড়া ও তারপর, ৪. বৌদ্ধিক ও অন্যান্য কবিতা, ৫. স্বদেশের মুখ, ৬. Abhidarmakosa Of Acariya Vasubandhu – English by Dr. Leo M Pruden and Sanskrit Translation and Edited by Lokananda C Bhikkhu. ৭. Split in the Sangha: How did it happen? ( A study in the schism in early Buddhist monastic Tradition) by Lokananda C Bhikhu ৮. A Critical Study in the Schism in Early Buddhist Monastic Tradition- by Lokananda C Bhikkhu ৯. “Abhidarmakosabhasyam”- Volume i, ii, iii, iv,- English Translation by Leo M Pruden and Sanskrit Translation by Dr. Lokananda C Bhikkhu
বইগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা করলে কলেবর বৃদ্ধি পাবে তাই সেদিকে না গিয়ে শুধু অল্প কথায় বলতে চাই, শিশুতোষ বইগুলোতে গ্রাম বাংলার নৈসর্গিক সৌন্দর্য, নদ, নদী,ফুল, পাখি, বন জঙ্গল, প্রকৃতি, পরিবেশ, হাসিটাট্টা, আনন্দ বেদনা তুলে এনেছেন। আর ধর্মীয় ও থিসিস বইগুলো ধর্মদর্শন, জীবনদর্শন ও আধ্যাত্মিক চিন্তা, কৃষ্টি সভ্যতা তুলে ধরেছেন যা শিক্ষার্থীদের পাঠদানের সহযোগী গ্রন্থ হিসাবে বিশেষ বিবেচনায় পাঠ উপযোগী । একজন সাধারন মানুষ তাঁহার জীবন ও কর্ম প্রতিপালনের পরও ব্যস্ততম রাষ্ট্রে অবস্থান করে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ফেলে আসা বাংলাকে মনের আবেগে, ছন্দে, সৃজনে আধুনিকতায় শিশুকিশোরের উপযোগী প্রকাশনা প্রশংসনীয় মননশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক, সাহিত্যপ্রেমী, সৃষ্টিশীল, আধুনিক কবি, লেখক, প্রবন্ধকার ও সুগবেষক হিসাবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।
সব্বদানং ধম্মদানং জিনাতি – ধর্মদান সকলদানকে জয় করে। তদানীন্তন কালে বুদ্ধধর্ম সম্প্রসারিত হয়েছে রাজকীয় পৃষ্টপোষকতায়। এখনো দানশীল ধার্মিক উদার ব্যক্তিত্বগনের সার্বিক সহযোগিতায় বিশাল বিশাল ধর্মদানের প্রাণকেন্দ্র বিহার নির্মিত হচ্ছে। পূজ্য ডক্টর লোকানন্দ সি ভিক্ষুর আজীবনের স্বপ্ন ছিল প্রজন্মের কল্যানে , বুদ্ধের অকালিকো সত্যধর্ম দেবমানবের কল্যানে প্রচার প্রসারে একটা নিজস্ব স্থাপনা প্রতিষ্ঠিত করবেন।একদিকে মহামান্য মহাসংঘনায়ক শ্রীসদ্ধর্মভানক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের মহোদয় আমেরিকা ক্যালিফোর্নিয়া ভিজিট করতে আসলে শ্রদ্ধেয় ভান্তের সাথে শ্রীলংকান টেম্পলে সাক্ষাত হলে, তিনি ভান্তের প্রতি আদেশবসত হয়ে প্রস্তাব রেখেছিলেন বাঙ্গালী বৌদ্ধদের জাতিসত্ত্বার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য একটা বিহার প্রতিষ্ঠা করে সম্বোধি বিহার যেন নামকরণ করা হয়। গুরুর আদশকে গভীর শ্রদ্ধায় অন্তরে ধারণ করে বিহার প্রতিষ্ঠায় আত্মমগ্ন হলেন। উন্নত বিশ্বে ব্যয়বহুল জীবনে ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের পক্ষে একক দানে বিহার নির্মাণ করা অসম্ভব। তাই তিনি সন্ধান পেলেন দীর্ঘদিনের ধর্মবন্ধু শ্রীলংকান বিশিষ্ট ব্যবসারী মি. ওয়ালটার জয়সিংহ মহোদয়ের। ঊনার সাথে বিহার প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে আলোচনা করলে তিনি প্রায় ১লক্ষ ডলার ডোনেশন দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতবদ্ধ হলেন। ব্যাংক লোন পাশ করার জন্য যাঁরা ক্রেডিট দাতা হিসাবে এগিয়ে এসেছেন শ্রদ্ধেয় ভান্তের ভ্রাতুষ্পুত্র বাবু বকুল চৌধুরী, ভ্রাতুষ্পুত্রবধু মিস নিশা চৌধুরী ও সদ্ধর্মপ্রাণ বাবু সুজেল বড়ুয়া তাঁদের আন্তরিকতা সকলকে কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করেছেন। এভাবে পূজ্য ভান্তের একাগ্রতা, ধর্মানুরাগী ও সম্প্রদায়ের প্রতি দায়বদ্ধতায় অত্যন্ত ব্যয়বহুল দৃষ্টিনন্দন, সুন্দর ও সহজ যোগাযোগসহ সর্বদিক বিবেচনায় উৎকৃষ্ট ঘর কিনতে সক্ষম হয়েছেন। বিহারের নামকরন নির্ধারিত সম্বোধি বিহার হিসাবে রাখা হয়। এই সম্বোধি বিহারকে কেন্দ্র করে তিনি “বাংলা আমেরিকা বুড্ডিষ্ট ফেলোশীপ” নামে একটা সংগঠন রেজিস্ট্রেশন করেন। এই বিহার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে পূজ্য ভান্তেসহ সকল গৃহীসংঘের অবদান ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে। এই বিহারে যাবতীয় ধর্মীয় কার্যাদি সুসম্পন্ন হয়ে থাকে। সকাল সন্ধ্যা সমবেত প্রার্থনা, বুদ্ধ পূজা, সংঘদান, অষ্ট পরিষ্কার দান, ধর্মদেশনা, শিশুদের ধর্মশিক্ষা ও বাংলা শিক্ষা, ধ্যানচর্চা, বর্ষাবাস উৎযাপন, অষ্টমী, অমাবস্যা, পূর্ণিমাতে শীল প্রদান, বিশেষ বিশেষ দিন উৎযাপনসহ বিভিন্ন সামাজিক ও জাতীয় অনুষ্টানাদি প্রতিপালন করা হয় যথাযোগ্য ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে। বাঙ্গালী বৌদ্ধদের ধর্মীয় আচার অনুষ্টানের জন্য সবসময় সকলের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয় এ বিহারকে। তাই সম্বোধি বিহার ধর্মানুরাগী প্রত্যেক নরনারীর জন্য এক আবেগ, ভালোলাগা ও পবিত্রতম স্থান। পূজ্য ভান্তের একদিকে যেমন স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছে অন্যদিকে বহু কষ্ট স্বীকার করে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নতুন নতুন প্রজন্ম ও সমাজকে সম্বোধি বিহার উপহার দিয়ে তিনি বিহার নির্মান করে অমরত্ব লাভ করেছেন। আজীবন যতদিন বিহারে ধর্মীয় কার্যাদি সুসম্পন্ন হবে ততদিন তাঁহার নাম ও সুকীর্তি অক্ষুন্ন থাকবে।
