শিরোনাম দেখলেই বোঝা যাবে এ যেন সব মেয়েদের প্রতিনিধি হয়ে এক ধরণের আত্মকথন। সে সময়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি সেসময়ে নিজের কাছেই যেন নিজের প্রশ্ন, হ্যাঁ, আমরা মেয়েরা কেমন আছি? প্রশ্নের মধ্যেই উত্তরটা সুপ্ত রয়েছে, না, আমরা বাল নেই। ভালো না থাকার নানান উপাদান যে আমার পাশে ছড়ানো। অসুস্থ পৃথিবীর বুকে বেচে থাকটাই যেন চূড়ান্ত এক প্রহসন। এই প্রহসনের যূপকাষ্ঠে প্রতিদিনই আমরা একটু একটু করে ক্ষয় করছি নিজেকে। শুধু কোনো একটি মেয়ের জীবনেই এমনটি ঘটছে তা নয়, সব মেয়ের জীবনেই আজ একই ছবি। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা যেন প্রতিদিনকারই ছবি। সেখানে কে হিন্দু, কে বৌদ্ধ, কে জৈন, কে শিখ,মুসলমান তার বিচার নয়। আসলে যারা নির্যাতিতা, ধর্ষিতা, তার সকলেই নারী। সেই কেবল লাঞ্ছিতা হতে পারে। আসলে এরকম করে যদি ব্যাপারটা ধরা যায় এ কেবলমাত্র নারীর অবমাননা নয়, সমস্তরকমের মানবিতার অপমান। তাহলে যেন বিষয়টা গুরুত্ব আরও বেশী প্রকট হয় অবশ্যই এটি মানবিক প্রশ্ন। সভ্যতার গুরুত্বে পরিবেশ ও পরিস্থিতি এমনটা ছিল না, পরিস্থিতিটা ছিল অনেক বেশী সহজ ও সরল্ সর্ম্পটি ছিল মহমর্মিতার। সময যতো এগাতে থাকলো পরিস্থিতিটা গেল বদলে। বেদ ও পরবর্তী পর্বে যেসমস্ত সহিত্যিক নিদর্শন পাওয়া গেলো তার প্রায় প্রতিটিতেই নারীর অবস্থান ছিল যথেষ্ট গৌরবের। তারা সাহিত্যচর্চা করছেন, কখনো বিদ্যাশিক্ষা করছেন অর্থাৎ নারীর অবস্থান যথেষ্ট সম্মানজনক। কিন্তু ক্রমে আমরা এমন এক সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছিলাম যখন social psyche (সোসাল সাইকি) ও taboo (নিষেধাজ্ঞা) এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম আমরা যখন দৃষ্টিভঙ্গী হলো সঙ্কুচিত ও কুণ্ঠিত।
পরিবেশটা গেল আয়ত্তের বাইরে। এমন এক সংস্কৃতি আমাদের মানসিকতায় আঘাত করলো যার প্রভাবটা আমরা কোনোভাবেই এড়াতে পারলাম না। মেয়েদের ওপর কর্তৃত্ব গেল বেড়ে। অভিভাবকের সংখ্যা বাড়লো। প্রথমে নারীর বিদ্যাশিক্ষার অধিকার কেড়ে নেওয়া হলো, বলা হলো, মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে স্বামী মারা যাবে। এরকম ফতোয়ার মাঝখানে পড়ে নারী রইল নিরস্ত্র। সত্যিই তো পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সে প্রতিবাদ জানাবে কার বিরুদ্ধে? ফলে বিনা প্রতিবাদে এ অন্যায় বৈষম্যকে মেনে নেওয়া ছাড়া সে আর কি করতে পারে? কৌলীন্র তো তার জীবনে মূর্তিমান অভিশাপ। আট বছর বয়সে বিবাহ, তার জীবন বেড়ে ওঠার সময়ই কুঠারঘাত। এভাবেই পঙ্গু করা হলো আমাদের মন, মেজাজ ও মানসিকতাকে। ক্রমে ক্রমে এভাবেই আমরা এসব অন্যায়, অসাম্যকে মেনে নিতে থাকলাম। প্রতিবাদের স্বটাকে করা হলো রুদ্ধ। এসময থেকেই কণ্ঠরোধ করার প্রবণতাটিও তীব্র হলো। নারীর প্রতিবাদী ভাষা ক্রমণ হারাতে থকলো। আপোষ ও সহানুভূতি কিভাবে যেন তার ভাগ্যহত জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেলো। বাইরের জীবন হারিয়ে গিয়ে অন্তঃপুরের জীবন বড়ো বেশী তার কাছে এলা। এটা ক্রমশঃ হয়ে উঠলো তার বন্দীজীবনের অনুরূপ। তার নিজেকে মেলে ধরার ক্ষেটা সীমাবদ্ধ হলো। রোকেয়া, আশাপূর্ণার লেখনী যেন এদের কথা বলে উঠলো। পাঠক এ পরিস্থিতির প্রতি সহানুভূতি দেকালেও কখনোই এ পরিস্থিতি থেকে নারীকে উদ্ধারের জন্য সচেষ্ট হননি। প্রশ্ন তাহলে উঠতে বাধ্য নারী কি কেবলই সহানুভূতি দেখাবার জন্য তার অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রাকার চেস্টা করবে? নারীর এই পরিস্থিতিরি থেকে উদ্ধারের পথটাকে কে স্ধান করবে? আসলে এই অবস্থান থেকে উদ্ধারের একটাই পথ বিদ্যাশিক্ষা, এই অধিকার তাকে ফিরিয়ে দিতে হবেই।
