থেরবাদের বর্তমান উড্ডীত ধ্বজা উড্ডয়নের গিরি নদী সাগর কুন্তলা হরিৎ ভূমি চট্টলার যে ভূমিকা বাঙলা-ভারত উপমহাদেশে তা অগ্রগণ্যই বলাচলে। থেরবাদ রেঁনেসার ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে গ্রাম ঊনাইনপুরা অন্যতম। অগ্নিপুজারীদের ‘ঊনুুন’ মতান্তরে মগরাজা ‘ঊনাই’এর নামানুসারে গঠিত গ্রাম ঊনাইনপুরার কীর্তিধন্য সঙ্ঘপুরুষগণ সমাজ বিনির্মাণ, সদ্ধর্মের পুনরুত্থানের ক্ষেত্রে যে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন ও রেখে চলেছেন তা সর্বজনের প্রশংসার্হ। ঊনাইনপুরা গ্রামের যোগীমা বা যোগীখাইং বংশের জয়ধরা রাউলী (১৬০০ খ্রিস্টাব্দ) থেকে শুরু করে সর্বশেষ জিয়াসাং বংশের বোধিমিত্র স্থবির পর্যন্ত অন্ততঃ ১৬ জন কীর্তিমান সংঘপুরুষ আলোচ্য গ্রাম ঊনাইনপুরায় জন্মগ্রহণ করে এই গ্রামকে করেছেন ধন্য ও সমাদৃত (তন্মধ্যে দ্বিতীয় সংঘরাজ পূর্ণাচার ধর্মাধারী চন্দ্রমোহন মহাস্থবির ও দ্বাদশ সংঘরাজ ড.ধর্মসেন মহাস্থবিরর অন্যতম)। এছাড়াও বহু খ্যাতনামা গৃহী ব্যক্তিত্বগণের আবির্ভাবে এ গ্রাম হয়েছে আদরণীয়। কলেবর বৃদ্ধির ভয়ে তাঁদের নামোল্লেখ করতে পারছি না বলে দুঃখ প্রকাশ করছি এবং তাঁদের মহত্তর স্মৃতির প্রতি নিবেদন করছি হৃদয়ের বিনম্র নৈবেদ্য। খ্যাতকীর্তি গ্রাম ঊনাইনপুরায় যে সকল মহান সঙ্ঘপুরোধা জন্ম নিয়েছিলেন তন্মধ্যে বর্তমান নিবন্ধের প্রতিপাদ্য সুমহান সংঘপুরোধা হলেন ভারত বাংলা উপমহাদেশের থেরবাদ পুনরুজ্জীবনের অকুতোভয়, নিরলস, সব্যসাচী সঙ্ঘপুরোধা, বহু প্রতিষ্ঠানের জনক, মহান বিদ্যোৎসাহী, প্রভূত প্রতিভাধর, কর্মযোগী কৃপাশরণ মহাস্থবির মহোদয় অন্যতম। তমসাচ্ছন্ন এ জাতিকে উজ্জীবিত করতে ত্রি-মুকুটধারী মহাধম্মারাজাধিরাজ সংঘরাজ সারমেধ মহাস্থবির প্রমুখ পুণ্যাত্মাদের পর বিশেষ করে প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণ, বিদ্যাৎসাহীতা পূর্ববঙ্গ ছাড়িয়ে ভারত উপমহাদেশের সদ্ধর্ম রেঁনেসার অগ্রনায়ক শ্রদ্ধেয় কৃপাশরণ মহাস্থবিরের ভূমিকা সর্বাগ্রগণ্য।
আবির্ভাব :“দুল্লভো পুরসাজঞ্ঞো ন সো সব্বত্থ জাযতি
যত্থ সো জাযতি ধীরোতং কুলং সুখমেধতি।
ধর্মপদ- বুদ্ধবর্গ- ১৯৩
দুর্লভ পুরুষগণ যততত্র জন্ম গ্রহণ করেন না। যে দেশে, যে জাতিতে তাঁরা জন্ম নেন সেই দেশ-জাতি ধন্য হয় ।
