বাংলাদেশের অন্যতম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি এবং সম্মিলিত সনাতন জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতারের ঘটনায় দেশব্যাপী উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় সোমবার ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেফতার করে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন আদালতে হাজির করা হলে তার জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন বিচারক। এ ঘটনায় চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণ এবং আশপাশের এলাকাগুলোতে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়, যার ফলে একজন আইনজীবীর মৃত্যু এবং কমপক্ষে ২০ জন আহত হন।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস: সংখ্যালঘুদের কণ্ঠস্বর
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় এবং ধর্মীয় সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে আসছেন। ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস (ইসকন) থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় তিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও পরিচিত।
তবে, ইসকন সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে তাকে তাদের কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দিয়েছে বলে জানায়। এ বিষয়টি তার অনুসারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করলেও তার জনপ্রিয়তা কমেনি। বরং গ্রেফতারের পরে তার মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভ আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে।
চট্টগ্রামে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ
মঙ্গলবার দুপুরে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে চট্টগ্রাম মহানগর আদালতে হাজির করার সময় আদালত প্রাঙ্গণে শত শত অনুসারী জড়ো হন। তার জামিন আবেদন নাকচ হওয়ার পরে আদালত চত্বরে তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয়। বিক্ষুব্ধ জনতা প্রিজন ভ্যান ঘিরে ফেলে এবং স্লোগান দিতে থাকে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ার সেল, সাউন্ড গ্রেনেড এবং লাঠিচার্জ করে। এক পর্যায়ে সংঘর্ষ এতটাই তীব্র আকার ধারণ করে যে আদালত এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বেশ কয়েকটি দোকানপাট এবং স্থাপনায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
এই সংঘর্ষে একজন আইনজীবীর মৃত্যু হয়, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। আহত ২০ জনের মধ্যে সাতজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের আহ্বান
সংঘর্ষের মধ্যেই প্রিজন ভ্যানের ভেতর থেকে পুলিশের দেওয়া হ্যান্ডমাইকের মাধ্যমে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস তার অনুসারীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন,
“রাষ্ট্র অস্থিতিশীল হয় এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নষ্ট হয় এমন কিছু করবেন না। আবেগকে সংযত করে শক্তিতে পরিণত করুন এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে দাবিগুলো উপস্থাপন করুন।”
তবে তার এই আহ্বানেও উত্তেজিত জনতা আদালত চত্বর ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানায়, যা সংঘর্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
ভারতের উদ্বেগ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার এবং তার জামিন নামঞ্জুরের ঘটনায় ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে,
“বাংলাদেশে হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর ধারাবাহিক হামলার প্রেক্ষাপটে এই গ্রেফতার উদ্বেগজনক।”
ইসকনও বিবৃতি দিয়ে তার মুক্তির দাবি জানিয়েছে এবং বাংলাদেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যেন সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।
এছাড়া, কলকাতা এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলেও চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের হুঁশিয়ারি
স্থানীয় সরকার, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন,
“কেউ রাষ্ট্রদ্রোহের মতো ঘটনায় জড়িত থাকলে, সে যত বড় নেতা হোক না কেন, তাকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।”
সরকারি কর্মকর্তারা আরও দাবি করেন যে, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠী পরিবেশ অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।
আদালতের পরবর্তী পদক্ষেপ
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবীরা তার জামিন আবেদন নাকচের আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেছেন। আগামীকালের শুনানির পরে এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
পরিস্থিতি এখন কোন দিকে যাচ্ছে?
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার ও সংঘর্ষের ঘটনা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা এবং অধিকার নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা এবং তার মুক্তির দাবিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে।
বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও সংখ্যালঘুদের অভিযোগ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া বিষয়টিকে আরও স্পর্শকাতর করে তুলেছে।
পরবর্তী সময়ে আদালতের সিদ্ধান্ত এবং সরকারের ভূমিকা নির্ধারণ করবে যে, এই সংঘাতের সমাধান শান্তিপূর্ণভাবে হবে নাকি আরও উত্তেজনা সৃষ্টি করবে।