তিনি শুধু বিহার নির্মানে ক্রান্ত হননি। সবসময় দেশ থেকে বড় বড় সংঘমনীষাগন আমেরিকা মহাদেশ ভ্রমনে আগমন করলে পূজ্য ভান্তেগণ তাঁহার আতিথেয়তা লাভ করেন। ভান্তে যারপরনাই সেবাশুশ্রূষা দিয়ে তাঁহাদের প্রত্যেককে সন্তুষ্ট করার আপ্রান চেষ্টা করেন। বিহার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে দেশবিদেশের বহু পূজ্য জ্ঞানীগুণী প্রজ্ঞাবান ভিক্ষুসংঘগণ এ বিহারে আগমন করেছেন এবং ধন্য হয়েছেন। এছাড়াও স্বদেশে পরিবার, জ্ঞাতিদের সুখ দুঃখে, আপদ বিপদে, সংকটে সমাধানে তাঁহাকে স্মরণ করলে তিনি নীরবে নিভৃতে সেবা দান করেন। গরীব অসহায় দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখার সুযোগ করে দেন, অসহায় পরিবারের কন্যা দায়গ্রস্ত মাতাপিতাদের পাশে দাঁড়ান। কোভিড কালে তিনি নীরবে অকাতরে দানহস্ত সম্প্রসারিত করেছেন। মানবদরদী কল্যানমিত্র হয়ে মাতৃভূমির মায়ার সর্বদাই নিপীড়িত অভাবগ্রস্ত মানুষের কল্যানে বহুবিধ কল্যাণমুখী কার্যাদি সুসম্পন্ন করেন। পঞ্চাশ বছর দেশের বাইরে অবস্থান করেও মাতৃভূমির সমাজ সদ্ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতি অসাধারণ মুদিতা গুণধর্ম বিরল দৃষ্টান্ত। তিনি যেন শিখরের টানে এখনো নিজ জন্মতীর্থের জন্য বারেবারে কাতর ও ব্যাথা অনুভব করেন। এভাবে তিনি প্রকৃত দেশপ্রেমিক হয়ে দূর প্রবাসে অবস্থান করেও মনেপ্রাণে স্বদেশের মাটি ও মানুষের সাথে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করে চলেছেন।
বিদেশের মাটিতে অবস্থান করে সুদীর্ঘ চার দশক ধরে আমেরিকা মহাদেশে বাঙ্গালী জাতি ও সম্প্রদায়কে স্থায়ীভাবে বসবাস করার নিশ্চয়তা আনয়নের জন্য দিনরাত ছুটে চলেন এখনো বার্ধক্য কোন বাধা হতে পারেনি। বিশেষ করে যারা রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহন করে (Asylum case) তাদের জন্য ইমিগ্রেশন কোর্টে দাঁড়ানোর জন্য তাঁহার বিকল্প কেউ নেই আর হবেও না। তিনি জাতির বহুমূখী কল্যান সাধনে নিজে আইনজীবী না হয়েও একজন দক্ষ আইনজীবী ন্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা সংক্রান্ত যাবতীয় পরামর্শ, গ্রীনকার্ড বিষয়ক, সিটিজেনশীপ ইন্টার্ভিউ সংক্রান্ত, স্পন্সরশীপ সংক্রান্ত জটিলতাসহ ইমিগ্রেশনের যাবতীয় বিষয়াদিসহ বিভিন্ন সরকারী নির্ভুলভাবে ফ্রম পূরণের নিয়মাবলী সুচারুরূপে আন্তরিকতার সাথে যে বা যিনি তাঁহার কাছে আসেন প্রত্যেককে যথাসম্ভব সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এমনকি বর্তমান শরীরের নানা জটিলতার মধ্যেও কেউ এসে কোর্টে যেতে হবে বললেই তিনি সহাস্য বলেন, “আমি প্রস্তুত চলো”— এমন উদার মানবিক হৃদয় পশ্চিমাবিশ্বে যান্ত্রিকতার যুগে দ্বিতীয় কেউ বলবে কিনা আমার জানা নেই। আর কোন বৌদ্ধভিক্ষু তো নয়ই কোন গৃহীসংঘের মধ্যেও এমন মহৎপ্রাণ আমাদের পরিবার সমাজ সংগঠনে নেই বললেই চলে। তিনি একজন বিশাল হৃদয়ের সাক্ষাত দেবকায়ামনুষ্য পরম পরোপকারী সাংঘিক ব্যক্তিত্ব। চল্লিশ বছরের অধিককাল ধরে শতাধিক ব্যক্তির নিঃস্বার্থ উপকার সাধন করেছেন তাদের বংশপরম্পরা পূজ্যভান্তের উদারতা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করা উচিত বলে আমি মনে করি। আমেরিকায় এমন লোকও আছে ৫০/৬০ বছর বসবাস করেও গ্রীনকার্ডের ছোঁয়া পায়নি তাই দেশের মাটিকে স্পর্শ করতে পারেনি জীবদ্দশায়। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য মনপ্রাণ চটপট করতে করতে দেহত্যাগ করেছেন। তাই অনেকসময় মানুষ সফল হলে পিছনের কথাগুলো ভুলে যায়। তাই কৃতজ্ঞতাপরায়ন ব্যক্তির স্বয়ং বুদ্ধ ভগবান প্রশংসা করেছেন দেবমানবের কল্যানে “মহামঙ্গল সূত্রে” আটত্রিশ প্রকার মঙ্গলের মধ্যে ২৪/২৫ নং মঙ্গলে তিনি বলেছেন,” সন্তুট্ঠি চ কতঞ্ঞুতা” অর্থাৎ “প্রাপ্ত বিষয়ে সন্তুষ্ট থাকা, উপকারীর উপকার স্বীকার করা”। এখানে একটা উদাহরণ দিয়ে বলতে চাই, ভগবান বুদ্ধ গয়ার বোধিদ্রুম মূলে শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে চারি অসংখ্য লক্ষ কল্প পারমী পূরণ করে সম্যক সম্বুদ্ধ হলেও যে বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় যে নিরাপত্তা তিনি পেয়েছেন, সেই বটবৃক্ষের প্রতি সকৃতজ্ঞপরায়ন হয়ে এক সপ্তাহ ধরে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। যা আমরা বোধি বন্দনাতে ৩য় লাইনে দেখতে পাই, ” ইমেহেতে মহাবোধি লোকনাথেন কতঞ্ঞূতা”।মহাকরুনাময় তথাগত বুদ্ধের উপদেশসমূহ প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় বিবেচনা করে আমাদের যাপিতজীবনে ধারণ, প্রতিপালন ও আচরণ করতে পারি তাহলে দুর্লভ মানবজীবন সার্থক, সুন্দর ও সফল হবে।
পূজ্য ডক্টর লোকানন্দ সি ভিক্ষুর জীবনে একটা বিশেষ গুণধর্ম আমাকে বারবার ভাবিত করে। শরীরের নানা জটিলতা, ব্যথা, বেদনা ও বার্ধক্য তাঁহাকে কোনদিন দুর্বল করতে পারেনি। তাঁহার অপরিসীম মনোবল, দৃঢ়তা ও প্রাণশক্তি। সাধারণত মানুষ সামান্য ব্যাধি আক্রমন করলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, মরার আগে যেন মরে যায়। কিন্তু ভান্তে বর্তমানে সপ্তাহে তিনবার কিডনি ডায়েলাইসিস করলেও যে কোন কুশলাদি জানতে চাইলে, হাস্যোজ্জ্বল ভাষন “বেশ ভালো আছি”। ভান্তের সহনশীলতা, ধৈর্য্য ও সাহসিকতা সকলের অনুকরণীয় আদর্শ। ভান্তে প্রায়সময় লংবীচ মেমোরিয়াল হাসপাতালে ভর্তি হন, যেহেতু আমি ঐ হাসপাতালে কাজ করি সময় সুযোগ করে ভান্তের খোঁজখবর নিতে গেলে আমি খুব চিন্তিত হলেও পূজ্য ভান্তের প্রাণময় হাসি দিয়ে বলেন, ” আমি তো বেশ আছি, কোন অসুবিধে নেই, তারা তো রাজকীয়ভাবে আমাকে রেখেছে”। অথচ তাঁহার শরীরের কত ক্ষত বিক্ষত, ব্যথা, যন্ত্রনা তিনি নীরবে সহ্য করছেন। এমন শান্ত, স্থির, মানবিক, অল্পতে তুষ্ট, মিতভাষী জ্ঞানগর্ভ পুণ্যপুরুষকে আমরা যথাযথ সেবা, সম্মান