বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এক গভীর সংকটে রয়েছেন। সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনা এবং নিরাপত্তাহীনতা এই সম্প্রদায়গুলোর জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে। রাষ্ট্রের অদূরদর্শিতা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থতা এবং আইন প্রয়োগে পক্ষপাতমূলক আচরণের কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং সহিংসতার মোকাবিলায় রাষ্ট্রের ব্যর্থতা নিয়ে এই প্রতিবেদন।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতার ধারাবাহিকতা
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে হামলা, সম্পদ দখল, এবং ধর্মীয় নিপীড়নের ঘটনা নতুন নয়। ২০১২ সালের বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলায় মুসলিশ মৌলবাদী গৌষ্ঠী কর্তৃক ২০১২ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে বৌদ্ধ বিহার, মন্দির ও ঘরবাড়িতে ধারাবাহিক হামলা। মৌলবাদীরা ১২ টি বৌদ্ধ মন্দির ও বিহার এবং ৫০ টি বাড়ি ধ্বংস করে। এই সহিংসতা পরে কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলা ও চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে বৌদ্ধ বিহার ও হিন্দু মন্দিরকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হয়।
আনুমানিক ২৫,০০০ জনের বেশি ইসলামী মৌলবাদী বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের উপর পরিচালিত সহিংসতায় অংশ নিয়েছিল।
দেশ বিদেশে আলোচিত এ সাম্প্রদায়িক হামলার ১২ বছর পার হলেও আদালতে বিচারাধীন এ সংক্রান্ত ১৮টি মামলার একটিরও বিচার কাজ শেষ হয়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সহিংসতার তীব্রতা আরো বেড়েছে। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে ঢাকায় বাংলাদেশ সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোটের আয়োজিত সমাবেশে নেতারা জানান, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রতিনিয়ত ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। সংখ্যালঘুদের জমি দখল, সম্পত্তি লুণ্ঠন, এবং ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা সারা দেশে নিয়মিত ঘটছে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক সহিংসতা। ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এবং বাঙালি বসতিস্থাপনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে অনেকের প্রাণহানি ঘটে। এই ঘটনা জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতার একটি দৃষ্টান্ত যেখানে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসন যথেষ্ট দ্রুত পদক্ষেপ নেয়নি। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সহিংসতা বৃদ্ধি পায়, যেখানে আদিবাসী চাকমা সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে, তাদের শত শত ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছে, এবং রাঙ্গামাটি শহরের মৈত্রী বিহার লুটপাট হয়েছে। খাগড়াছড়ি দীঘিনালা তে আর্মির পক্ষপত মূলক অবস্থান থেকে আদিবাসী পাহাড়ীদের গুলি করতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৩ জন এবং রাঙ্গামাটিতে কলেজ পড়ুয়া এক আদিবাসীদের প্রকাশ্যে রাস্তায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
রাষ্ট্রের ব্যর্থতা এবং প্রশাসনিক উদাসীনতা
এই সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অভাব স্পষ্ট। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যকর না হওয়া এবং ইউনুস প্রশাসনে প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলি আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতার সময়ে শুধু নিষ্ক্রিয় থেকেছে তা নয় কোন কোন ক্ষেত্রে তা বাঙালি সেটেলার তথা হামালাকারীদের পক্ষ হয়ে সংখ্যালঘুদের উপর গুলি চালিয়ে, যা পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা যখন তীব্র হয়ে ওঠে, তখন সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকা এবং প্রশাসনের নিস্ক্রিয়তা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। বিশেষ করে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংখ্যালঘুদের ঘর বাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রক্ষায় কোন ধরণের প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এবং দেখা গেছে সেনাবাহিনী আদিবাসী প্রতি গুলি চালিয়ে এবং সেই গুলিতে ৩জন আদিবাসী মারা যায়।
সংখ্যালঘু শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা
৫ আগস্ট ২০২৪ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই সারাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আরও এক প্রকারের নিপীড়নের ঘটনা ঘটতে থাকে। ৪৯ জন সংখ্যালঘু শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগ করানো হয়। তাদের মধ্যে মাত্র ১৯ জনকে তাদের পদে পুনর্বহাল করা সম্ভব হয়েছে। এই ধরনের ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, দেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলোও সংখ্যালঘুদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এর ফলে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের মধ্যে এক ধরণের অবিশ্বাস ও অনিরাপত্তা সৃষ্টি হচ্ছে।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কারণ