বিদ্যাশিক্ষার হাত ধরেই আসবে মানসিক ও আত্মিক উন্নতি। আসলে নিজেকে শক্তি ও সামর্থ্যের দিক থেকে হীনবল মনে না করে বিদ্যাশিক্ষাচর্চার মাধ্যমে নিজেকে এক সম্মানজনক অবস্থানে দাঁড় করাতে হবে। নিজের অবস্থানকে নির্দিষ্ট করতে না পারলে অবস্থান বার বার বদলাবে । নারীও তো এক সামাজিক সত্তা। কিন্তু সমাজ তাকে যেভাবে দেখে তাতে মনে হয় সে যেন বিধাতার নিস্ঠুর পরিহাস। সত্যিই তো সে যে জীবনযাপন করে তা যেন বিধাতার এক কঠোর ব্যঙ্গ। এই ব্যঙ্গের কারণে সে শুধুই চোখের জল ফেলে। কারোর সঙ্গে সে Share করতে পারে না। আসলে সেখানেও জুটবে সহানুভূতি। এ অবস্থার উন্নতি শুরু হলো। কিন্তু সে প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট সম্মানজনক হলো না। বাহ্যিক উন্নতি এলো কিন্তু মানসিক উন্নতির লক্ষণ কোথায়? তাতো লক্ষগোচর হয় না? তবে কি এ শুধুই eye wash। আসলে নারীরা উদ্যোগী হয়ে সে উন্নতিসাধনের দিকে এগিয়ে এলা তা কেবলমাত্র তার পোষাক-পরিচ্ছদের উন্নতি ঘটালো। কিন্তু যা অত্যন্ত জরুরী ছিল তার মানসিকতার পরির্বন তাতে এলো না। আসলে নিজের শক্তি ও সামর্থ্যের প্রতি আস্থা না জাগলে তো তার অবস্থার পরিবর্তন হলো না। ফলে এ পরিবর্তন হয়ে উঠলো নিতান্ত সাময়িক। আসলে সুযোগ তার জীবনে অনেকবার এসছে কিন্তু কখনো তারা সদ্ধ্যবহার করতে পারেননি। আসলে যে অবস্থার শিকার তারা সেই অবস্থার যেন ক্রমেই তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। এই অবস্থা তাকে আসল করে তুলেছে, নতুন কিছু তাকে আর বাবায় না। পরিস্থিতিরি চাপে আজ শুধু সে যপত্রমাত্র। সে আর মুক্তিপ্রত্যাশী নয়, মুক্তির স্বাদ যেন তাকে প্রতিনিয়ত ব্যঙ্গ করে চলে। মুক্তি শব্দটাই যেন নতুন করে তাকে আর ভাবয় না।
তবে বর্তমান শতাব্দী যেন নারীকে আবারও প্রশ্নচিহ্নের মুখে বসালো। প্রতিনিয়ত ঘটে চলা নির্যাতন ও ধর্ষণ আমাদের সচকিত করছে। রাসষ্ট্রযন্ত্রও আজ বাক্যহারা। নারীকে আজও আমরা যথাযোগ্য সম্মান দেখাতে পারিনি। ফলে দৃষ্টিভঙ্গীর বদল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আসলে আমরা নারীকে আজও শরীরসর্বস্ব ভেবেই চিন্তা করি। এই দৃষ্টিভঙ্গীর কারণেই আমরা নারীকে তু্চ্ছ, হীনবল বলেই identify করছ্ করছি। দৃষ্টিভঙ্গীর বদল হয়তো পরিস্থিতিকে অনেকটাই বদলে দেবে। পরিষিতিরি বদলটা তাই বড়ো বেশি আশ্যিক। কিন্তু যতো দিন এগোচ্ছে ততই যেন আমরা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ছি। নারী নির্যাতন ক্রমশই রূপ বদলাচ্ছে, প্রকট থেকে প্রকটতর হছ্চে পৃথিবীর অসুস্থতা। মনে মনে বিশ্বাস করি নারী-পুরুষের সর্ম্পক তো পরস্পরের সহযোগী কিন্তু পরিস্থিতি যতোই এগিয়ে চলেছে তাতে বলা যায় নারী-পুরুষের সর্ম্পক আর সহযোগের নয়, হয়ে উঠছে ক্রমশ বিরেধিতার। তাই বলা চলে এ সংঘাত চলতে থাকলে সংস্কৃতি ক্রমশই পঙ্গু হয়ে যাবে।
তাই যে প্রম্ন শিরোনামে থেকে গেলো তা যেন নারীর ভাগ্যকে উপহাস করছে। সত্যিই আমরা ভালো নেই।
এই প্রবন্ধ নারীর কাতর আবেদনকে ছড়িয়ে দিতে চায়-
” নারীকে বাঁচতে দিন, ওরা যে সত্যিই সসম্মানে বাঁচতে চায়।”
অধ্যাপিকা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত।