জ্যোতি আর্য বড়ুয়া: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা অনোমা বড়ুয়া তন্বীর মৃত্যুকে ঘিরে তৈরি হয়েছে গভীর রহস্য। একপক্ষ বলছে আত্মহত্যা, অন্যপক্ষের দাবি—এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, যা আত্মহত্যা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ঘটনাটির সঙ্গে যুক্ত পারিবারিক কলহ, শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ, এবং কিছু দৃশ্যমান আলামত তদন্তকে আরও জটিল করে তুলেছে।
কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও লেখক ধনিরাম বড়ুয়া এবং শিক্ষিকা চন্দনা বড়ুয়ার কনিষ্ঠ কন্যা তন্বী বড়ুয়অ। শৈশব থেকেই তিনি মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

২০১১ সালে এসএসসি এবং ২০১৩ সালে এইচএসসিতে জিপিএ–৫ অর্জনের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে বিবিএ ও এমবিএ ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের মতিঝিল শাখায় ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য অনুযায়ী, অনোমা বড়ুয়া তাঁর স্কুলজীবনের পরিচিত আশীষ বড়ুয়ার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান। আশীষ বড়ুয়া তখন বেকার ছিলেন। পারিবারিকভাবে সম্পর্কটি নিয়ে আপত্তি থাকলেও শেষ পর্যন্ত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে রামুর একটি ক্লাবে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিয়ে হয়।
বিয়ের পর দম্পতি ঢাকার সবুজবাগ থানার মায়াকানন এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন। শুরুতে দাম্পত্য জীবন স্বাভাবিক মনে হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন বাড়তে থাকে বলে পরিবারের অভিযোগ।
পরিবারের দাবি, বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই আশীষ বড়ুয়ার আচরণে পরিবর্তন আসে। অনোমার প্রতি মানসিক চাপ, অবহেলা এবং একপর্যায়ে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগও উঠেছে। এসব বিষয়ে অনোমা পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে মৌখিকভাবে জানিয়েছিলেন বলে তারা দাবি করছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বড় বোন অনন্যা বড়ুয়া শান্তা এবং তাঁর স্বামী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা পাইলট বড়ুয়ার ভাষ্য অনুযায়ী, মৃত্যুর আগের কয়েক দিনে দম্পতির মধ্যে একাধিক বিষয়ে তীব্র ঝগড়া হয়। এর মধ্যে চাকরি পরিবর্তন, ধর্মীয় সফর এবং ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে বিরোধ ছিল।
২০ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে অনোমা বড়ুয়া তন্বীর মৃত্যুর খবর পরিবার জানতে পারে। স্বামী আশীষ বড়ুয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়, তিনি নিজ বাসায় ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। ওই সময় বাসায় পরিবারের অন্য কেউ উপস্থিত ছিলেন না।
পরদিন ২১ ডিসেম্বর মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। সে সময় কোনো ময়নাতদন্ত হয়েছে কি না, তা নিয়ে পরিবারের মধ্যেই পরে প্রশ্ন ওঠে।
শেষকৃত্যের পর পরিবারের হাতে থাকা কিছু আলোকচিত্র ও ভিডিও নিয়ে নতুন করে সন্দেহ দেখা দেয়। পরিবারের সদস্যদের দাবি, অনোমার মাথায় আঘাতের চিহ্ন ছিল, যা আত্মহত্যার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তারা আরও অভিযোগ করেন, কিছু ছবিতে সেই আঘাত ঢাকার চেষ্টা দেখা গেছে।
পরিবারের বক্তব্য অনুযায়ী, এসব আলামত থেকে ধারণা করা হচ্ছে—প্রথমে শারীরিক আঘাতের ফলে মৃত্যু ঘটে থাকতে পারে, এরপর সেটিকে আত্মহত্যা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
এই প্রতিবেদনের জন্য আশীষ বড়ুয়ার বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও তিনি সরাসরি কোনো মন্তব্য দিতে রাজি হননি বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। তবে আগের বয়ানে তিনি অনোমার মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলেই উল্লেখ করেছেন।
ঘটনাটি নিয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি। পরিবার আনুষ্ঠানিক তদন্ত, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, অভিযোগ পেলে তারা আলামত, পারিবারিক বক্তব্য ও চিকিৎসা প্রতিবেদন যাচাই করে আইনানুগ সিদ্ধান্ত নেবে। তবে এখনো পর্যন্ত মামলার অগ্রগতি বা তদন্তের সময়সীমা সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহপাঠী ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন অনোমা বড়ুয়া তন্বীর মৃত্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, একজন উচ্চশিক্ষিত কর্মজীবী নারীর মৃত্যু শুধু পারিবারিক ঘটনা নয়—এটি নারীর নিরাপত্তা ও দাম্পত্য সহিংসতার বড় প্রশ্ন সামনে আনে।
অনোমা বড়ুয়া তন্বীর মৃত্যু আত্মহত্যা না হত্যাকাণ্ড—এই প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। সত্য উদঘাটন নির্ভর করছে তদন্তের স্বচ্ছতা, আলামতের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ এবং আইনি প্রক্রিয়ার ওপর। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট—এই মৃত্যু বাংলাদেশের সমাজে দাম্পত্য সহিংসতা ও বিচারহীনতার বিতর্ককে নতুন করে সামনে এনেছে।

