১৯ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে বিবিসি বাংলা-সহ বিভিন্ন বৈধ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে এক যুবককে গণপিটুনির মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তি স্থানীয় একজন শ্রমিক দীপু চন্দ্র দাস ছিলেন, যিনি একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন।- BBC Bangla
ঘটনার সময় স্থানীয়দের মুসলিমদের অভিযোগ ছিল তিনি ইসলাম বা নবীকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন, যার ভিত্তি এখনও স্বচ্ছভাবে প্রমাণিত হয়নি। স্যোসাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পরা ভিডিওতে দেখা যায় শত শত ইসলামী জনতা একজনকে হত্যা করে এবং মৃতদেহ গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখে আগুন ধরিয়ে “নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবার” ধ্বনি দিয়ে প্রকাশ্যে উল্লাস করছে।
ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ ও বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন
১৩ বছরের রক্তাক্ত গুজব–ইতিহাস: রামু ২০১২ থেকে ময়মনসিংহ ২০২৫
বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়—এটি একটি দীর্ঘদিনের কাঠামোগত সংকট।
গত দেড় দশকে বারবার দেখা গেছে, ইসলাম অবমাননার অভিযোগ—যার বড় অংশই পরবর্তীতে ভিত্তিহীন, সাজানো বা গুজবপ্রসূত বলে প্রমাণিত—সেগুলোকেই অজুহাত করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নেমে এসেছে ভয়াবহ সহিংসতা। প্রাণহানি, ঘরবাড়ি ও উপাসনালয়ে অগ্নিসংযোগ, ধর্মীয় স্থাপনা ধ্বংস, লুটপাট এবং গণউচ্ছেদের মতো ঘটনাগুলো আজ একটি ধারাবাহিক ইতিহাসে পরিণত হয়েছে।
রামু ২০১২: একটি ফেসবুক পোস্টে জ্বলে উঠেছিল পুরো জনপদ
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১২—বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক ইতিহাসে এক কালো দিন। কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলা, উখিয়া, টেকনাফ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় একযোগে হামলা চালানো হয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর। অভিযোগ ছিল—একজন বৌদ্ধ যুবক ফেসবুকে কোরআন অবমাননা করেছেন। তার পরের দিন চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায় একই অভিযোগের সূত্রধরে হামলা, ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয় একাধিক বৌদ্ধ বিহারে।
পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় তদন্তেই প্রমাণিত হয়, পোস্টটি ভুয়া ছিল। যা পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছিল, এবং উদ্দেশ্য ছিল সংঘবদ্ধ সহিংসতা উসকে দিয়ে বৌদ্ধদের উপর হামলা করা।
২০১২ সালের এই ইসলাম অবমাননার গুজবে রামুসহ চট্টগ্রামের ১২টির বেশি বৌদ্ধ বিহার ও মন্দির আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। শতাধিক বৌদ্ধদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট, বহু প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি, পুঁথি ও ধর্মীয় নিদর্শন ধ্বংস হয়।
রামু ঘটনা ছিল একটি টার্নিং পয়েন্ট—যেখানে স্পষ্ট হয়, ইসলাম অবমাননার গুজব বাংলাদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর গণহিংসার সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার।
রামুর পরেও থামেনি সহিংসতা, রামুর পরবর্তী বছরগুলোতে একই ছকে একের পর এক ঘটনা ঘটেছে—
▣ নাসিরনগর (২০১৬)
একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়। মন্দির ভাঙচুর, বাড়িঘরে আগুন, লুটপাট—সবকিছুই ঘটেছিল অপ্রমাণিত অভিযোগের ভিত্তিতে।
▣ শাল্লা, সুনামগঞ্জ (২০২১)
ফেসবুকে কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে শতাধিক হিন্দু বাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হয়। পরবর্তীতে দেখা যায়—পোস্টের সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তির সরাসরি সংশ্লিষ্টতা প্রশ্নবিদ্ধ।
▣ কুমিল্লা (২০২১)
দুর্গাপূজার সময় কোরআন শরিফ অবমাননার অভিযোগ ছড়িয়ে পড়ে। এর জেরে দেশের বিভিন্ন জেলায় মন্দিরে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর ও প্রাণহানি ঘটে।
প্রতিবারই দৃশ্যপট প্রায় একই— ইসলাম অবমাননার গুজব।
সর্বশেষ ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ময়মনসিংহ: গুজবের শেষ পরিণতি—গণপিটুনিতে একজনকে হত্যা ও মৃতদেহ প্রকাশ্যে গাছে ঝুলিয়ে আগুন দিয়ে “নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবার” ধ্বনি দিয়ে উল্লাস।
ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে এক যুবককে প্রকাশ্যে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। অভিযোগের সত্যতা তখনো যাচাই হয়নি। কোনো আদালত, কোনো তদন্ত—কিছুই হয়নি। বর্বর, হিংস্র ইসলামী জনতার রায়ই হয়ে উঠেছে চূড়ান্ত।
এই ঘটনা বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কয়েকটি গুরুতর বাস্তবতা সামনে এনেছে, তা হচ্ছে -৫ই আগস্ট ২০২৪ ইইনুস অবৈধ সরকারে সময়ে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ এখন মব জাস্টিসের লাইসেন্সে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু পরিচয় থাকলে তার জীবন ঝুঁকি আরও বহুগুণে বেড়ে যাচ্ছে। আইনি প্রক্রিয়ার বদলে হিংস্র, বর্বর, ইসলামী জনতাই বিচারক হয়ে উঠছে।
ময়মনসিংহের ঘটনা প্রমাণ করে, রামুর ১৩ বছর পরেও রাষ্ট্র ও সমাজ এই সংকট থেকে বের হতে পারেনি।
ইসলাম অবমাননার অভিযোগ বাংলাদেশে এখন একটি সামাজিক অস্ত্র— যার মাধ্যমে সংখ্যালগু, বৌদ্ধ, হিন্দুদের ভূমি দখল, ব্যক্তিগত শত্রুতা, রাজনৈতিক ফায়দা বা সাম্প্রদায়িক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা সহজ হয়।
রামু ২০১২ থেকে ময়মনসিংহ ২০২৫—এই ১৫ বছরে বারবার সুযোগ এসেছিল শিক্ষা নেওয়ার। কিন্তু রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনৈতিক শক্তিগুলো সম্মিলিতভাবে সেই শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
রাষ্ট্রের প্রয়োজন বাংলাদেশর সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুজবের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা, দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত, দৃষ্টান্তমূলক বিচার, ধর্মীয় উপাসনালয় ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর স্থায়ী নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলা। কিন্তু রাষ্ট্র বা সরকার এইসব কোনটাই উদ্যোগ গ্রহণ করাতে বার বার একই সংখ্যালঘু হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটের ইতিহাস ফিরে আসে— আর প্রতিবারই নতুন কোনো রামু, নতুন কোনো ময়মনসিংহ তৈরি হয়।

প্রকাশক ও সম্পাদক, ধম্মইনফো-ডট-কম