ধর্মপদের উপরোক্ত অমিয় বাণীর মতই ছিলেন দুর্লভ পুরুষ কর্মযোগী কৃপাশরণ মহাস্থবির। ক্ষণজন্মা এ মহাপুরুষ সন্তান রূপে আনন্দ কুমার বড়ুয়ার ঔরসে ও আরাধনা দেবীর গর্ভে ১৮৬৫ সালের ২২ জুন, ১২৭১ বাংলার ৭ আষাঢ় মঙ্গলবার কীর্তিধন্য বৌদ্ধ বর্ধিষ্ণু জনপদ ঊনাইনপুরার আনক্খা ফুঙ্গী বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মে ধন্য হয়েছে গ্রাম ঊনাইনপুরা তথা বাংলা-ভারত উপমহাদেশ। সে দিনের সেই নবজাতক কৃপাশরণ পরবর্তীকালের কর্মযোগী কৃপাশরণ রূপে সৃজন করেছিলেন বৌদ্ধ সমাজ, সংস্কৃতি-কৃষ্টির এক উজ্জ্বল রেঁনেসা। পিতা আনন্দ কুমারের আর্থিক সংগতি ছিল সঙ্গিন। কিন্তু কবির ভাষায় ‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান’ এর মত কৃপাশরণ নিজের জীবনকে করেছিলেন প্রাতঃস্মরণীয়। দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতের সময় ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ সদৃৃৃৃশ পিতা আনন্দ কুমার বড়ুয়া শিশু কৃপাশরণের নয় বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মাতৃদেবী আরাধনা দেবী ‘অকুল পাথারে’ কুল খুঁজে নেন সংগতিসম্পন্ন এক আত্মীয়ের বাড়ীতে মাসিক ২ টাকা বেতনের কর্ম সংস্থানের মাধ্যমে। আর দুঃখ দৈন্যে কৃপাশরণ গুরুঠাকুরী পাঠশালায় শিক্ষা নিতে থাকেন।
প্রবজ্যা ও উপসম্পদা :
শতদৈন্যের মধ্যেও কৃপাশরণ ছিলেন নির্লিপ্ত, শ্রদ্ধাশীল ও নিষ্ঠাবান। পরবর্তীকালের তাঁর প্রতিভা থেকে ধারণা করা যায় তিনি গুরুঠাকুরী পাঠশালায়ও ছাত্র হিসেবে ছিলেন মেধাবী। ক্রমে তাঁর বয়স যখন ষোলতে গিয়ে উঠল তখন মাতৃদেবীর আগ্রহে ১৮৮১ সালের বৈশাখ তৎকালীন লঙ্কারাম অধিপতি শ্রদ্ধেয় সুধন চন্দ্র মহাস্থবিরের নিকট তিনি লাভ করেন মহামহিম প্রবজ্যা এবং মনোনিবেশ করেন ধর্ম শাস্ত্র চর্চায়। পরবর্তীতে ঊনাইনপুরাজাত আরেক খ্যাতনামা সংঘপুরোধা সিংহলের রামাঞ্ঞা নিকায় প্রতিষ্ঠাতা সংঘরাজ আচারিয়া পূর্ণাচার চন্দ্রমোহন মহাস্থবিরের নিকট ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের ৭ই নভেম্বর, ১২৯১ বঙ্গাব্দের ২৩ কার্তিক শুক্রবার ২০ বছর বয়সে তিনি লাভ করেন পবিত্র উপসম্পদা(বি:দ্র: এখানে উপসম্পদার ইংরেজী তারিখ ও মাস এবং বাংলা বৎসর এবং বারটি ইন্টারনেটের সাহায্যে উদ্ঘাটিত)। তাঁর নামকরণ করা হয় চন্দ্রজ্যোতি ভিক্ষু। কিন্তু তিনি পিতৃদত্ত নামেই খ্যাত হয়ে রইলেন।
প্রতিভার হীরক দ্যুতি :
নব উপসম্পন্ন ভিক্ষু কৃপাশরণ গুরুর পদপ্রান্তে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সহিত শিক্ষায় অভিনিবিষ্ট হন। এর মধ্যে প্রায়সময় গুরুর সাথে বের হন তীর্থ ভ্রমণে, ভ্রমণ কালে বুদ্ধ গয়ায় পৌঁছে বুদ্ধগয়ার জরাজীর্ণ অবস্থা অবলোকন করে ভারতে লুপ্তপ্রায় বুদ্ধের মহিমা কীর্তনের দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন। তৎপর গুরুর নির্দেশে তিনি পটিয়ার বাক্খালি বিহারে এক বর্ষাবাস কাটান। এর মধ্যে ছিন্ন হল তাঁর নাড়ীর বন্ধন, দেহত্যাগ করলেন স্বর্গাদর্পি জননী আরাধনা দেবী।
