মালয়েশিয়ার কোটিপতির ছেলে $৫ বিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্য ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে জঙ্গলে জীবনযাপন করছেন।
আজান সিরিপানিও, যিনি বিলিয়ন ডলারের সম্পদের উত্তরাধিকারী, কিন্তু পার্থিব সুখ, ভোগ বিলাস ছেড়ে বেছে নিয়েছেন একটি গভীর শান্তি ও আধ্যাত্মিক পথ। তিনি তার বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী (ভিক্ষু) হয়েছেন। সিরিপানিওর বাবা, একজন কোটিপতি মালয়েশিয়ান ব্যবসায়ী, সেও তার ছেলের এই সিদ্ধান্তকে সম্মান করেন। আজান সিরিপানিও সন্ন্যাসী হয়ে থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তে একটি বৌদ্ধ বিহারে অতি সাধারণ জীবনযাপন করেন।
১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয় লেখক রবিন শর্মার বিখ্যাত বই ‘দ্য মঙ্ক হু সোল্ড হিজ় ফেরারি’। সারা বিশ্ব জুড়ে সেই বই হু হু করে বিক্রি হয়েছিল।
এক সফল আইনজীবী ‘জুলিয়ান ম্যান্টল’ আধ্যাত্মিক জীবনে পা দেওয়ার জন্য কী ভাবে নিজের প্রাসাদ এবং বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রি করে দেন, তা-ই ছিল বইটির বিষয়বস্তু।‘দ্য মঙ্ক হু সোল্ড হিজ় ফেরারি’র বইয়ের জুলিয়ান ছিল কাল্পনিক চরিত্র। কিন্তু ভেন আজহন সিরিপানিয়োর কাহিনি বাস্তব। এটি একটি বাস্তব জীবনের গল্প, যা অতি শান্ত সহজ সরলতা এবং আধ্যাত্মিক পূর্ণতার বিশ্ববাসীকে বার্তা দেয়, ভেনারেবল আজান সিরিপানিও। মালয়েশিয়ান কোটিপতি আনন্দা কৃষ্ণনের একমাত্র পুত্র, $৫ বিলিয়ন সম্পত্তি ত্যাগ করে সন্ন্যাসী জীবন গ্রহণ করেছেন। মালয়েশিয়ার অন্যতম ধনী ব্যক্তি আনন্দা কৃষ্ণনের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য টেলিকম, স্যাটেলাইট, তেল, রিয়েল এস্টেট এবং মিডিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। আনন্দের সেই বিপুল অর্থভান্ডারের উত্তরাধিকারী তাঁর একমাত্র পুত্র, আজহন। কিন্তু বাবার তৈরি ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যে মন নেই তাঁর। তিনি বিরাজ করতে চান আধ্যাত্মিকতার সূক্ষ্ম স্তরে। হয়েছেও তাই।
কে এই ভেনারেবল আজান সিরিপানিও?
বৈভবের মধ্যে জন্ম নেওয়া আজান সিরিপানিও ভরা যৌবনে ১৮ বছর বয়সে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ( বৌদ্ধ ভিক্ষু) হওয়ার। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, “আজান সিরিপানিওর বৌদ্ধ ভিক্ষু হওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল সম্পূর্ণরূপে তার নিজের এবং এতে পরিবারও সম্মাতি দিয়েছিল।”
তাইল্যান্ডের একটি বিহারে বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসাবে জীবন কাটালেও আজহনের বেড়ে ওঠা ব্রিটেনে। দুই বোনের সঙ্গে সেখানেই তিনি বড় হয়েছেন। আজহনের যখন ১৮ বছর বয়স, তখন তিনি তাঁর মায়ের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে তাইল্যান্ডে যান। উল্লেখযোগ্য, সিরিপানিওর মা, মোমওয়াজারংসে সুপ্রিন্দা চাক্রাবান, থাই রাজপরিবারের একজন সদস্য, আজহনের শরীরেও তাই রাজবংশের রক্ত বইছে।। এই ভ্রমণের সময়ই নাকি তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তিনি বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর জীবন কাটানোর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবেন। অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য প্রথম বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হলেও আজহনের জীবন চিরতরে বদলে যায়। শীঘ্রই পার্থিব সম্পত্তি ত্যাগ করে পুরোপুরি সন্ন্যাসী (বৌদ্ধ ভিক্ষু) হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
