গত ২৫ নভেম্বর বাংলাদেশে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস প্রভুকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর গ্রেফতারির ঘটনা দেশব্যাপী রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে এবং বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ২৬ নভেম্বর, তাকে চট্টগ্রাম জেলা আদালতে পেশ করা হলে, আদালত তার জামিনের আবেদন খারিজ করে তাকে জেল হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। এসময় আদালত তার চারপাশে প্রচুর পুরিশ, র্যাব, আনসার, সেনাবাহিনীর বলয় তৈরি করা হয় এবং তাঁর পক্ষে ৫১ জন আইনজীবী ছিলেন। এর পর থেকে, চিন্ময় কৃষ্ণ দাস প্রভুর গ্রেফতারির প্রতিবাদে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা শুধু ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক এবং মানবাধিকার সম্পর্কিত সমস্যা হিসেবে সামনে এসেছে।
গ্রেফতারির পটভূমি এবং রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস প্রভু বাংলাদেশের সনাতন জাগরণ মঞ্চ এবং বাংলাদেশ সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোটের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন। এই দুটি সংগঠন বর্তমানে ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট’ নামে একটি আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, যার লক্ষ্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষা করা। গত ২৫ অক্টোবর, চট্টগ্রামে আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন এবং অভিযোগ করা হয়েছে যে, ওই সমাবেশে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা করেছেন। বিএনপি নেতা ফিরোজ খান এ বিষয়ে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করেন এবং সেই মামলা ভিত্তিতেই ৩১ অক্টোবর তাকে গ্রেফতার করা হয়।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস প্রভুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের ভিত্তিতে পরবর্তীতে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় নানা ধরনের রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। অনেকেই অভিযোগ করছেন যে, তাকে মূলত সংখ্যালঘুদের অধিকার আদায়ের জন্য শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে বাধা দেওয়ার জন্য এই মামলা করা হয়েছে। ২৫ অক্টোবরের সমাবেশে তিনি বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার কথা বলেছিলেন, যা সরকার বা সরকারের সমর্থকদের বিরোধীদের চোখে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
প্রতিবাদ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
চিন্ময় প্রভুর গ্রেফতারের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার হিন্দু প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন। তাঁদের দাবি, চিন্ময় প্রভুকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে, কারণ তিনি শুধু সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার জন্য আওয়াজ তুলেছিলেন। এই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং চিন্ময় প্রভুর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ভারত সরকারও এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে বলা হয়, “সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, অথচ শান্তিপূর্ণ সমাবেশে ন্যায্য দাবি তোলার জন্য একজন ধর্মীয় নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং অগ্রহণযোগ্য।” ভারতের তরফ থেকে এই বিষয়টি উত্থাপন করার পর, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও বাংলাদেশ সরকারের কাছে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার সুরক্ষার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি
বাংলাদেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের সংখ্যা প্রায় ৯১% এবং হিন্দুদের সংখ্যা ৮.৯৫%। অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যেমন বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, এবং আদিবাসী জনগণ, নিয়মিতভাবে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে ধর্মীয় সহিংসতা বাড়ছে, বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। মন্দির এবং উপাসনাস্থল ভাঙচুর, হিন্দুদের বাড়িতে আক্রমণ, এবং তাদের উপর শারীরিক নির্যাতন বেড়েছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস প্রভু এবং তাঁর সংগঠনগুলি সংখ্যালঘুদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করে আসছে। তার গ্রেফতারের মাধ্যমে এই আন্দোলনকে একটি বড় ধাক্কা দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছে অনেক মানবাধিকার কর্মী।
৮ দফা দাবি এবং সরকারের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতন জাগরণ জোট সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার জন্য ৮ দফা দাবি তুলেছে, যা বাংলাদেশ সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে। এই দাবিগুলির মধ্যে রয়েছে:
- সংখ্যালঘু নিপীড়নের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন।
- সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন।
- সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রক গঠন।
- হিন্দু ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টকে ফাউন্ডেশনে রূপান্তর করা।
- দেবোত্তর সম্পত্তি সংরক্ষণ ও আইন প্রণয়ন।
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘু প্রার্থনার স্থান নিশ্চিত করা।
- সংস্কৃত ও পালি শিক্ষার আধুনিকীকরণ।
- দুর্গাপূজা উৎসবে বিশেষ ছুটি বৃদ্ধি করা।
এই দাবিগুলির উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকার সুরক্ষিত করা, এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
সরকারের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত চিন্ময় প্রভুর গ্রেফতারের বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তবে, দেশটির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিছু সরকারি কর্মকর্তা, যেমন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, এই পরিস্থিতির পেছনে দেশের ভিতর-বাইরে কিছু রাজনৈতিক দলের ইন্ধন থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, “দেশের মধ্যে এবং বাইরের কয়েকটি দল দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।”
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উদ্বেগ বেড়ে চলেছে। আগামী দিনে যদি বাংলাদেশ সরকার সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস প্রভুর গ্রেফতারের ঘটনায় বাংলাদেশে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উত্তেজনা তীব্র হয়েছে। তার গ্রেফতারি শুধু এক ব্যক্তি বা ধর্মীয় নেতার বিরুদ্ধে মামলা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও অধিকার নিয়ে আরও বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি এটাই প্রমাণ করে যে, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং তাদের ধর্মীয় অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের কার্যকর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর চাপের মধ্যে, বাংলাদেশের সরকারকে অবশ্যই তার সংখ্যালঘু নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে এবং জনগণের অধিকার রক্ষায় দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।