১৮৮৫ সালে বাংলা ১২৯২ বাংলার জ্যৈষ্ঠ মাসে তিনি চলে গেলেন কলকাতার বহু বাজার অঞ্চলের ৭২/৭৩ নং মলদা লেনস্থ বিহারে। তথায় পাঁচ বছর অবস্থান করে সুপ-িত মহাবীর মহাস্থবিরের নিকট শিক্ষা নেন ধর্ম বিনয়। ১২৯৭ বাংলায় বিহারটি সরকার অধিগ্রহণ করলে শিক্ষানবীশ ভিক্ষু কৃপাশরণ ১৬ নং বউ স্ট্রীটে রাণী স্বর্ণময়ীর প্রদত্ত এক কাঠা চার ছটাক জমির উপর প্রতিষ্ঠিত মহানগর বিহারে ১৩ বছর অতিবাহিত করেন। তথায় অবস্থানকালে ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দ, ১২৯৮ বাংলার আশ্বিনী পূর্ণিমায় ধর্র্মচক্র প্রবর্তন সূত্র পাঠান্তে গুণী ভিক্ষুসংঘ বিদ্বৎ সমাজের সমন্বয় করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা। সভার স্থায়ী সভাপতি হলেন তিনি নিজে। সুরেন্দ্র লাল মুৎসুদ্দি সম্পাদক ও গোপাল সিংহ চৌধুরী সহযোগী সম্পাদক নির্বাচিত হন। কর্মযোগী কৃপাশরণ যেই বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভার মাধ্যমে ভারতে ধর্ম উজ্জ্বীবনের যে অঙ্কুর বপন করেছিলেন তা আজ মহীরুহ রূপ ধারণ করে আজও ছায়া বিলিয়ে যাচ্ছে সর্বত্র।
উক্ত ধর্মাঙ্কুর সভা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই তাঁর লালিত স্বপ্ন ও সাধ পূরণের শুভ সূচনা হয়। এটিকে কেন্দ্র করে কলকাতা, চট্টগ্রাম নোয়াখালী, ত্রিপুরা, আসাম, দার্জিলিং, শিলং, লক্ষ্নৌ ও ভূটান প্রভৃতি অঞ্চলে বৌদ্ধ নব জাগরণের ছোঁয়া লাগে।
১৩০৭ বাংলায় কর্মযোগী কৃপাশরণ কলিকাতায় বহুবাজারে অ লে ৫ নং ললিত মোহনদাস লেনে ৫৫০০ টাকা মূল্যের ৫ কাঠার মত জমি নিজ নামে ত্রুয় করেন। জ্ঞানরতœ, কবিধ্বজ গুণালঙ্কার মহাস্থবিরকে সহকর্মীরূপে লাভ করে খরিদকৃত স্থানে বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কু বিহার নির্মাণ করেন। ১৯১৬ সালে তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিহারের সম্মুখস্থ রাস্তাটি বুড্ডিষ্ট টেম্পল স্ট্রীট নামে নামকরণ করা হয়। ১৩১১ বাংলায় ১৮ আষাঢ় বিহারটির উদ্বোধন হয় ও বর্ষাবাস ব্রত আরম্ভ হয়। আর ধর্মাঙ্কুর সভায় কার্যালয় এখানে স্থানান্তরিত হয়।
এ সময় চট্টগ্রামের ছতরপিটুয়া গ্রামের এক শিক্ষিত তরুণ তাঁর নিকট শিষ্যত্ব গ্রহণ করে পূর্ণানন্দ স্বামী নাম ধারণ করে সিংহলে (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) গমনন্তর ত্রিপিটক শিক্ষা করে কলকাতায় প্রত্যাবর্তনান্তে কৃপাশরণের উদ্যোগে মহাস্থবির গুণালঙ্কারের সাথে যুগ্ম সম্পাদনায় “জগৎজ্যোতি” পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন।
১৯০৫ সালে প্রিন্স অব ওয়েলস (পরবর্তীতে ভারত সম্রাট ৫ম জর্জ) ভারত ভ্রমণে আসলে কৃপাশরণ ও গুণালঙ্কার মহাস্থবির বাংলার গভর্ণরের আমন্ত্রণে আশির্বাদ দানের জন্যে রাজদরবারে গমন করেন। ১৯১১ সালে ভারত সম্রাট পঞ্চম জর্জের দিল্লীতে অভিষেক উপলক্ষে ও এ দু’মহাত্মন আমন্ত্রিত হয়ে সম্রাটকে বৌদ্ধ রীতিতে আর্শিবাদ প্রদান করেন। ১৯০৯-১০ কর্মযোগী কৃপাশরণ ব্রহ্মদশে (বর্তমান মিয়ানমার) ও সিংহলে গমন করে ত্রিপিটক গ্রন্থাদি ও বুদ্ধমূর্তি সংগ্রহ করে আনেন। আরাকানে ভ্রমণ করে তিনি সাড়ে ৫ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন বুদ্ধমূর্তি ও সীমা স্থাপনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। এ সময় শাস্ত্রজ্ঞ ভিক্ষু-পরিব্রাজক কালিকুমার তাঁর সহকর্মীরূপে দায়িত্ব নেন।
কর্মযোগী কৃপাশরণ শিমলা, দিল্লী, রাঁচী, লক্ষ্মৌ, জামশেদপুর, দার্জিলিং, শিলং, ডিব্রুগড়, কুমিল্লা, ত্রিপুরা, রাঙ্গামাটি ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ধর্মাঙ্কুরের শাখা স্থাপন করেন ধর্মের অঙ্কুর দিক্ দিগন্তে ছড়িয়ে দেবার সম্যক প্রত্যয়ে। তিনি ভক্তদের সহায়তার লক্ষ্যে শহরে ১০ কাঠা জমির উপর বোধিসত্ত্ব বিহার নির্মাণ পূর্বক শ্রীমৎ বোধানন্দ স্বামী ( যিনি পূর্বে ছিলেন শিবানন্দ সন্ন্যাসী, পরে কৃপাশরণের শিষ্য ) কে সেখানে অধ্যক্ষ হিসাবে পদস্থ করেন। দার্জিলিং এ স্থানীয় ভক্তদের সহায়তায় ৩ বিঘা ৭ কাঠা জমির উপর ধর্মশালা ও বিহার নির্মাণ পূর্বক সেখানে অন্যতম শিষ্য শ্রীমৎ আনন্দ স্বামীকে অধ্যক্ষ করেন। তাঁরই উদ্যোগে দার্জিলিং-এ বর্ধমান মহারাজ বিজয় চাঁদ মহাতাব ৩ বিঘা ৫ কাঠা জমি দান করেন যাতে প্রতিষ্ঠিত করেন “গন্ধমাদন বিহার”। তিনি শিলং, জামশেদপুর ও বলরামপুরে বিহার নির্মাণার্থে ক্রমান্বয়ে একবিঘা এক কাঠা ও তিন বিঘা জমি সংগ্রহ করেন। চট্টগ্রাম শহরের বুদ্ধ মন্দিরের পাশে একটি অতিথিশালা ও স্ব-গ্রামের ঊনাইনপুরা লঙ্কারামকে পাকা করে দেন। ১৯১৬ সালে কৃপাশরণ ভন্তের প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা তক্ষশিলায় প্রদত্ত বুদ্ধাস্থি পাবার জন্য ভারত সরকারের নিকট আবেদন করলে সরকারের শর্ত সাপেক্ষে রাণী স্বর্ণময়ীর প্রদত্ত জমি ও ধর্মাঙ্কুর সভার ক্রয়কৃত জমিতে ধাতু মন্দির নির্মাণ কল্পে তিনি প্রভূত পরিশ্রম স্বীকার করেন। এরপর কর্মযোগী মহোদয় আরাকানবাসী বৌদ্ধদের প্রদত্ত শ্বেত প্রস্তরের ভিক্ষুসীমা প্রতিষ্ঠা, ধাতু মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন ও তৎ নির্মিত বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর বিহার ও শাখা বিহার সমুহ উৎসর্গ করেন। এ উপলক্ষে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর হতে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিহার ধর্মাঙ্কুুরে এক আর্ন্তজাতিক সম্মেলন আহ্বান করেন। সেই ঐতিহাসিক সম্মেলনে খ্যাতনামা অনেক প্রাজ্ঞ, ধীমান ও যশস্বী ভিক্ষুগণ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে সমাজের অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়। স্মর্তব্য যে, মহাস্থবির কৃপাশরণ যখন লক্ষ্মৌর বোধিসত্ত্ব নির্মাণ করতেছেন তৎসময়ে ভারতে বুদ্ধের পবিত্র স্মৃতিধন্য চারি মহাতীর্থের সঠিক দিক নিয়ে বিভ্রান্তি চলছিল, তখন তিনি তাঁর শিক্ষাগুরু মহাবীর মহাস্থবিরকে নিয়ে বুদ্ধের পরিনির্বাণ স্থান কুশীনগরে আবিষ্কার করেন। ১৩০৮ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে বলরামপুর সন্নিকটস্থ সাহেট মাহেট নামক স্থানে অনাথপিন্ডদারাম আবিষ্কার করেন যা সমগ্র বৌদ্ধ ইতিহাসে ও ভারতের প্রত্নতত্ত্ববিভাগের অমূল্য সম্পদ এবং অনবদ্যকর্ম।
শিক্ষা বিস্তারে কৃপাশরণ :
Education is the Backbone of a Nation” উক্তিটির যথার্থতা উপলব্ধি করে মহাস্থবির কৃপাশরণ শিক্ষার প্রসারে যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন। শিক্ষার প্রচার ও প্রসারকল্পে তিনি ১৯১৩ সালের ১৫ নভেম্বর ধর্মাঙ্কুর সভার অধীনে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের কৃপাশরণ ফ্রি ইনিষ্টিটিউট নামে উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৯১৬ সালের ১৬ জানুয়ারী নৈশ বিদ্যালয়, ১৯১০ সালে গুণালংকার মহাস্থবিরের ত্রিপিটক গ্রন্থ সহ বিবিধ গ্রন্থ নিয়ে গুণালঙ্কার লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন এবং এ লাইব্রেরী হতে বিভিন্ন পুস্তিকা প্রকাশ ও প্রচারের ব্যবস্থা করেন। ইউরোপ, আমেরিকায় বড়ুয়া শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার নিমিত্তে কৃপাশরণ মহাস্থবির ১৯১৩ সালে গভর্ণর জেনারেল তথা ভাইসরয়ের নিকট আবেদন করেন। ফলতঃ বাংলার বাঘ খ্যাত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জীর সহায়তায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি বিভাগ খোলা হয় এবং এ কারণেই মহিম রঞ্জন বড়ূয়া, রেবতী রমন বড়ুয়া ও বেণীমাধব বড়ুয়া কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। তৎমধ্যে বেণীমাধব বড়ুয়া কর্মযোগীর সহায়তায় ১৯১৭ সালে এশিয়ার বাঙ্গালীদের মধ্যে সর্ব প্রথম ডি. লিট. (ডক্টর অব লিটারেচর) ডিগ্রী প্রাপ্ত হয়ে এশিয়াবাসীর মুখোজ্জ্বল করেন। মহাস্থবির মহোদয় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থেকে সভাপতি ও সম্মানিত সদস্য পদে আসীন হয়ে সমাজের হিত সাধন করেছেন।
যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলো তাঁর সর্বাঙ্গীন সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা ও মঞ্জুরী প্রাপ্ত হয়েছেন তন্মধ্যে ১) মহামুনি এ্যাংলো পালি কলেজ। ২) রাউজান আর্যমৈত্রেয় ইনিষ্টিটিউট। ৩) শাকপুরা উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়। ৪) আবুলখীল অমিতাভ হাই স্কুল। ৫) নয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়। ৬) রাঙ্গনীয়া উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়। ৭) পটিয়া এস. এ রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়। ৮) ফটিকছড়ি হাই স্কুল। ৯) রাঙ্গামাটি স্কুল ও লাইব্রেরী। ১০) ঊনাইনপুরা প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১১) শিলক নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
উল্লেখ্য যে, রাঙ্গুনিয়ায় একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি স্যার আশুতোষ নিকট গেলে আশুতোষের এক সহচর একটি বিব্রতকর মন্তব্য করেন। প্রত্যুত্তরে স্যার মুখার্জী বলেন “এই একমাত্র মানুষ যিনি নিজের স্বার্থের জন্য কখনো আমার কাছে আসেন না, শুধু পরের জন্য জাতি-বিজাতির জন্য আমার কাছে আসেন এজন্য আমাকে বার বার তাঁর কথা শুনতে হয়।” কর্মযোগী কৃপাশরণ মহাস্থবিরেরই আগ্রহাতিশায্য ও উদ্যোগ, স্যার আশুতোষের সাহায্যে ১৯১২ সালে বর্তমান মহাত্মা গান্ধী রোডে সর্বপ্রথম কলকাতায় বৌদ্ধ ছাত্রাবাসের ব্যবস্থা হয় যা বৌদ্ধদের শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখে এবং যেটির প্রথম সুপারিনটেন্ডেন্ট বা তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হন পূর্ণানন্দ স্বামী।
কর্মযোগী কৃপাশরণ শুধুু পুরুষ শিক্ষার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন নি, তিনি নারী শিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রভূত অবদান রাখেন। মহিলাদের জ্ঞানার্জন ও শিল্প শিক্ষা লাভের নিমিত্তে তিনি ১৯১৩ সালে ধর্মাঙ্কুুরে প্রথম ও ১৯১৮ সালের ২০ জানুয়ারী কলকাতা বেথুন কলেজের অধ্যক্ষ মিস্ এস.এল জেনুর সভাপতিত্বে দ্বিতীয় মহিলা সম্মেলন করান। যার মাধ্যমে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে রক্ষণশীলতা অনেকাংশে বিদূরিত হয়ে অনেকে শিক্ষার আলো লাভ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় নারীরাও বিভিন্ন সমাজ সংগঠনমূলক কর্মে অংশ নিয়ে নিজেদের প্রতিভার বিকাশ ঘটান ও সমাজের হিত সাধন করেন।