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয়েছে। এর পেছনে আছে রাজনৈতিক এবং সামাজিক কারণ রয়েছে। বিশেষ করে, ভূমি দখল, সম্পদ দখল এবং ধর্মীয় উগ্রপন্থা থেকে উত্থিত সহিংসতা এসব ঘটনা আরও বাড়িয়ে দেয়। দেশের অনেক এলাকায় সংখ্যালঘুদের জমি ও সম্পত্তি জোরপূর্বক দখল করে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এই ধরনের কর্মকাণ্ড প্রায়শই স্থানীয় ক্ষমতাশালী প্রশাসনের সহযোগিতায় বা মদদে ঘটে, যা সংখ্যালঘুদের জীবন ও নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক সহিংসতার পেছনের কারণ হিসেবে জমি দখল এবং প্রশাসনের সহযোগিতা না থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে। এছাড়া, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তি চুক্তির বেশিরভাগ ধারাই এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি, যা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ বাড়িয়ে তুলেছে। এতে করে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাগুলির উপর সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
আইনের প্রয়োগে পক্ষপাত
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় প্রায়শই আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়া এবং বিচার ব্যবস্থার কার্যকরী ভূমিকা না থাকার অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মামলায় অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার হার খুবই কম। প্রশাসনের উদাসীনতা এবং আইনের দৃষ্টিতে পক্ষপাতিত্বের কারণে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা আরও বেড়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টসের সহিংসতার পর প্রশাসন কেবল সাময়িকভাবে ১৪৪ ধারা জারি করে এবং পরে তা তুলে নেয়। এর ফলে সহিংসতার পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং সংখ্যালঘুরা আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
২০১২ সালে রামু সহিংসতার ১৮টি মামলার একটিরও বিচার কাজ শেষ হয়নি। হিন্দুদের দূর্গা পূজোয় কোরআন রেখে সারা দেশে হিন্দুদের উপর হামলা সহ নানান সময়ে দিন্দু বৌদ্ধদের উপর হত্যা নির্যাতন, ভুমি দখন, অগ্নিসংযোগের ঘটনার আজ পর্যন্ত একটা বিচার বা অপরাধীর শাস্তি হয়নি।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও করণীয়
বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রের একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সংখ্যালঘু ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধে রাষ্ট্রের ভূমিকা হতে হবে দৃঢ় এবং কার্যকর। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে ভূমিকা নিতে হবে।
এছাড়া, সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। তাদের সম্পত্তি রক্ষার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন এবং সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করার পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও মন্ত্রণালয় গঠন
সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিশেষ আইন প্রণয়ন করতে হবে। সংখ্যালঘুবিষয়ক একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গঠন করা সংখ্যালঘুদের সমস্যা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সেই সাথে হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে ফাউন্ডেশনে রূপান্তর করা এবং দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার আইন কার্যকর করা সংখ্যালঘুদের জমি ও সম্পত্তির সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
অধিকন্তু, সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ উপাসনালয় এবং পালি ও সংস্কৃতির শিক্ষা বোর্ড গঠনও প্রয়োজন। সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় উৎসবগুলিতে ছুটির ব্যবস্থা করা এবং তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করাও সংখ্যালঘুদের জন্য সমঅধিকার নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সুপারিশ
১. সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন: সংখ্যালঘুদের উপর হওয়া সহিংসতার সঠিক তদন্ত এবং বিচারের জন্য একটি সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা উচিত।
২. আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও মানবাধিকার সংস্থার অংশগ্রহণ: সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও নজরদারিতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।
৩. শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন: ১৯৯৭ সালের চুক্তির ধারা পূর্ণ বাস্তবায়ন করা এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
৪. ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি: পার্বত্য অঞ্চলের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি বিশেষ কমিশন গঠন করে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
৫. সামরিক বাহিনীর প্রত্যাহার: পার্বত্য অঞ্চল থেকে সেনা শিবিরগুলো তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করা এবং সেখানে শান্তি ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা প্রদান করা উচিত।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্রের যে ব্যর্থতা আজ দৃশ্যমান, তা রাষ্ট্রের ওপর একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা মোকাবিলায় রাষ্ট্রকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং আইনের প্রয়োগে পক্ষপাত দূর করতে হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা, সম্পত্তির সুরক্ষা এবং সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব এখন আরও বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রকাশক ও সম্পাদক, ধম্মইনফো-ডট-কম