একজন বনবাসী সন্ন্যাসীর জীবন
দুই দশকের বেশি সময় ধরে, ভেনারেবল আজান সিরিপানিও বনবাসী সন্ন্যাসী হিসেবে জীবনযাপন করছেন, প্রধানত থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তের কাছে দাও দুম বৌদ্ধ বিহারে। ভোগবিলাস পরিত্যাগ করে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের অতি সরলভাবে জীবনযাপন এবং সাধারণ গৃহীদের শ্রদ্ধায় পদত্ত দানের উপর নির্ভরশীল থাকার মূলনীতি অনুসরণ করছেন।
বিশ্বব্যাপী দৃষ্টিভঙ্গি বার্তা
লন্ডনে তার দুই বোনের সঙ্গে বড় হওয়া সিরিপানিও যুক্তরাজ্যে তার শিক্ষা সম্পন্ন করেন এবং অন্তত আটটি ভাষায় দক্ষ। আজান সিরিপানিও ভোগবিলাসের চেয়ে আধ্যাত্মিক সেবার পথ বেছে নেওয়ার বিরল বাস্তব উদাহরণ।
আজান সিরিপানিওর জীবন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সত্যিকারের সুখ আর সম্পদ এক নয়। বিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হয়েও তিনি পার্থিব সুখ-ভোগ ত্যাগ করে বেছে নিয়েছেন সরল, সন্ন্যাসী জীবন। বিলাসবহুল জীবনযাপন যেখানে অনেকের কাছে স্বপ্নের মতো, সেখানে সিরিপানিওর জন্য এটি ছিল এক শূন্যতা। তিনি উপলব্ধি করেন, জীবনের প্রকৃত আনন্দ পাওয়া যায় অন্তরের শান্তি এবং আধ্যাত্মিক উপলব্ধির মাধ্যমে।
বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হিসেবে তিনি থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তের একটি বন আশ্রমে বাস করেন। এখানে নেই কোনো বিলাসিতা, নেই কোনো অতিরিক্ত চাহিদা—শুধু বৌদ্ধ দর্শনের অতি সহজ সরল শান্ত জীবনযাপন। দান গ্রহণ করে খাবার সংগ্রহ করা, প্রকৃতির মাঝে ধ্যান করা, এবং জীবনের জটিলতা থেকে মুক্ত থাকা—এই জীবনযাত্রাই তার জন্য এক নতুন স্বস্তির দরজা খুলে দেয়।
তরুণ প্রজন্মের জন্য এটি একটি শক্তিশালী বার্তা। আমরা প্রায়ই পার্থিব সম্পদ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ভোগ বিলাসের মধ্যে সুখ খুঁজে পাই। কিন্তু আজান সিরিপানিও দেখিয়েছেন যে, সহজ সরল জীবনের মধ্যেও এক গভীর আনন্দ লুকিয়ে থাকে। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের এই জীবন আমাদের শেখায় কীভাবে অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের ভেতরের শান্তি খুঁজে পাওয়া যায়।
তাদের জীবনধারায় নেই কোনো প্রতিযোগিতা বা অস্থিরতা। সবকিছু প্রাকৃতিক কর্মের নিয়মে চলে এবং জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধই মূলমন্ত্র। আজান সিরিপানিওর গল্প তরুণদের জন্য একটি উদাহরণ হতে পারে, যারা জীবনের মানে খুঁজতে চান। পার্থিব সুখে মত্ত না থেকে আধ্যাত্মিকতার দিকে মনোনিবেশ করলে এক ধরনের মুক্তি ও আনন্দ অনুভব করা সম্ভব।
সত্যিকার অর্থে, সুখ পাওয়া যায় তখনই, যখন আমরা আমাদের অন্তর্দৃষ্টি জাগ্রত করি এবং জীবনকে সহজভাবে গ্রহণ করি। আজান সিরিপানিওর জীবন তারই এক জীবন্ত উদাহরণ।
প্রকাশক ও সম্পাদক, ধম্মইনফো-ডট-কম