বিদ্বসঙ্গ :
মহাস্থবির কৃপাশরণ তাঁর বিভিন্ন কর্মকান্ডে বহু বিজ্ঞ জনের সাহচর্য ও সহায়তায় লাভ করেছেন স্বীয় প্রজ্ঞা, কর্মকুশলতা ও অসীম বুদ্ধিমত্তায়। তন্মধ্যে যাঁরা সবিশেষ উল্লেখ্য তাঁরা হলেন সম্রাট পঞ্চম জর্জ (জর্জ ফ্রেডরিক আর্নেস্ট অ্যালবার্ট), স্যার আশুতোষ মুখার্জী, বগুড়ার নবাব আবদুল ছোবান চৌধুরী, মনীষী হরিনাথ দে, শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাননীয় বেডস লর্ড কারমাইকেল, স্বরাষ্ট্র সচিব বাটলার, গভর্ণর লর্ড রোনাল্ডসে, ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকার সম্পাদক নরেন্দ্র নাথ সেন, অধ্যক্ষ মহামহোপধ্যায় সতীশচন্দ্র বিদ্যাবিনোদ, বিচারপতি সারদাচারণ মিত্র, জাতক অনুবাদক ঈশানচন্দ্র ঘোষ, মহারাজা মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী, মহারাজ বিজয় চাঁদ মাহতাব, যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত (জে. এম. সেন- যাঁর নামে চট্টগ্রাম শহরে বর্তমান জে.এম.সেন হল), গগেন্দ্র লাল চৌধুরী, উপেন্দ্র লাল চৌধুরী, বৌদ্ধ বন্ধু পত্রিকায় সম্পাদক জয়দত্ত চৌধুরী, তদানীন্তন বাংলা শিক্ষা বিভাগের ডিরেষ্টর ডব্লিউ সি ওয়ার্ল্ডওয়ার্থ, চাক্মা রাজা ভুবন মোহন রায়, রমণী মোহন রায়, ডাঃ সতীশ চন্দ্র বিদ্যাভূষণ, চারুচন্দ্র বসুু, বিপিন স্যানাল, সুরেন্দ্র লাল মুুৎসুদ্দী ,ভূপেন্দ্রশ্রী ঘোষ, অনাগারিক ধর্মপাল, মি. হেবাবিতারন, হরিশচন্দ্র ব্রহ্মচারী, তিনকড়ি মুখোপধ্যায়, রায় বাহাদুর চুনিলার বসু প্রমুখ।
মহাপ্রস্থান :
“সব্বে সংখার অনিচ্চ’তি” সকল সংস্কার বা উপাদান অনিত্য- তথাগতের এই অমোঘ বাণী অনন্য কর্মযোগী বৌদ্ধ রেঁনেসার অগ্রদূত মহামহিম কৃপাশরণও তার ব্যতিক্রম নন। তিনি নিজে শারীরিক স্বাচ্ছ্যন্দের প্রতি উদাসীন ছিলেন। একদা চট্টগ্রাম হতে শ্রদ্ধাদান সংগ্রহ করে কলকাতায় ফেরার কালে নিজের বোঝা নিজে কাঁধে নিচ্ছেন দেখে এক ভক্ত তাঁকে একটি টাকা দিয়ে বললেন “ভন্তে” ঘোড়ার গাড়ী করে ষ্টেশনে যান। ভন্তে বললেন ইহার বিনিময়ে ৮/১০ খানা ইট পাব। এই বলে তিনি পদব্রজে যাত্রা করেন। উল্লেখ্য, তিনি ব্রহ্মের (মায়ানমারের) তৎকালীন সংঘরাজ উ. সাগর মহাস্থবিরের আমন্ত্রণে বিপুল সংবর্ধনা পান তথায় গিয়ে। তৎপর শ্রীলঙ্কার অনাগারিক ধর্মপালের আমন্ত্রণে শ্রীলঙ্কায় গিয়েও বিপুল সংবর্ধনা লাভ করেন। শ্রীলংকা যাবার প্রাক্কালে তাঁর ভক্তরা তাঁকে স্টীমারের প্রথম শ্রেণীর টিকেট কিনতে বললে তিনি বলেন, “লোকে আমাকে যে অর্থ দেয় তা আমার স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য নয়, ধর্ম ও সমাজের মঙ্গলের