ও পূজা দিতে পেরেছি কি- আমি নিজের কাছে আজ এই প্রশ্নের মুখোমুখি। আমরা এমন এক হিংসা কাতর দুর্ভাগা জাতি সময়ের যথার্থ ব্যবহার ও গুণীর কদর যেন বেঁচে থাকতে করতে পারিনা, মরণে যেন বারেবারে স্মৃতিকে অম্লান রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠি। ভগবান তথাগত বুদ্ধের অমৃত উপদেশ, বিনয়ী হয়ে গৌরবণীয় ব্যক্তির গৌরব করা, পূজনীয় ব্যক্তির পূজা করা, জ্ঞানী পণ্ডিত ব্যক্তির সেবা করা সর্বোপরি অসুস্থ রোগীর সেবাশুশ্রূষা করাকে স্বয়ং বুদ্ধের সেবা করা বলেছেন।
শ্রদ্ধেয় ভান্তে একজন প্রকৃতিপ্রেমী, সৌন্দর্যপিপাসু ও ভ্রমণবিলাসী। প্রকৃতির অপরূপ নয়নাভিরাম সৌন্দর্যকে নিবিড়ভাবে উপভোগ করার জন্য বারবার ছুটে যান দেশ থেকে দেশান্তরে। ছাত্রজীবনে এমন অনন্য সুযোগ লাভ করেছিলেন, বিশ্বভ্রমনের অংশ হিসাবে International Religion Foundation” এর অধীনে ১৭৫ (একশত পঁচাত্তর) জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে একজন প্রকৃত ভ্রমনপিপাসু ব্যক্তির জীবনে আশাতীত সুযোগ আসে। বিশ্বভ্রমনে অংশ হিসাবে দুইমাস ব্যাপী ভারত, কাঠমান্ডু, থাইল্যান্ড, হংকং, জার্মানি ও তুরস্কসহ বহু দেশ পরিভ্রমন করার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। এরপরও আন্তর্জাতিক সেমিনারের অংশ হিসাবে বহুবার থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, ফ্রান্স, ইতালি, ব্রিটেন, নরওয়ে, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ডসহ পুরো ইউরোপ মহাদেশ বারবার ভ্রমন করার অভিজ্ঞতা ও আনন্দময় স্মৃতি রয়েছে। ভ্রমণকাহিনী নিয়ে লোমহর্ষক ধারাবাহিক লেখাও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রকাশ করেছেন। যা পাঠে অনেক অজানা বিষয়, কিভাবে ধারাবাহিকভাবে ইউরোপ বা এশিয়া ভ্রমন করা সহজ, বিভিন্ন কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সভ্যতা, আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক উন্নত জীবনশৈলী বর্ণনা বেশ চমকপ্রদ। এমন রহস্যময় রোমাঞ্চকর ভ্রমণকাহিনী পাঠ করতে সকলে অধীর আগ্রহ প্রকাশ করতেন। কবি সুনির্মল বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা “সবার আমি ছাত্র” লাইনে বলতে চাই,
বিশ্ব-জোড়া পাঠশালা মোর,
সবার আমি ছাত্র,
নানান ভাবের নতুন জিনিস,
শিখছি দিবারাত্র।
পূজ্য পণ্ডিত ডক্টর লোকানন্দ সি ভিক্ষুর বিশাল জীবন ও কর্ম এই ক্ষুদ্র পরিসরে আমার মতো দীনজনের পক্ষে লেখা মোটেই সম্ভব নয় তারপরও তাঁহার প্রতি শ্রদ্ধান্বিত হয়ে লেখার অনুমাত্র চেষ্টা করেছি। তিনি এক অতি সাধারন জীবন থেকে একমাত্র আত্মমনোবলে বলীয়ান হয়ে অদম্য ইচ্ছাশক্তি, সময়নিষ্ঠা ও আত্মপ্রচেষ্টায় অসাধারণ মহাজীবন রচনা করেছেন। তিনি শুধু একজন ব্যক্তি নন তাঁহার জীবনচরিত বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় তাঁহার আদর্শিক উন্নত জীবনের গুণধর্ম একটা প্রতিষ্ঠান স্বরূপ। এ প্রসঙ্গে মনে পরছে, ভারতের বিখ্যাত পণ্ডিত , প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ডা: বিধানচন্দ রায় তাঁর জীবনীগ্রন্হে লিখেছেন, আমি খুব একটা মেধাবী ছিলাম না কিন্তু একদিন ক্লাসে গিয়ে বোর্ডে একটা বাক্য দেখতে পেলাম। তা ছিল -” জীবনে যা করবে সর্বশক্তি দিয়ে করবে”। এই একটা বাক্য আমার জীবনকে বদলে দিলো”। ঠিক তদ্রুপ, আমাদের পূজ্য সংঘমনীষা শিশু বয়স থেকে বই আর বইয়ের সাথে জীবনকর্ম একই সূতায় বেঁধে সাধারন জীবন থেকে মহাজীবনের পথে হাঁটছেন একজন আলোকবর্তিকা হয়ে । তাঁহার সংগ্রামী আত্মপ্রত্যয়ী অনুপম সার্থক ও সফল মহাজীবন আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় আদর্শ, সম্মানের ও মহাগৌরবের।
আজ ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ খ্রীষ্টাব্দে রোজ রবিবার বিশ্ববরেণ্য ভিক্ষু ব্যক্তিত্ব, আজীবন শিক্ষানুরাগী, বহু ভাষাবিদ, বহু গ্রন্থপ্রণেতা, সুগবেষক, পরোপকারী, প্রচারবিমুখ, নীরব সাধকপ্রবর, কবি, লেখক, সাহিত্যিক, সম্বোধি বিহারের সুযোগ্য বিহারাধ্যক্ষ ও প্রতিষ্ঠাতা, সৎ, নিষ্টাবান, সজ্জন মিষ্টভাষী এবং মানবতাবাদী আদর্শিক ভিক্ষুকূলরবি পরম পূজ্য পণ্ডিত ডক্টর লোকানন্দ সি ভিক্ষু মহোদয়ের সংবর্ধনা ও সম্মাননা অনুষ্টানে আমি , আমার পরিবার এবং ডব্লিউএফবিবি (ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ বাংলাদেশী বুড্ডিষ্টস ) এর পক্ষ থেকে প্রাণঢালা বিনম্র শ্রদ্ধাভিনন্দন, বন্দনা, পূজা ও অর্ঘ্য নিবেদন করছি। যাঁরা এই পুণ্যময় গুণী পূজার আয়োজন করেছেন তাঁদের প্রতি অপরিসীম কৃতজ্ঞতা জানাই। এই গুণী পূজার মাধ্যমে আপনারা প্রজ্ঞাতার পরিচয় দিয়েছেন।
পরিশেষে পুন্যের কাছে তাঁহার সুস্বাস্থ্য ও শতায়ু প্রার্থনা করছি। আমার পরম কল্যাণমিত্র মানবতাবাদী, পরোপকারী, জ্ঞানসাধক, মহাস্থবির ডক্টর লোকানন্দ সি ভিক্ষু একজন প্রচার বিমুখ বৌদ্ধভিক্ষু । তাই আমার ক্ষুদ্র প্রচারের প্রচেষ্টাকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলি –
আপনারে তুমি সহজে ভুলিয়া থাক,
আমরা তোমারে ভুলিতে পারি না তাই।
সবার পিছনে নিজের গোপনে রাখ,
আমরা তোমারে প্রকাশ করিতে চাই।
ছোটোরে কখনো ছোট নাহি কর মনে,
আদর করিতে জান অনাদৃত জনে,
প্রীতি তব কিছু না চাহে নিজের জন্য,
তোমারে আদরি আপনারে করি ধন্য।
জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
জয়তু বুদ্ধ সাসনম।
জয়তু ডক্টর লোকানন্দ সি ভিক্ষু মহোদয়।
প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন এনজিও কর্মী, লং বীচ, ক্যালিফোর্নিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।