বাংলাদেশের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মাদারীপুরের আড়াই শতাব্দী পুরোনো কুন্ডুবাড়ির কালীপূজা মেলার প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা এবং চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে হিন্দু সম্প্রদায়ের আট দফা দাবির প্রসঙ্গটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনায় স্থান পেয়েছে। এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অধিকার এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করার জন্য সরকারের প্রতিশ্রুতির প্রাসঙ্গিকতা পুনর্বিবেচনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার ভূরঘাটা এলাকায় প্রতিবছরই কালীপূজা উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলা শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসবই নয়, বরং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সামাজিক ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান প্রতীক। এবার স্থানীয় কিছু ইসলামিক নেতার আপত্তির কারণে এবং তাদের ৯টি অভিযোগের ভিত্তিতে মাদারীপুর জেলা প্রশাসন মেলাটি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা দেয়।
সংখ্যালঘুদের দাবিসমূহ এবং চট্টগ্রামের সমাবেশ:
২৫ অক্টোবর, শুক্রবার চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত সমাবেশে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সমবেত হন। তাদের প্রধান দাবিসমূহের মধ্যে ছিল সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন, এবং ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে উন্নীত করে “হিন্দু ফাউন্ডেশন” গঠন। সমাবেশে বক্তারা বলেন, প্রতিবারই তাদের বিরুদ্ধে হওয়া সহিংসতা, ভাঙচুরের ঘটনায় বিচার হয়নি, বরং প্রতিবারই এটি উপেক্ষা করা হয়। চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারী এই সমাবেশে বলেন, “যদি সরকার সংখ্যালঘুদের জন্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন না করে, তাহলে আমাদের অধিকার নিয়ে ভবিষ্যতে আরও সংকট তৈরি হবে।”
প্রাসঙ্গিক পরিসংখ্যান ও আর্থ-সামাজিক প্রভাব:
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রায় তিন হাজারের বেশি সহিংসতা ঘটেছে সংখ্যালঘুদের উপর। এই সকল ঘটনার সিংহভাগে কোনোটিই যথাযথ বিচার প্রক্রিয়ায় পৌঁছায়নি। ২০২১ সালে দুর্গাপূজা চলাকালীন কুমিল্লায় মন্দির ভাঙচুরের ঘটনাটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রকাশ পায়, যা থেকে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অবনতি নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় স্থানীয় সনাতন সম্প্রদায়ের সদস্যরা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে সংকোচ বোধ করেন। মানবাধিকার বিশ্লেষক সৈয়দ আজমল হোসেন বলেন, “প্রশাসনের এমন পদক্ষেপ সামাজিক শান্তি ও সহাবস্থানের পরিবেশকে ব্যাহত করতে পারে।”
আইনি ও সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি:
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, প্রতিটি নাগরিকের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা রয়েছে, কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাদের অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মাহমুদ হাসান বলেন, “যদি সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হয়, তবে এটি দেশের সংখ্যালঘুদের জন্য একটি বড় সুরক্ষা বেষ্টনী হিসেবে কাজ করবে।”
সমস্যার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট:
কুন্ডুবাড়ির মেলাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় রাজনৈতিক মহলেও মতভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একদিকে, প্রশাসনের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সামাজিক অসন্তোষ প্রশমিত করার প্রচেষ্টা চলছে, কিন্তু অন্যদিকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠী এই মেলার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ইজারাদারদের সম্পৃক্ততা নিয়ে আপত্তি তোলে। এই পরিস্থিতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতিকে আরও জোরালো করে।
সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতিক্রিয়া:
মাদারীপুরের কুন্ডুবাড়ি মেলা যেমন একটি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান, তেমনি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে সমাবেশ করে সংখ্যালঘুরা তাদের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার জন্য প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য, অরূপ রঞ্জন দে বলেন, “ধর্মীয় অধিকার এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত উৎসবগুলো বন্ধ করা দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।”
সাধারণ জনগণের মতামত ও প্রতিক্রিয়া:
সাধারণ মানুষ এই ধরনের ঘটনাকে দেশের সহিষ্ণু পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন। স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা মেলার মতো ঐতিহ্যবাহী আয়োজন বন্ধ হওয়াকে তাদের ধর্মীয় অধিকার হরণ বলে মনে করছেন এবং দাবি করেছেন, এমন ঘটনায় সরকারকে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্যদিকে, মুসলিম ধর্মাবলম্বী নেতারা বলছেন, তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে মেলা বন্ধ করা হয়েছে এবং এটি একটি স্বাভাবিক প্রশাসনিক পদক্ষেপ।
সার্বিকভাবে, মাদারীপুর ও চট্টগ্রামের এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের সামাজিক বন্ধন এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব পালনের গুরুত্বকে নতুন করে অনুভব করাচ্ছে।
কালীপূজার মেলা বন্ধের সিদ্ধান্ত এবং সংখ্যালঘুদের আট দফা দাবি নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিকে নাজুক অবস্থায় ফেলেছে। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষায় সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষায় কার্যকর আইন প্রণয়ন করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ধরনের ঘটনায় কেবল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, বরং দেশের সার্বিক শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
প্রথম আলো এবং বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন সূত্রে এই প্রতিবেদন তৈরী করা হয়েছে।