জন্য। এভাবে নিজের শরীরের প্রতি উদাসীনতার দরুণ তিনি অত্যন্ত ভগ্ন স্বাস্থ্য হয়ে পড়েন। নিজের স্বাস্থ্যের অবস্থা উপলব্ধি করে তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র তরণীসেন বড়ুয়াকে পত্রযোগে ডেকে আনেন এবং তাকে বলেন, “বাবা, আমার ডাক পড়িয়াছে, আমি চলিলাম. তবে আমার মৃতদেহখানি জন্মভূমির শীতল ক্রোড়ে আমার গুরুদেবের চিতাশয্যার পদপ্রান্তে পোড়াইও। ইহাই তোমাকে বলিয়া গেলাম।” এবং ওইদিন সন্ধ্যায়, ১৯২৬ সালের ৩০ এপ্রিল ১৩৩৩ বাংলা ১৭ বৈশাখ শুক্রবার ৬১ বছর বয়সে এ মহান কর্মযোগীর জীবনবসান হয়। তিনি মহাপ্রয়াণ করলেও তাঁর সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁর স্মৃতি বহন করে চলছে ও চলবে সুদীর্ঘকাল। আর এ কারণেই বোধ হয় কবি বলেছেন,
“তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ
তাই তব জীবনের রথ
পশ্চাৎ এ ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার।”
কবির উপরোক্ত বাণীর সাথে সুর মিলিয়েই হয়তো কলিকাতা ধর্ম্মাঙ্কুর বিহারে কর্মযোগী কৃপাশরণের মর্মর মূর্তির নিচে খোদিত হয়েছে,
“সত্য বটে নহ তুমি রাজা মহারাজ,
নহ তুমি লক্ষপতি অথবা পণ্ডিত,
তবুও তোমার অই মহত্ত্বের কাছে
রাজচক্রবর্তী কিংবা মনীষী গৌরব
হয় খর্ব প্রতিদিন হে ভিক্ষু প্রবর!
লয়ে ভিক্ষাপাত্র করে, অঙ্গে চীরবাস
দেশ দেশান্তর তুমি করি পর্যটন
তিল তিল উপাদান করি আহরণ
স্থাপিলে অক্ষয় কীর্তি পিরামিড সম
এ মহানগর মাঝে যুগ যুগান্তর
ঘোষিতে ত্রিরত্নের জয়!
আড়ম্বরহীন
সারল্যের প্রতিমূর্তি তুমি ধর্মপ্রাণ
ইহাকেই বলে দেব প্রকৃত নির্বাণ।”
ত্যাগী পুরুষ বীর্যশালী এ মহান কর্মযোগীর জীবনী সংক্ষেপে রচনা করা আমি অধমের পক্ষে ধৃষ্টতার শামিল। এ নিবন্ধে তাঁর জীবনের চুম্বক অংশের বৃত্তান্ত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ক্ষমা ভিক্ষা ও আশীষ প্রার্থনা করি এ মহৎ এর পদতলে। তাঁর সান্নিধ্য প্রাপ্ত বিদ্বজনের ভাষায় তাই বলি “তার ধন ছিলনা, বিদ্যা ছিল না, শক্তি ছিল না, ছিল শুধু কর্মের সাধনা, ছিল নির্ভেজাল বৈরাগ্য ও চরম ত্যাগ তিতিক্ষা; তাই করি ত্যাগের পূজা, মহত্ত্বের পূজা এজন্যেই তিনি আদরের পাত্র ভক্তি ও শ্রদ্ধার পাত্র”।
নিপুন বড়ুয়া চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী থানার অন্তর্গত বঙ্গীয় বৌদ্ধদের খ্যতিসম্পন্ন ও সুপরিচিত শীলকূপ গ্রামের জন্মজাত সন্তান। নিপুন বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে PhD Degree অর্জনের জন্য গবেষণায় নিয়োজিত আছেন। অদ্যাবধি তাঁর বহু প্রবন্ধ ও গ্রন্থ পাঠক মহলে ব্যাপক নন্দিত হয়েছে।